ওজিডিসি ভেঙে কি পেয়েছি, মূল্যায়ন না করে সেই পথেই বাংলাদেশ!

  • মো. আমজাদ হোসেন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বাপেক্স বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, অনুসন্ধান ও উৎপাদনে একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান আমলের তেল, গ্যাস, ও খনি সম্পদ প্রতিষ্ঠান ছিল ওজিডিসি (ওয়েল এন্ড গ্যাস ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন) সেখান থেকে বাপেক্স সৃষ্টি।

কালের বিবর্তনে এটাকে ভেঙে অনেকগুলো কোম্পানি করেছি, কিন্তু কেন? আমরা কি পেয়েছি এ যাবত সেখান থেকে সেটা বিশ্লেষণ না করে এ প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রেখেছি। অথচ ওজিডিসির ন্যায় ভারতে ওএনজিসি আজও বিদ্যমান। তারা নিজেরা দেশে ও বিদেশে কাজ করার জন্য একই ছাতাতলে ওএনজিসি বিদেশ নামে কাজ করছে।

বিজ্ঞাপন

ওজিডিসি ভাগ করে আমরা যতগুলো কোম্পানি করেছি তা শুধু ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ করার জন্য। যেমন বড়পুকুরিয়া কয়লা উত্তোলনের কাজ ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। কথা ছিল পরবর্তীতে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি (বিসিএমসিএল) নিজেরা সক্ষমতা অর্জন করবে। কিন্তু বিগত দেড় যুগে কয়লা, পাথর ও খনিজ আহরণে কোনো কোম্পানি ঠিকাদার নিয়োগ ছাড়া সক্ষমতা অর্জন করেনি। অথচ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের শুরুতে বিদেশিদের ওপর ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার করে একাধিক (দশ/বার) বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে দেশে কাজ করার অনুমতি প্রদান করেন ও পেট্টোবাংলা গঠন ও কোম্পানিগুলো ওই সময় অগভীর সমুদ্রে ৩২ হাজার লাইন কিলোমিটার সাইসমিক সার্ভে ও ১২টি কূপ খনন করে (২০০০-৪৫০০মিটার)। ইউনিয়ন ওয়েল কোম্পানি ক্যালিফোনিয়া কুতুবদিয়ায় একটি কূপে তিনটি গ্যাস জোন আবিষ্কার করেছিল। উপরের জোনটি ১০ মিটার টেস্ট করে ১৮.৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ৩/৪ চোকে উৎপাদন পরীক্ষা করে। এই কূপের গ্যাস রিজার্ভ বর্তমান সাঙ্গুর উৎপাদিত গ্যাসের দিগুণ। আমরা কেন এসব বিশ্লেষণ করছিনা?

সদ্য স্বাধীন দেশ যুদ্ধ বিধ্বস্ত সব প্রতিষ্ঠান, পরাশক্তির কুদৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ, আট টাকা চালের কেজি অথচ নাম মাত্র মূল্যে ১৭.৮৬ কোটি টাকা দিয়ে বিদেশি কোম্পানি শেল থেকে ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র ক্রয় করেছিল বঙ্গবন্ধু। অথচ অভাব অনটনে জর্জরিত দেশ যার টাকা বা ডলারের সংস্থান নেই। তবুও বঙ্গবন্ধু এই গ্যাসক্ষেত্র বিক্রি করেনি। কারণ বাংলাদেশকে তিনি সন্তানের মত লালন করেছেন। তাদের সম্পদ গ্যাসক্ষেত্র বাংলাদেশ অর্থাৎ তার সন্তানেরা ভোগ করবে নিজেরা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উপকৃত হবে। এটাই সব সত্যিকার পিতার কামনা ও চিরন্তন সত্যি। সেদিন সে মাটির নিচের এ বিশাল সম্পদ বিক্রি করলে কেউ বুঝতনা। কারণ তখন আমাদের এসব বোঝার অবস্থা ছিল না আর সুধীজনরা প্রস্ফুটিত জ্ঞান সমৃদ্ধ হলেও এসব বিষয়ে ধারনা ছিল না বললেই চলে।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু সবাই হতে পারে না, যে সারা বাংলার ভূমি, জল, স্থল ও সাধারণ জনগণকে বুকের স্নেহ দিয়ে লালন করবে সেইতো প্রকৃত পিতা। মাফ করবেন অনেকটা আবেগকাতর হয়েছি, কারণ স্বধীনতা যুদ্ধে আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিঃস্ব অবস্থায় আমি ও আমার বড় ভাই টগবগে তরুণ স্বাধীনতার স্বপক্ষে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এই অবস্থায় পাকবাহিনী আমার সম্মুখ থেকে একাত্তরের ৭ আগস্ট মধ্যরাতে আমার বড় ভাই মো. আজিজুল হক তরুণ অধ্যায়নরত প্রকৌশলীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও রাইফেলের বাট দিয়ে দাঁতমুখ ভেঙে হত্যা করে। সেদিন মধ্যরাতে রাজারহাট রেল স্টেশন সংলগ্ন বাড়িটি থেকে আকাশ বাতাস ভেদ করে আর্তনাদ হচ্ছিল বাবা আমাকে বাঁচাও, আল্লাহ আমাকে বাঁচাও। আমরা অসহায় কিছু করতে পারিনি। শহীদ ভাইয়ের মৃত্যুর বিপরীতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ২০০০ টাকা একটি চেক আমার বাবার হস্তগত হলে তা স্থানীয় মসজিদে দান করেন। পরবর্তীতে আমি নিজে কয়েকবার পাকবাহিনী থেকে রক্ষা পেলেও আমার সহযাত্রীকে মাথার পিছনে গুলি করে হত্যা করেছিল। ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই। রাখে আল্লাহ মারে কে এ শান্তনা নিয়ে কর্মের মাধ্যমে দেশকে ভালোবাসার অনুভূতিতে বাপেক্স ও পেট্টোবাংলার কিছু কাজের অভিজ্ঞতা ও সুপারিশ অবগতির জন্য বর্ণনা করছি। আমি মনে করি নিম্নলিখিত কাজগুলো দ্রুততার সঙ্গে করা গেলে গ্যাস সংকট অনেকটাই কমে আসতে বাধ্য।

>> ১৯৭৬ সালে মুলাদী ও বেগমগঞ্জে আমার কর্ম ও প্রশিক্ষণ। তখন না বুঝিলেও এখন বুঝি মুলাদি ১ ও ২ এবং বেগমগঞ্জ ১ ও ২ এ একাধিক গ্যাস জোন থাকতে পারে, এজন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রয়োজন।

>> আমি মনে করি ভোলার ১২০০ বর্গ কিলোমিটার এবং নিকটবর্তী দ্বীপ ও জলের তলদেশে গ্যাসের অস্তিত্ব বিরাজমান। বর্তমান ভোলার ৫০০ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ৯টি কূপের সবগুলোতে গ্যাস পাওয়া গিয়েছে। প্রতিটি কূপের কাজে আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের লক্ষে বাপেক্সের সবগুলো রিগ ভোলায় নেওয়া দরকার। পাইপলাইন না হওয়া পর্যন্ত সাঙ্গু প্লাটফর্মের মাধ্যমে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা উচিত। পাইপলাইন হলেও এই অবকাঠামোর প্রয়োজন হবে। কারণে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে এবং সাগরের গ্যাস আনতে পাইপলাইন ব্যয়বহুল হবে। তখন বিচ্ছিন্ন এলাকার গ্যাস ওই পদ্ধতি ব্যবহার করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাবে।

>> সিলেট গ্যাস ফিল্ডের কূপগুলোতে সেকেন্ডারি কাজ করা প্রয়োজন। সিলেট ৭ নম্বর কূপে এ কাজটি আমার দায়িত্বে কোন সার্ভিস নিয়োগ ও মালামাল ছাড়া ১৫ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ করে তাদের ৫০ কোটি টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছি। অথচ কর্তৃপক্ষ কূপটিকে ওয়ার্ক ওভারের জন্য সমস্ত মালামাল ও সার্ভিস নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করেছিল।

>> বিজিএফসিএল তিতাস ৩ নম্বর কূপের গ্যাস লিকেজ আমি সনাক্ত ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ করি সে মোতাবেক বিদেশি কোম্পানি বুটস এন্ড কুটস কাজ করে এবং সুপারিশ মূলক রিপোর্ট প্রদান করে যা আজও বাপেক্সকে প্রদান করেনি। অথচ পরামর্শক ও কমিটি ও কর্তৃপক্ষ ১০ নম্বর কূপে লিকেজ হয়েছে মর্মে সুপারিশ করে। আমি ও বাপেক্স ঝুঁকি নিয়ে কাজটি করার জন্য কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করি।

বাপেক্স কারিগরি ও আর্থিক দিকে সফল ও লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান। তাকে আপনারা অবহেলা করবেন না। বাপেক্সকে কোরবানির পশু না বানিয়ে তার নিজস্ব কর্ম সম্পাদনে সহযোগিতা করুন। কারণ বাপেক্স যা পারে তা বাংলাদেশে এখনো অন্য কোন প্রতিষ্ঠান পারে বলে আমি মনে করি না। জকিগঞ্জের মতো উচ্চচাপ জোনে সফলভাবে কূপ খনন করেছে বাপেক্স। শাহবাজপুরে বাপেক্স যা করে দেখিয়েছে তার নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে কাজের জন্য ১৬২ কোটি বরাদ্দ ছিল, সেই কাজ মাত্র ৮০ কোটি টাকায় শেষ করেছে বাপেক্ষ। এতে ছিল ৫৩ কিলোমিটার পাইপলাইন, কূপের ওয়ার্ক ওভার, ১০০ একর জমি অধিগ্রহণ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও ২ নম্বর কূপ খনন । কাজ শেষ করে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৮২ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়। ওই প্রকল্প থেকে ৪ বছরে গ্যাস বিক্রি করে আনুমানিক ৮০ কোটি টাকা আয়ও হয়েছিল।

লেখক- মো. আমজাদ হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাপেক্স।