গ্যাসের মিটারিং পদ্ধতিতে ভীত কেনো জিটিসিএল
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) পরিমাপ করে নিলেও সরবরাহের সময় পরিমাপের ব্যবস্থা ছিল না। আর এই পরিমাপ করতে গিয়েই উঠে এসেছে নানা রকম ফাঁকফোকর।
এতোদিন জিটিসিএল সিস্টেম লস অন্য কোম্পানির কাঁধে সরিয়ে দিয়ে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে। আর সেই মুনাফার পাহাড় থেকে প্রতি বছর ২ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রফিট বোনাস পেয়ে এসেছে। পেট্রোবাংলা সরবরাহ পর্যায়ে মিটার বসিয়ে পরিমাপ পদ্ধতি চালু করতে চায়। সেই প্রস্তাব জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে প্রেরণ করা হলেও ঝুলে রাখা হয়েছে কয়েকমাস ধরে।
মিটার না থাকায় এতোদিন যেসব কোম্পানি সুবিধাভোগ করছেন তারা একজোট হয়ে নেমেছে পেট্রোবাংলার বিরুদ্ধে। চুরি ঠেকাতে না পেরে সিস্টেমলস বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছে। এতে সলতে যোগাচ্ছেন এতোদিন ধরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে বসে ছড়ি ঘোরানো একজন অতিরিক্ত সচিব। পেট্রোবাংলার ওই প্রস্তাব ঝুলে রাখার পাশাপাশি জিটিসিএল ও অন্যান্য কোম্পানির কর্মকর্তাদের উস্কে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। এতোদিন আওয়ামী লীগের সৈনিক থাকলে ৫ তারিখের পর বোল পাল্টে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে পাঠানো পত্রে পেট্রোবাংলা লিখেছে, জিটিসিএল অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিসমূহে গ্যাস সরবরাহ করলেও অধিকাংশ অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টে সরাসরি গ্যাস মিটারিং এর তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না। এর ফলে জিটিসিএল-এর ট্রান্সমিশন সিস্টেমে কারিগরি বা অন্যভাবে গ্যাসের কোন পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। এতে করে বিতরণ কোম্পানিসমূহের পক্ষে প্রকৃত ক্রয়ের পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হতো না ও ট্রান্সমিশন সিস্টেমের লোকসান কিংবা পার্থক্য বিতরণ কোম্পানির নিজস্ব পার্থক্যের সাথে একীভূত হয়ে যেত।
বর্তমান প্রবর্তিত পদ্ধতিতে গ্যাস উৎপাদন কোম্পানি, আইওসি এবং আরএলএনজি উৎসসমূহ হতে মোট ২০টি পয়েন্টে মিটারিংয়ের মাধ্যমে গ্যাস গ্রহণ করছে এবং ৬৪টি অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিসমূহে সরবরাহ করছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ২০১৮সালের এক আদেশে জিটিসিএল বিতরণ কোম্পানির ইনটেক পয়েন্টের বিদ্যমান মিটারিং ব্যবস্থা কার্যকর করার নির্দেশনা প্রদান করে। ওই নির্দেশনার পরে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি পূর্বের পদ্ধতি বাতিল করে অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টের (জিটিসিএল বা বিতরণ কোম্পানি কর্তৃক স্থাপিত স্টেশন) মিটারিং অনুযায়ী কোম্পানিভিত্তিক গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ বিভাজন করবে। সেই অনুযায়ী বিতরণ কোম্পানিসমূহ গ্যাস বিল (উৎপাদন, সঞ্চালন, আইওসি, এলএনজি, পেট্রোবাংলা ও অন্যান্য চার্জসমূহ) যথাসময়ে পরিশোধের ব্যবস্থা করবে বলে সুপারিশ দেয়।
ওই রিপোর্টের পর পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিসমূহের সমন্বয় সভায় মিটারিং পদ্ধতি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত হয়। সভায় মিটার বসানোর পর গ্যাসের সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো কেনা-বেচার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এতে দেখা গেছে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে জিটিসিএল এর সিস্টেম লস ২.৯৫ শতাংশ, ফেব্রুয়ারি ২.৯৯ শতাংশ, মার্চে ৩.১০ শতাংশ এবং এপ্রিলে ২.৪১ শতাংশ। অন্যদিকে মিটার অনুযায়ী মার্চে (২০২৩) তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ১০.৭৮ শতাংশ, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ৬.৩৮ শতাংশ, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড ১.৩৪ শতাংশ, কর্নফূলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ২.০৫ শতাশ লোকসান হয়েছে। ৬টি বিতরণ কোম্পানির সামগ্রিক লোকসান ছিল ১৬১ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস।
কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, জানুয়ারি ২০২৩ হতে অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টে মিটারিং ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ায় মিটারিংয়ের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিসমূহে সরবরাহকৃত গ্যাসের পরিমাণের মধ্যে যে পার্থক্য হচ্ছে তা জিটিসিএল-এর সিস্টেম লস হিসেবে গণ্য হবে এবং তার কারিগরি ও আর্থিক দায় জিটিসিএল বহন করবে।
জিটিসিএল জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে গ্যাস গ্রহণ ও বিতরণ কোম্পানিকে সরবরাহের মধ্যে যে পার্থক্য হচ্ছে তার কারিগরি ও অন্যান্য বিষয়সমূহের যাচাইপূর্বক যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। জিটিসিএল এর নিজস্ব গ্যাস ব্যবহার যেমন বিভিন্ন জেনারেটর, থার্মো ইলেক্ট্রিক জেনারেটরসহ কম্প্রেসরসমূহ (মুচাই, আশুগঞ্জ ও এলেঙ্গা) পরিচালনা এবং নিজস্ব আরো গ্যাস ভোগ যদি থেকে থাকে তা জিটিসিএল সংশ্লিষ্ট এলাকার বিতরণ কোম্পানিকে গ্রাহক শ্রেণী অনুযায়ী গ্যাস বিল পরিশোধ করবে এবং জিটিসিএল তা প্রশাসনিক খরচের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবে।
স্ব স্ব বিতরণ কোম্পানি কর্তৃক জিটিসিএল-এর অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টে মিটারিং- এর মাধ্যমে গৃহীত গ্যাসের পরিমাপের যোগফল উক্ত বিতরণ কোম্পানির মোট গ্যাস ক্রয় হিসেবে গণ্য হবে। বিতরণ কোম্পানিসমূহ কর্তৃক স্ব-স্ব অধিক্ষেত্রাধীন এলাকায় গ্রাহক প্রান্তে সরবরাহকৃত গ্যাস মোট বিক্রয় হিসেবে গণ্য হবে। গ্যাস ক্রয় এবং গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহে পার্থক্য থাকলে তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানির ওপর বর্তাবে। বিতরণ কোম্পানিসমূহ স্ব স্ব কোম্পানি প্রান্তে সিস্টেম লস কমানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টে মিটারিং ব্যবস্থা কার্যকর করার ফলে জিটিসিএল কর্তৃক গ্যাস গ্রহণ ও সঞ্চালন সিস্টেমের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিতে সরবরাহের পরিমাণের মধ্যে কী পরিমাণ পার্থক্য হচ্ছে তা নিরূপণ করা সম্ভব হয়েছে। জিটিসিএল এর মূল কার্যক্রমের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। তবে বর্তমান মিটারিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে ধারণা করা যাচ্ছে যে, জিটিসিএল-এর সিস্টেম লসের অনেকটাই কারিগরি লস; যার যৌক্তিকতা ও ব্যাখা জিটিসিএল-কে প্রদান করতে হবে। একইসাথে ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণসহ সিস্টেম লসের গ্রহণযোগ্য মাত্রা নির্ধারণের পদক্ষেপ জিটিসিএলকে গ্রহণ করতে হবে। স্ব স্ব বিতরণ কোম্পানির বিক্রয়ের মধ্যে পার্থক্য/সিস্টেম লস নিরূপণ করা, এর কারণ চিহ্নিত করা, প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অধিকতর জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে।
কিন্তু সেই রিপোর্ট ঝুলে রেখেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। মিটারিং সিস্টেমটি খানিকটা ঢাকা শহরে ট্রাফিক সিগন্যাল লাইটের মতো করার চেষ্টা চলছে। বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে সিস্টেম প্রস্তুত করার পর, একটি গ্রুপ অচল করে রাখার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এতে জিটিসিএল বোর্ডে থাকা একজন অতিরিক্ত সচিবের নাম সামনে এসেছে।
গ্যাসের বিতরণ কোম্পানিগুলো অনেক বছর ধরেই মুনাফা করে চলছে। তাদের মুনাফার কিছুটা নজীর পাওয়া যায় প্রফিট বোনাস প্রদানের হার থেকে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড তার ৩৮৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রত্যেককে ১৮ লাখ টাকা করে প্রফিট বোনাস দেওয়া হয়। জিটিসিএল এক সময় ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রফিট বোনাস দিয়েছে। এখন যখন তাদের নিজের কাঁধে সিস্টেম লস পড়ছে, মুনাফা কমে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এতে করে বছর বছর প্রফিট বোনাসের নামে উপরি হিসেবে পাওয়া কাড়ি কাড়ি টাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম ক্ষুব্ধ অনেকেই। তারাই এখন রাস্তায় নেমে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য মকবুল-ই এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, জিটিসিএল এর সিস্টেম লস হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তারা হাইপ্রেসারে (১০০০ পিএসআই) সঞ্চালন করে। পাইপে কোথাও সুচ পরিমাণ লিকেজ থাকলে ২০০ থেকে ২৫০ গজ দূর থেকে শব্দ পাওয়া যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দু’টি কারণ থাকতে পারে। একটা হচ্ছে কোথাও চোরাইভাবে কাউকে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, অথবা যখন পরিমাপ করে নিচ্ছে, সেখানে কম নিচ্ছে। এটার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, মিটার বসানোর ফলে প্রকৃত চিত্র জানতে পারছি। এতোদিন যেসব সিস্টেম লসের কথা বলা হতো, অনেকটাই অনুমান নির্ভর। আমরা কোম্পানিগুলোকে সিস্টেম লস যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য বলেছি।