ইসিটি স্বাক্ষর বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী!

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সনদে চুক্তির প্রশ্নে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সনদের সংশোধিত ধারার বিষয়ে তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ, স্বাক্ষর প্রশ্নে তথ্য পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপি বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ‘জ্বালানি সনদ চুক্তির বিষয়ে অবজারভেশনে (পর্যবেক্ষণে) রাখা হয়েছে। এখনও হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই বলা যাচ্ছে না।’

বিজ্ঞাপন

সনদটির বিষয়ে দেশে দেশে অনেক বিতর্ক চলছে, বিতর্কের কারণে ইতালীসহ অনেকে বের হয়ে গেছে। তেমন একটি সময়ে বাংলাদেশ কেন ঢুকতে চাচ্ছে। এমন প্রশ্ন ছিল বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কাছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সার্বিক বিষয়ে দেখেশুনে তারপর সিদ্ধান্তে আসতে চাই। দেশের অমঙ্গল হয় এমন কিছু করা হবে না।’

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের নীতি-নির্ধারণী পর্যা‌য়ে একজন কর্মকর্তা বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ‘এনার্জি চার্টার ট্রিটির (ইসিটি) কিছু ধারায় সম্প্রতি সংশোধনী আনা হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংশোধনীর বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠির জবাব এখনও পাওয়া যায় নি। ওই চিঠির জবাব পেলে তারপর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দিন খান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের পথে হাঁটছে। জ্বালানি সনদ চুক্তির মূল উদ্যোক্তা ছিল নেদারল্যান্ডস, তারাই এখন বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে বের হয়ে যাওয়া খুব সহজসাধ্য নয় তাই একে জম্বী সনদ বলা হয়। চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও ২০ বছর কার্যকর থাকবে। অর্থাৎ একবার স্বাক্ষর করা মানেই কয়েক দশক আটকে যাওয়া।’

১৯৯১ সালে ডাবলিনে এক সভায় তৎকালীন ডাচ প্রধানমন্ত্রী রুড লুবার এনার্জি কমিউনিটি গড়ার প্রস্তাব দেন। ওই প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় জ্বালানি সনদ চুক্তি বা ইউরোপীয় এনার্জি চার্টার ট্রিটি চূড়ান্ত হয়। আর ১৯৯৮ সালে কার্যকর হয় এনার্জি চার্টার ট্রিটি বা জ্বালানি সনদ চুক্তি। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে এনার্জি চার্টারে স্বাক্ষর করে এখন পর্যবেক্ষক হিসেবে রয়েছে। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য সম্মেলনে বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে নিশ্চিত করেছে, শিগগিরই চুক্তি করার পথে রয়েছে।

তিনি বলেন, ধারা ৫, ১১ ও ১৪ অনুযায়ী লোকাল কোনো পণ্য ব্যবহারে বাধ্য করতে পারবে না। জনবলও নিতে বাধ্য করা যাবে না। এমনকি ভোক্তার জন্য জ্বালানি মূল্য কমালে বিনিয়োগকারী যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতে মামলা করতে পারবে। এই সনদে সই করলে বিদেশি কোম্পানি বিনা বাঁধায় তাদের পুঁজি, মুনাফা ফেরত নিয়ে যেতে পারবে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে, বিনিয়োগ সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব নিরসনে অতি ব্যয়বহুল আন্তর্জাতিক সালিশের দারস্থ হতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যান্য আইনের মতো প্রাথমিক ধাপে স্বাগতিক রাষ্ট্রের আদালতে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। এই সনদ স্বাগতিক দেশের জন্য একটি অসম ও ভারসাম্যহীন অবস্থায় সৃষ্টি করা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘জার্মানি ক্রমান্বয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সুইডিস কোম্পানি ভ্যাটেনফল এবি ২৭ হাজার ৫৪ কোটি টাকার মামলা ঠুকে দেয়। ইতালী চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর উপকূলীয় অঞ্চলের গ্যাস ও খনিজ খনন নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক কোম্পানি রকহপার কর্তৃক মামলার শিকার হয়েছে। ৩ হাজার ২৬৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে রকহপার।’

ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিশ্বের জ্বালানি অর্থনীতির ৬১ শতাংশ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি দ্বারা। কার্বন নিসরণ কমানোর জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা বলা হচ্ছে। ট্রিটির শর্তসমূহ তা ব্যাহত করবে। বাংলাদেশ ফসিল ফুয়েল থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে চাচ্ছে, ট্রিটি তা বাঁধাগ্রস্ত করবে। ট্রিটির কারণে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জ্বালানি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে।

বিশ্বব্যাপী ব্যবসা সুরক্ষার জন্য নানা রকম ফন্দি ফিকির চলছে তারই একটি অংশ ট্রিটি। বিনিয়োগ ও সেই দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাজটি ট্রিটির মাধ্যমে করতে চাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা যুগে যুগে স্বাগতিক দেশগুলোকে যে শৃঙ্খলিত করার প্রয়াস চালিয়েছে, ট্রিটি তাদের লাভবান করবে। এতে স্বাক্ষর না করার জন্য ক্যাবের পক্ষ থেকে গণস্বাক্ষর জমা দিয়েছি। আশা করছি সরকার এই আত্মঘাতী পথ থেকে সরে আসবে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অপর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, এই ধরনের চুক্তির বিষয়টি সামনে আসে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য। বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের জায়গায় পরিণত হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশ বিদেশি দাতাদের কাছে বিনিয়োগের জন্য ধর্না দিত। এখন উল্টো তারা বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে আসছে। চুক্তি যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে এমন প্রেক্ষাপটে স্বাক্ষর করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।