সামিট গ্রুপের ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল চুক্তি বাতিল
ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ-৩) টার্মিনাল স্থাপনের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। কোন রকম দরপত্র ছাড়া বিশেষ আইনের আওতায় চলতি বছরে ৩০ মার্চে সামিট গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
বাংলাদেশের তৃতীয় আর সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন দ্বিতীয় টার্মিনাল নামে পরিচিত ছিল। সামিট গ্রুপের প্রথম এফএসআরইউ মহেশখালীতে বিদ্যমান। সমালোচনা ও বিতর্ক উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকার চড়াদামে কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তি করেছিল।
পেট্রোবাংলার সচিব রুচিরা ইসলাম সাক্ষরিত এক আদেশে সামিট গ্রুপের সঙ্গে বিশেষ আইনে সম্পাদিত চুক্তিটি বাতিল করার আদেশ জারি করা হয়েছে।
২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কক্সবাজারের মহেশখালীতে দেশের তৃতীয় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল খসড়া চুক্তি অনুমোদন করে। চুক্তি অনুযায়ী, টার্মিনাল চালুর পর থেকে ১৫ বছর মেয়াদে দৈনিক ৩ লাখ ডলার (চুক্তিতে উল্লিখিত বিনিময় হার অনুযায়ী ৩ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকার সমপরিমাণ) রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ পাওয়ার কথা ছিল সামিট গ্রুপের। ১৫ বছরে টার্মিনালটি থেকে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ বাবদ সামিটের আয় দাঁড়াবে অন্তত ১৭ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকায় (ডলার ১১০ টাকা হারে)।
কয়েক বছর আগেও ছোট-খাটো ব্যবসায়ী থাকলেও এখন সিঙ্গাপুরের মতো জায়গাতেও শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর তালিকায় জায়গা পেয়েছেন সামিট গ্রুপের মালিক আজিজ খান। ফোর্বস ২০২৪ সালের বিলিয়নিয়ারদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। তালিকায় ২ হাজার ৫৪৫ নম্বরে রয়েছেন আজিজ খান, যার মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার এবং আয়ের খাত হিসেবে রয়েছে জ্বালানি। ফোর্বসের তথ্য অনুসারে, আজিজ খান বর্তমানে সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। এর আগে তিনি সিঙ্গাপুরের ৪১তম ধনী ব্যক্তি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন।
সরকার ঘনিষ্ঠ আজিজ খানের কাছে রাষ্ট্রীয় আইন ও আচার তাদের কাছে ছিল চানাচুরের ঠোঙ্গায় থাকা পুরাতন কাগজের টুকরো মাত্র। আইন, নীতিমালা, মাস্টারপ্ল্যান কোন বিবেচ্য বিষয় ছিল না, হয়েছে সামিট গ্রুপ যা চেয়েছে সেটাই। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এমনকি বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনাও বদলে গেছে সামিট গ্রুপের চাপে। দেশের স্বার্থ বিবেচনায় নয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়েছে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মুহাম্মদ আজিজ খান চাওয়ায়। এমনই তথ্য পাওয়া গেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাগজপত্রে। এসব ঘটনায় যেমন রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তেমনি অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের।
পিডিবি সুত্রে জানা গেছে, সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটি শান্তাহার ৫২ মেগাওয়াট এবং সৈয়দপুর ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন দেয় ২০১১ সালের ১ জুন। তেল ভিক্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি যথা সময়ে নির্মাণে ব্যর্থ হলে কয়েক দফায় তাগাদাপত্র দেওয়া হয় সামিট গ্রুপকে। শেষ পর্যন্ত অগ্রগতি না হওয়া আইন অনুযায়ী সামিটের ১২ লাখ ডলার জামানত বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় পিডিবি। সে অনুযায়ী জামানত বাজেয়াপ্ত করার নোটিশও দেওয়া হয়েছিল পিডিবির পক্ষ থেকে।
কথা ছিল চিঠির পর সামিটের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। প্রভাবশালী আজিজ খানের হুমকি-ধামকিতে সবকিছু বদলে যায়। তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের নির্দেশে নোটিশ প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়। পাশাপাশি সময় বর্ধিত করে শান্তাহার ও সৈয়দপুরের পরিবর্তে নারায়নগঞ্জের মদনগঞ্জ ও বরিশালে স্থাপনের সুপারিশ দেওয়া হয় সামিটের চাওয়া অনুযায়ী। যা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মাস্টারপ্লানের সঙ্গে ছিল সারসরি সাংঘর্ষিক।
নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সম্প্রতি আজিজ খান ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবে জব্দ করেছে বাংলাদেশ সরকার। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।