সাগরে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে শেষ, গ্যাসের সম্ভাবনা উজ্জ্বল
প্রথম বলা হলো পিএসসি (উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি) আপডেট হোক, পিএসসি চূড়ান্তের পর বলা হলো মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের পর সাগরে দরপত্র আহ্বান। সেই ১৩ হাজার ৬০০ লাইন কিলেমিটার মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে শেষ তবুও আন্তর্জাতিক দরপত্রের কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু করে মে মাসেই দ্বি-মাত্রিক জরিপ শেষ করেছে টিজিএস এবং স্লামবার্জার সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কোম্পানি। এখন চলছে তথ্য ইন্টারপ্রিটেশনের কাজ। তবে বাংলাদেশ চাইলে এখনই এসব তথ্য ব্যবহারের জন্য সরবরাহ দিতে প্রস্তুত তারা। দ্বি-মাত্রিক জরিপে গ্যাস প্রাপ্তির অনেক সম্ভাবনার কথা জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে ২০১২ সালে মিয়ানমার, ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। বিশাল সমুদ্রে খনিজ সম্পদের কোন তথ্য নেই কারণে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের উদ্যোগ নেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। নানা কারণে কয়েক বছর পিছিয়ে যায় সেই সার্ভের কাজও। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এসে কাজটির অনুমোদন দেওয়া হয়।
বহুজাতিক কোম্পানিটি দ্বি-মাত্রিক জরিপের তথ্য নিজেরা সংরক্ষণ করবে। বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী কোম্পানিকে কিনতে হবে তথ্য। কোম্পানিটি প্রথমে নিজেদের বিনিয়োগ তুলে নেবে, আর মুনাফা করতে পারলে ৩৫ শতাংশ শেয়ার দেবে বাংলাদেশকে।
দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিষয়টি হতে পারে কাকতলীয়, তবে আমদানিকে উৎসাহিত করার যে প্রবণতা, তার সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায়। মাত্র ৩ মাসের কাজটির আদেশ দিতে লাগলো প্রায় ৮ বছর। আবার পিএসসি হালনাগাদ করার ক্ষেত্রেও ঢিলেমি দৃশ্যমান। পিএসসি হলো তারপরও দরপত্র আহ্বান না করা বোকামি ছাড়া আরও কিছুই হতে পারে না।
মডেল পিএসসি-২০০৮ চূড়ান্ত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন পেট্রোবাংলার তৎকালীন পরিচালক (মাইনিং) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী। সাবেক ওই পরিচালক বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ২০০৮ সালে সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যে চূড়ান্ত করেছিলাম। এখন পৌনে ৩ বছর লাগবে কেনো। আমরা তখন খসড়া উন্মুক্ত রেখে পাবলিকের মতামত নিয়েছি, আমরা ৪টি পাবকিল কনসালটেশন করেছি। তখনও এতোদিন লাগেনি, এবারতো এসবের কিছুই করা হয়নি। বিষয়টি হচ্ছে লক্ষ্যটা কি, আপনার যদি লক্ষ্য হয় গ্যাস আমদানি তাহলে দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান গুরুত্ব হারাবে এটাই স্বাভাবিক।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলে কমপক্ষে ৩ মাস সময় দিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কোন পার্টি দরপত্র জমার জন্য বাড়তি সময় চেয়ে আবেদন করে। তখন তাকে সময় দেওয়া আন্তর্জাতিক রেওয়াজ। দরপত্র জমার পর মূল্যায়ন করতেও দুই-তিন মাস সময় লাগবে। অথচ অলস বসে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে সরকার নির্বাচনের আগে আর কিছু করতে চায় না। গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ৯টি ব্লক প্রস্তুত রয়েছে দরপত্রের জন্য। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ যতো বেশি বিলম্ব করছে ততবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের পাশের ব্লকগুলো থেকে দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস উত্তোলন করছে মিয়ানমার।
পেট্রোবাংলার ঢিলেমির কারণে বিশাল সমুদ্র জয়ের পর অধরা সম্ভাবনার সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। এক দশক পেরিয়ে সেই সমুদ্র সীমার সফলতা কোনই কাজে আসেনি, বিশেষ করে খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে। দেশের ভয়াবহ জ্বালানি সংকটের স্বস্তিকর সমাধান এই বিশাল জলরাশির নিচে লুকায়িত বলে মনে করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। কারণ বাংলাদেশের ব্লকের পাশেই মিয়ানমার বিশাল গ্যাসের মজুদ পেয়েছে। সাগরে দরপত্র আহ্বান করেও খুব একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। সে কারণে বাংলাদেশের পিএসসি-২০১৯ আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ নেয়। ঘাটে ঘাটে বিলম্বের পর চলতি বছরের ২৬ জুলাই অনুমোদন চূড়ান্ত অনুমোদন পায় মডেল পিএসসি-২০২৩।
পিএসসি অনুমোদনের পর একাধিক সভায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তৎকালীন সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেছিলেন, আমরা এক মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করতে চাই।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, মডেল পিএসসি আকর্ষণীয় করার কারণে অনেক বড় বড় বিদেশি কোম্পানি সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখাচ্ছে। মার্কিন কোম্পানি এক্সন মবিল, শেভরন খুবই আগ্রহ দেখাচ্ছে। এক্সন মবিল দুই দফায় প্রস্তাবনা দিয়েছে। আমরা একটি নন বাইন্ডিং এমওইউ করতে পারি।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে,সাধারণ পিএসসি চূড়ান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরপত্র ডকুমেন্ট অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কিন্তু পিএসসি অনুমোদিত হওয়ার ৩ মাস অতিবাহিত হলেও দরপত্রের ফাইল এখন তোলা হয়নি। তবে খসড়া ডকুমেন্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছে, ফাইল চাওয়া হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।
বঙ্গোপসাগরে দুটি ব্লকে প্রায় ৫ থেকে ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ সম্ভাবনার কথা ২০১৪ সালের জুনে বলেছিলেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী বিদেশি কোম্পানি কনোকো ফিলিপসের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই তথ্য নিশ্চিত করেছিলেন। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ২৮০ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকের অবস্থান। ২০১১ সালের ১৬ জুন মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে তেল-গ্যাস উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি (পিএসসি) করা হয়। কনোকো ফিলিপস গভীর সমুদ্রে ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে দ্বি-মাত্রিক জরিপের মাধ্যমে এই বিশাল মজুদের বিষয়ে অবগত হয়েছে। পরে কাজ ফেলে চলে যায় আমেরিকান কোম্পানিটি।
অন্যদিকে গত বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সিসমিক সার্ভের ওপর ভিত্তি করে বঙ্গোপসাগরে ১৭ থেকে ১০৩ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস-হাইড্রেট প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা জানান । ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি এক প্রেস বিফ্রিংয়ে সমীক্ষার বরাত দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন তথ্য জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে ২৯টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব ফিল্ডে প্রমাণিত মজুদ ধরা হয় ২০.৫৫ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট), সম্ভাব্য ও সম্ভাবনাময় মিলে আরও প্রায় ৮ টিসিএফ মজুদ ধারণা করা হয়। এ যাবত প্রায় ১৯ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ১ টিসিএফ’র মতো গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে সে হিসেবে আর মাত্র ৮ বছরের গ্যাসের মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে। প্রতি নিয়ত কমছে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন। ঘাটতি সামাল দিতে চড়াদামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। তারপরও সংকট দূর হচ্ছে না। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে স্থবিরতার কারণেই আজকেই এই সংকটের মূল কারণ।