এবার মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও কম্প্রেশর তৈরি করা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান কর দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এর আগে ৫০টিরও বেশি পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও অন্যান্য কর বৃদ্ধি করেছিল এনবিআর। বর্তমানে এ ধরনের শিল্প তাদের আয়ের ওপর ১০ শতাংশ কর দিচ্ছে এবং শিল্পের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও উপকরণ আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দিচ্ছে- যা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বলবত থাকার কথা ছিল।
তবে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এই করহার দ্বিগুণ করা হতে পারে এবং তা কার্যকর হতে পারে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকেই। এ লক্ষ্যে বিদ্যমান আদেশটি বাতিল করে চলতি সপ্তাহেই নতুন আদেশ জারি করা হতে পারে।
তবে আমদানি পর্যায়ে এআইটি বাড়ানো হলে তা আদেশ জারির দিন থেকেই কার্যকর হবে বলে এনবিআরের আয়কর বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে জানান।
অবশ্য কর বাড়ানোর বিষয়ে গত শনিবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেই ইঙ্গিত দিয়েছে এনবিআর। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভ্যাটের পাশাপাশি করজালের আওতা বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
কর বাড়ালে দেশের মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর ও এসি শিল্পের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে এবং শেষপর্যন্ত এই ভার ভোক্তার ঘাড়েই চাপবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা।
এনবিআরের সাবেক আয়কর নীতি সদস্য সৈয়দ মো. আমিন্নুল করিম বলেন, 'কর বাড়ানো হলে এই চাপে শেষপর্যন্ত পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে এবং কোম্পানিও কিছুটা চাপে পড়বে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে সুবিধা ২০৩২ সাল পর্যন্ত দেওয়া হলো, তা হঠাৎ করে বাতিল করে দেওয়া হলে বাংলাদেশে কর নীতি যে বিনিয়োগবান্ধব নয়, তা আবার প্রকাশ হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'কর সুবিধা বিবেচনায় নিয়েই একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করেছিলেন। এভাবে ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন বাংলাদেশ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল বার্তা পাঠায়।'
এসি ও রেফ্রিজারেটর বাজারের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় উৎপাদনকারী ফেয়ার ইলেক্ট্রনিকসের চিফ মার্কেটিং অফিসার মোহাম্মদ মেসবাজ উদ্দিন বলেন, 'যে হারে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়াচ্ছে, তাতে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় কমছে, অন্যদিকে ক্রমাগত কর বাড়ানোর কারণে পণ্যমূল্যও বাড়ছে। ফলে আমাদের বিক্রিও কমতির দিকে।'
তবে নতুন করে কর বাড়ালে তা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে এবং বাজার আরও সংকুচিত হবে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, গত দুই বছর ধরে ইলেক্ট্রনিকস পণ্যের ভ্যাট হার বাড়িয়ে বর্তমানে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে। আগামী বাজেটে এ হার ১৫ শতাংশ করার আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই করহারও দ্বিগুণ করার আলোচনা হচ্ছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের এক আদেশ অনুযায়ী মোটরসাইকেল, এসি, রেফ্রিজারেটর ও কম্প্রেশর উৎপাদনকারী কোম্পানির করহার ছিল ৫ শতাংশ। পরে ২০২১ এক আদেশে তা ১০ শতাংশ করা হয়, যা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বলবত থাকার কথা।
বর্তমানে কর্পোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে ২৭.৫ শতাংশ।
গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে এনবিআরকে আগের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চলতি অর্থবছরে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকা আদায়ের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এরপর এই অর্থ আদায়ে নতুন করে ঢালাওভাবে ভ্যাট-কর বাড়ানোর পথে হাঁটতে শুরু করে এনবিআর।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে চার ধরনের পণ্যের কর বাড়ানো হলে বছরে বাড়তি ১ হাজার কোটি টাকা আদায় হতে পারে।
কর সুবিধা বিবেচনায় বিনিয়োগ এসেছে
দেশে রেফ্রিজারেটর ও এসির কম্প্রেশর উৎপাদন করে ওয়ালটন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি রেফ্রিজারেটর বাজারেও শীর্ষস্থানীয়, এসিও তৈরি করছে।
ওয়ালটনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'হাইটেক পার্কে শিল্প হিসেবে আমাদের কর অব্যাহতি রয়েছে। কিন্তু আমাদের ওপর যদি করহার বাড়ানো হয়, তাহলে তা শিল্পের জন্য বিপর্যয়কর হবে।'
দেশের মোটরসাইকেল খাতে নতুন করে হোন্ডা, টিভিএস, হিরো ও রানার- এ চারটি কোম্পানি উৎপাদন শুরু করেছে, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগও আছে।
রানারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, 'মূলত ভ্যাট, ট্যাক্সের দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা বিবেচনায় নতুন বিনিয়োগ এসেছিল।'
দেশে গত দুই বছরে সিঙ্গার, সনি র্যাংগসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন বিনিয়োগ নিয়ে এসেছিল।
ফেয়ার ইলেক্ট্রনিকসের মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেন, 'একটি স্থানীয় ফ্রিজের দাম ৩০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৩৬ হাজার টাকা হয়ে গেছে। নতুন করে কর বাড়লে এই দাম আরও বাড়বে। কিন্তু এই সময়ে মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় ইনকাম বাড়েনি।'
তিনি বলেন, 'মূল্যস্ফীতি বাড়লে মানুষ আগে খাবারের জন্য খরচ করবে, এরপর ইলেক্ট্রনিকস পণ্যের জন্য।
বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে
২০৩২ সাল পর্যন্ত দেওয়া কর সুবিধা ২০২৫ সালে এসে বাতিল করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন কর বিশেষজ্ঞ ও স্নেহাশিস মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউটেন্টের ম্যানেজিং পার্টনার স্নেহাশিস বড়ুয়া।
স্নেহাশিস বলেন, 'কম করহারের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়েই অনেক স্থানীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তা বিনিয়োগে এসেছেন। এখন অর্থবছরের মাঝে এসে হঠাৎ করহার বাড়িয়ে দিলে পলিসি ইনকন্সিটেন্সির বিষয়টি ফের সামনে আসবে। এভাবে পলিসির পরিবর্তনে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হন।'
সাবেক এনবিআর সদস্য সৈয়দ মো. আমিনুল করিম বলেন, 'রাজস্ব ঘাটতির কারণে আইএমএফের পরামর্শে এনবিআর হয়তো ঢালাওভাবে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তবে কোনো প্ল্যান ছাড়া হঠাৎ করে কর বাড়ালে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হন।'
তিনি আরও বলেন, 'কর বাড়ানোর পর বিনিয়োগের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য বাধাগুলো- বিশেষত বন্দর, কাস্টমসসহ লজিস্টিকস ক্ষেত্রে- দক্ষতা বৃদ্ধি, স্পিড মানি বন্ধ করার মতো ব্যবসার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা গেলে হয়তো এ ক্ষতি পোষানো সম্ভব হবে।'
সূত্র:দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডস।