বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই বিদেশে নাবিল গ্রুপের বিনিয়োগ

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই বিদেশে নাবিল গ্রুপের বিনিয়োগ

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই বিদেশে নাবিল গ্রুপের বিনিয়োগ

যশোর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ ও তার ভাইদের মালিকানায় একটি ব্রিটিশ চা কোম্পানির নামে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। তাদের কোম্পানির আর্থিক লেনদেন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কীভাবে তাদের মতো দেশের ক্ষমতাধর লোকেরা অবৈধভাবে এশিয়ার বিভিন্ন ব্যবসায়ীক খাতগুলো ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচার করেছে।

জেমকন গ্রুপেরও মালিক নাবিল আহমেদ ও তার ভাই কাজী আনিস আহমেদ এবং কাজী ইনাম আহমেদ। চলতি বছরের ১২ এপ্রিল লন্ডনের রয়্যাল কোর্ট অফ জাস্টিসের এক শুনানিতে তারা যুক্তরাজ্যের একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তার এই তথ্য তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় উল্লেখ করেননি। শুধু তাই নয় ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে নাবিলের আয় বেড়েছে প্রায় ১ হাজার শতাংশেরও বেশি। সেটাও তিনি ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের হলফনামায় উল্লেখ করেননি। এই সম্পদের তথ্য জানতে বর্তমানে তদন্ত চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বিজ্ঞাপন

এদিকে কোম্পানিটির ব্যাংক স্টেটমেন্টে মিলেছে এক অদ্ভুত তথ্য। এতে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যে অর্থ যুক্তরাজ্যের ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে সেটা বাংলাদেশ থেকে স্থানান্তর করা হয়নি। বরং বিনিয়োগের অর্থ এসেছে সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ের একটি ফার্ম থেকে। দুবাইয়ের ওই ফার্মটির মালিক কাজী আনিস আহমেদ।

যুক্তরাজ্যের আদালত থেকে শুনানির প্রাপ্ত ট্রান্সক্রিপ্টগুলোতে দেখা যায়, নাবিল ও তার দুই ভাই যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্যবসায়িক অংশীদারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার জন্য লড়াই করেছেন। যাতে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি প্রকাশ না পায়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে যেই কোম্পানিগুলো বিদেশে ব্যবসায় বিনিয়োগ করে তাদের একটি তালিকা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, ১৯৭১ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যে কোম্পানিগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশে ব্যবসায় বিনিয়োগ করার জন্য অনুমোদন দিয়েছে তার মধ্যে জেমকন গ্রুপের কোন চিহ্নিই নেই।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) বিশ্লেষণ অনুসারে দেখা যায়, তিনি বিভিন্ন থেকে ব্যাংক প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এই পরিমান অর্থ ব্যাংক থেকে যেসব এমপিরা ঋণ নিয়েছেন সে তালিকায় শীর্ষ পাঁচজনের মধ্যে তিনি একজন।

টিআইবির তথ্য দেখা যায়, তিনি ব্যবসায়িক শেয়ারে ২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করেছেন।

সম্প্রতি তিনি ব্রিটিশ ফার্ম তেতুলিয়া ইউকে লিমিটেডের ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন পাউন্ডের (৩৯ দশমিক ৫ কোটি টাকা) আর্থিক বিবরণী দুদকের কাছে জমা দিয়েছেন। এই কোম্পানিটির বড় একটি শাখা এটি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার রাজ্যের পাশেই অবস্থিত।

এই কোম্পানিটি বাংলাদেশ থেকে চা আমদানি করে এবং বাজারজাত করে। ২০০৭ সালের ২৯ নভেম্বর কাজী নাবিল ও তার দুই ভাই কাজী আনিস এবং কাজী ইনাম কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানিটির নথিতে দেখা যায়, ২০১০ সালে এই কোম্পানিটির মালিক হিসেবে লিন্ডা অ্যাপেল লিপসিয়াস নামে আরও এক মার্কিন নাগরিককে যুক্ত করা হয়।

নথি অনুসারে আরও জানা যায়, নাবিল ও তার ভাইয়েরা ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটিতে ১৮ মিলিয়ন ডলারের (২১৫ কোটি টাকা) বেশি বিনিয়োগ করেছেন।বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তাদের বিনিয়োগের মোট মূল্য প্রায় ২৫৪ দশমিক ৫ কোটি টাকা।

নাবিল, আনিস ও ইনামের আইনজীবী এন হ্যামিল্টন আদালতকে বলেন, "আমার মক্কেলরা তেতুলিয়ায় (ইউকে) বিনিয়োগকারী ছিলেন। সেখান থেকেই সব টাকা এসেছে।"

তবে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার জন্য এই অর্থ তারা কোথায় পেয়েছেন তা প্রকাশ করেননি আইনজীবী হ্যামিল্টন। 

যদিও ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তিনটি কোম্পানির মোট ১০টি লেনদেনের মাধ্যমে এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার তথ্য পাওয়া গেছে। কোম্পানি তিনটি হলো- দুবাই-ভিত্তিক ডাবল কোর জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি, আরামেক্স ইন্টারন্যাশনাল এবং সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক গ্লোবাল বিজ ইমপোর্ট এক্সপোর্ট পিটিই লিমিটেড।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় অর্থনৈতিক রেজিস্টার থেকে রেকর্ডকৃত একটি অনুলিপি ও কোম্পানি শো'র বাণিজ্যিক লাইসেন্স থেকে দেখা যায়, ২০২৩ সালে কোম্পানিটি কাজ বন্ধের পর তেতুলিয়া যুক্তরাজ্যের লিকুইডেশন রিপোর্টে শুধু ডাবল কোরকে কোম্পানিটির বিনিয়োগকারী হিসেবে উল্লেখ করে। আর মালিক হিসেবে দেখানো হয়, কাজী আনিস, কানাডিয়ান নাগরিক মোহাম্মদ সোহেল রানা এবং আমিরাতের আবদুল্লাহ হাসান আলী নামে এক নাগরিককে। এটি দিরা আল মুরার নামে একটি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত।

কোম্পানিটির লিকুইডেশন রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২০ সালেই কোম্পানিটি ২৫ হাজার ২৪৭ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৯ লাখ ৫৪ হাজার ৫১০ টাকা) মুনাফা অর্জন করেছে। অথচ ব্যবসা শুরু করার আগে সংস্কারের জন্যই এটি ব্যয় করেছিল ৫ লাখ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ কোটি ৮৩ লাখ ১১ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা)।

এই ব্যবসাটির অংশীদার ও পরিচালক ছিলেন আহসান আকবর নামের এক ব্যক্তি।

নাবিল এবং তার ভাইদের ব্যবসায়িক অংশীদারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করার বিষয়ে মামলার শুনানিতে যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টের বিচারক বিচারপতি স্যার রবার্ট জে তাদের আইনজীবীদের বলেছেন, "আপনার ক্লায়েন্টরা এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার কারণে আমাদেরকেও বিব্রত করার পরিস্থিতিতে ফেলার প্রবণতা থাকতে পারে। কারণ বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং আইন দুর্বল হওয়ার কারণেই তারা এমন কাজ করতে পেরেছেন।"

ব্রিটিশ ব্যবসায়িক অংশীদার আহসানের আইনজীবী ক্লোই স্ট্রং বলেছেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত বিদেশী কোম্পানির মালিকানার ক্ষেত্রে বাংলাদেশী নাগরিকদের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং এটি বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং বিধি লঙ্ঘন হতে পারে।"

তবে নাবিলের আইনজীবী হ্যামিল্টন এই দাবি অস্বীকার করে বলেছেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানি লন্ডারিংয়ের আইন ভঙ্গ করা হয়নি। এই কোম্পানির একমাত্র বিনিয়োগকারী তারাই।

আদালতকে মানি লন্ডারিং বিষয়টিকে নিষেধাজ্ঞা দিতে অনুরোধ করেছিলেন নাবিলের আইনজীবী হ্যামিল্টন। কিন্তু বিচারপতি জে, তাদের এই নিষেধাজ্ঞাকে প্রত্যাখান করেন। তবে তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে ২২ জুলাই নিষেধাজ্ঞা পায়।

এ বিষয়ে নাবিল ও ইনাম কোন কথা না বললেও তাদের ভাই কাজী আনিস বলেন, "আমাদের চায়ের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডটি বিদেশ থেকে বিনিয়োগ নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই কোম্পানিটির কার্যক্রম বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে ইতিবাচক ভূমিকায় তুলে ধরবে।"