রোড শো’র মধ্যেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে কমছে বিদেশি বিনিয়োগ
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে দেশের বাইরে গত দুই বছর ধরে রোড শো করছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এসব রোড শো’র মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাঝে বাংলাদেশের উন্নয়ন, বিনিয়োগের রিটার্নসহ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে বিএসইসির এমন আয়োজনের পরও সম্প্রতি তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে কমেছে বিদেশি বিনিয়োগ। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) দেয়া তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র উঠে এসেছে।
দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমায় বাজার সংশ্লিষ্টরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতিকে দুষছেন। তাঁরা বলছেন, ফ্লোর প্রাইস জারি করে দেশের শেয়ারবাজারকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। ফলে বিদেশে রোড শো করলেও এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। একই সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতাকেও বিদেশি বিনিয়োগ না আসার অন্তরায় মনে করছেন অনেকে।
জানা গেছে, দেশের শেয়ারবাজারে একাধিক বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়। এর মধ্যে রয়েছে- সিঙ্গার বাংলাদেশ, ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার লিমিটেড, লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস, ম্যারিকো বাংলাদেশ, বাটা শু, আরএকে সিরামিকস, রবি, গ্রামীণফোন এবং লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড। এই এগারো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬টি কোম্পানিতেই গত ৯ মাসে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। তিন কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আগে থেকেই শূন্যের কোঠায়। আর বাকি এক কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ অপরিবর্তিত রয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের। গত বছরের (২০২২ সাল) ডিসেম্বরে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ শেয়ারে বিনিয়োগ ছিল বিদেশিদের। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটিতে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। অর্থাৎ ৯ মাসে সিঙ্গারের বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে দশমিক ৬১ শতাংশ।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ কমার দ্বিতীয় স্থানে আছে গ্রামীণফোন লিমিটেডের। নয় মাসে টেলিকমিউনেকশন খাতের কোম্পানিটিতে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে দশমিক ৫৩ শতাংশ। বর্তমানে কোম্পানিটির ১ দশমিক ৬০ শতাংশ শেয়ার বিদেশিদের হাতে রয়েছে। তৃতীয় স্থানে থাকা ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ দশমিক ৫৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশে।
এছাড়াও ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ারে দশমিক ১৮ শতাংশ, ম্যারিকো বাংলাদেশে দশমিক ০৮ শতাংশ, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশে দশমিক ০৫ শতাংশ এবং বাটা শুতে বিদেশি বিনিয়োগ ৯ মাসে দশমিক ০১ শতাংশ কমেছে। বার্জার পেইন্টসের বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ গত ৯ মাসে অপরিবর্তিত রয়েছে। অপরদিকে রবি আজিয়াটা, লিন্ডে বাংলাদেশ এবং আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশে আলোচ্য সময়ে কোন বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ কমার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, রোড শো করে বিদেশি বিনিয়োগ আনা যায় না, এটা বিএসইসি নিজেই জানে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে, বিদেশিদের সামনে শতবার বক্তব্য দিলেও তো তাঁরা বিনিয়োগ করতে আসবে না। নির্দিষ্ট প্রজেক্টের আওতায় বিএসইসি রোড শো করে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য রোড শো করতে হয় না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা মনে করেছে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বেঁচে যাওয়া যাবে, তবে এ বেঁচে যাওয়া হচ্ছে শেয়ারবাজারকে অচল করে দেয়া। অচল বাজারে তো বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে আসবে না।
তিনি বলেন, ফ্লোর প্রাইস না থাকলে শেয়ারের দাম উঠানামা করতো। এখনতো এক শেয়ার বিক্রি করে আরেক কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করা যাচ্ছে না। তবে ফ্লোর প্রাইস কারসাজি চক্রের জন্য বাঁধা হয়েছে এটিও ঠিক।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকও মনে বিদেশি বিনিয়োগ কমার পেছনে ফ্লোর প্রাইস অন্যতম কারণ। তবে তিনি বলেন, আমাদের দাবির মুখেই বিএসইসি ফ্লোর প্রাইস দিয়েছে। সঠিক সময়ে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছে বিএসইসি। রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ হলে হয়তো নির্বাচনের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বার্তা টোয়েন্টিফোরকে বলেন, সুদহার বৃদ্ধি, রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শেয়ারবাজারে কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়াও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি শঙ্কা আছে। আশা করি নির্বাচনের পর শেয়ারবাজার ভালো হবে। তখন তারল্যসংকট কেটে যাবে। ফলে দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে এবং শেয়ারবাজার ভালো হবে।
উল্লেখ্য, দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে ২০২১ সালে রোড শো শুরু করে বিএসইসি। এর প্রেক্ষিতে প্রথম দফায় দুবাইতে, দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রে, তৃতীয় দফায় সুইজারল্যান্ড, চতুর্থ দফায় যুক্তরাজ্য, পঞ্চম দফায় কাতার, ষষ্ঠ দাফয় জাপান, সপ্তম দফায় দক্ষিণ আফ্রিকায় রোড শো করা হয়। অস্টম দফায় গত ২৩ অক্টোব ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে, ২৫ অক্টোবর তুলুসে এবং আজ (সোমবার) জার্মানের বার্লিনে রোড শো করে বিএসইসি। এ দফায় ফ্রাঙ্কফুর্ট ও বেলজিয়ামের ব্রাসেলেসেও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে যৌথভাবে রোড শো করবে সংস্থাটি।