সরকারের বড় দুর্বলতা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এনগেজ হতে না পারা: ড. জিল্লুর

  • ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, সরকারের বড় দুর্বলতা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এনগেজ হতে না পারা। অর্থনীতির চাকা যাঁরা ঘোরাবেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসার তাগিদ দিয়ে বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেছেন, শ্রীলঙ্কা আমাদের মতো অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে পড়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা মূল্যস্ফীতিকে জোরালোভাবে নিয়ন্ত্রণে এনেছে, এটা এমন নয় যে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব।

আজকের পত্রিকা’কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন ড. হোসেন জিল্লুর। সাক্ষাৎকারটির চুম্বকাংশ বার্তা২৪.কম’র পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হল:

বিজ্ঞাপন

এখনো অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলমান। শুধু বিদেশি ঋণ নিয়ে কি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে?

হোসেন জিল্লুর: উচ্চ মূল্যস্ফীতিটা শুধু বিগত সরকারের দুর্নীতির কারণে হয়নি। এটা অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং একধরনের অলিগার্কদেরকে পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণের সুবিধা করে দেওয়ার কারণে হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু ব্যাপার আছে। কেন এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটা চলছে? উচ্চ মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটা সমাধানের জন্য বর্তমান সরকারও শুধু কিছু অর্থনীতির সামষ্টিক সূচককে কীভাবে ঠিক করা যায়, সেগুলো নিয়ে ভাবছে। মূল্যস্ফীতির দুটি দিক আছে—এক. মূল্যস্ফীতিটা কমানো; দুই. মানুষের আয়ের ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে অর্থনীতির চাকাটাও ঘোরাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের দুর্বলতা হলো, এদের ব্যবসায়ী শ্রেণির সঙ্গে যুক্ততার ব্যাপারটা কম। অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত বলা যায়। এটা হলো এই সরকারের বড় দুর্বলতা। সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমানোর পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা বেগবান করতে হবে; তবে দুটিই সমান্তরালভাবে। দ্বিতীয়টিতে কোনো ধরনের নজর নেই। আর সক্ষমতারও ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি।

বিজ্ঞাপন

দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা সিন্ডিকেটের দাপটের কথা বলেছেন। রাষ্ট্রের চেয়ে কি সিন্ডিকেট বড়? সিন্ডিকেট মোকাবিলার পথ কী?

হোসেন জিল্লুর: অবশ্যই এখানে একটা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সিন্ডিকেট বা অলিগার্ক—যাদের কথাই বলি না কেন, তাদের প্রভাব বেশ জোরালোভাবে এখনো বাজারের মধ্যে চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভোজ্যতেলের দাম কীভাবে বাড়ানো হলো, সেটা আমরা দেখেছি। সেখান থেকে উদাহরণ টেনে বলা যায়, সিন্ডিকেট বা অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের বড় দুর্বলতা হলো, তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এনগেজ হতে পারছে না। কারণ, এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ বা বাণিজ্য উপদেষ্টারা শুধু সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করলে হবে না; সিন্ডিকেট বা অলিগার্ক তো অল্পসংখ্যক। এ ছাড়া আরও অনেক গোষ্ঠী তো আছে। সাড়ে ১৫ বছর ধরে তারা অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়েছে। আমরা একবাক্যে পুরো ব্যক্তি খাতকে একটা কাঠগড়ায় দাঁড় করাব—এটা তো একটা বোকামির কাজ হবে। অবশ্যই অলিগার্কদের অযৌক্তিক প্রভাব থেকে আলাদা করতে হবে। অর্থনীতির চাকা যাঁরা ঘোরাবেন, তাঁদের সঙ্গে তো আলোচনায় বসতে হবে। আমাদের কাছে বড় উদাহরণ হতে পারে শ্রীলঙ্কা। তারা আমাদের মতো অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে পড়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা মূল্যস্ফীতিকে জোরালোভাবে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এটা এমন নয় যে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। এখানে ব্যক্তি খাতের ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পথগুলো দুর্বল। সেটা তো একটা দৃশ্যমান ব্যর্থতা এই সরকারের। সরকারের আরও বেশি প্রোঅ্যাকটিভ হওয়ার বিষয় আছে। খাদ্যশস্য আমদানির ক্ষেত্রে অলিগার্কদের একটা প্রভাব আছে। এখন তাদেরকে বাদ দিয়ে অন্য ছোটদের এখানে যুক্ত করা যায়। তাদের কীভাবে মাঠে জোরালোভাবে জায়গা করে দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে কাজ করা দরকার। সমাধান পেতে হলে ওই খাতের লোকদের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই। শেষবিচারে মানুষ সমাধানটাই চায়।

শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে একটা সাধারণ ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল। অভ্যুত্থানের পর সেখানে বিভেদ দেখা যাচ্ছে। মৌলিক বিষয়গুলোতে জাতীয় ঐকমত্য কি আদৌ আশা করা যায়?

হোসেন জিল্লুর: বিগত সরকারের আমলে স্বৈরশাসনের সঙ্গে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল; সার্বিকভাবে মানুষকে নিয়ে একটা অপমানের অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল; ন্যায়বিচার, দক্ষতা, মেধা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। এরপর সেই শাসনব্যবস্থা যে বিতাড়িত হলো এবং সেটা যেন আবার ফিরে না আসে, সেই ঐকমত্য এখনো অব্যাহত আছে। মানে কী আর হওয়া উচিত নয়, সেই ঐকমত্য আছে। আপনি যে ঐকমত্যকে বিভেদ বলছেন, আমি সেটাকে বলতে চাই ভিন্ন ভিন্ন মত। আমি বলতে চাই, কী হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া দরকার।

২০২৫ সালের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, কোন পথে এগোতে হবে? কীভাবে অগ্রসর হব? এখন অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হলো ভিন্নমতকে একটা ঐক্যের সুরে নিয়ে আসা। একই সঙ্গে আস্থার জায়গাগুলো আরও জোরালো করা যে আমরা এটা করতে চাই। এসব জায়গায় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এখন এখানে তিনটি বলয়; যেমন অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক মহল এবং নাগরিক সমাজকে ক্রিয়াশীল হতে হবে। ঐকমত্যের জায়গায় কীভাবে অগ্রসর হতে হবে এবং সঠিকভাবে অগ্রসর হবে কি না, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তিন বলয়ের ওপর পড়ে।

দেশে ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। শুধু সংস্কারের প্রস্তাব পেশ হলেই কি ৫৩ বছরের রাজনৈতিক জঞ্জাল পরিষ্কার করা সম্ভব হবে, নাকি প্রতিটি দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি?

হোসেন জিল্লুর: রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের উদ্যোগগুলো বিভিন্ন মহল থেকে আসতে হবে। আমার পর্যবেক্ষণ হলো, সংস্কার কমিশনগুলো কেতাবিভাবে হয়েছে। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা খুব জরুরি ছিল। আমলাতান্ত্রিকভাবে নয়, খোলামেলাভাবে হলে ভালো হতো। কারণ, বিশ্বাসযোগ্যভাবে ঐকমত্য তৈরি করা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের বড় দায়িত্ব হচ্ছে, তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জায়গাগুলো তারা ফ্যাসিলিটেট করবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের কথা যখন আমরা বলি, তখন সেটা তিনভাবে চিন্তা করতে হবে। আমরা যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের কথা বলি, এটার দায় পড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর, এরপর দায় হলো রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। এই যে আকাঙ্ক্ষা জনমনে সৃষ্টি হয়েছে, তারা তার প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল? তাদের মধ্যে যে দখলবাজি, মামলাবাজির যে প্রবণতা আছে মানুষকে হয়রানি করার জন্য—এসব নিয়ে তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোকে তারা কতটুকু নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে পারছে। তারপর নাগরিক সমাজের একধরনের বড় দায়িত্ব আছে। কারণ, জবাবদিহির জায়গাগুলো শুধু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হবে না। একটা সজাগ, সক্রিয় নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বর আরও শক্তিশালী করা দরকার।