ছাতক গ্যাস ফিল্ডের রায় পেয়েও হাত গুটিয়ে বাপেক্স
ছাতক গ্যাস ফিল্ড সংক্রান্ত মামলার রায় হওয়ার পরও হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। প্রাইস অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর গ্যাস ফিল্ডটি নিয়ে কাজ শুরুর কথা জানিয়েছেন বাপেক্স ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শোয়েব।
তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, প্রাইস অ্যাওয়ার্ড না পাওয়া পর্যন্ত কাজ করলে আইনগত জটিলতা তৈরি হতে পারে। আমাদের আইনজীবী সে রকম পরামর্শ দিয়েছেন, তাই আপাতত সেখানে কোনো কাজ করা যাচ্ছে না।
বাপেক্স সূত্র জানিয়েছে, লন্ডনে বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তিসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত (ইকসিড) থেকে চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথমার্ধের মধ্যেই অ্যাওয়ার্ড সংক্রান্ত আদেশ পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করেছে।
পেট্রোবাংলা পরিচালক (পরিকল্পনা) আব্দুল মান্নান পাটোয়ারীও বাপেক্স এমডির সুরে কথা বলেছেন। তিনিও বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, চূড়ান্ত রায় না পাওয়া পর্যন্ত এটা নিয়ে কোনো কাজ করা ঠিক হবে না।
ছাতকে গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৫৯ সালে। পরের বছর গ্যাসক্ষেত্রটিতে প্রথম কূপ খনন করে ১০৯০ মিটার থেকে ১৯৭৫ মিটারের মধ্যে নয়টি গ্যাস স্তর আবিষ্কার করা হয়। সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন করে ছাতক সিমেন্ট ও পেপার মিলে সরবরাহ করা হতো। ২৬ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়, একপর্যায়ে এসে পানি আসতে শুরু করায় কূপটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ২০০৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্যাসক্ষেত্রটি উন্নয়নে কানাডিয়ান কোম্পানির নাইকোর সঙ্গে চুক্তি করা হয়। গ্যাসক্ষেত্রে অনুসন্ধান কূপ খননকালে ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন দুই দফা মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে একটি স্তরের গ্যাস পুড়ে যাওয়ার ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
বিস্ফোরণের ঘটনায় নাইকোর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পেট্রোবাংলা। হাইকোর্ট বাংলাদেশে থাকা নাইকোর সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের আদেশ দেয়। এরপর সুপ্রিম কোর্টে যায় নাইকো, সেখানেও বাংলাদেশের পক্ষে রায় হয়।
সুপ্রিম কোর্টে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে (ইকসিড) যায় নাইকো। গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণের ঘটনায় তারা দায়ী নয় মর্মে ঘোষণা চেয়ে সালিসি মোকদ্দমা দায়ের করে। অন্যদিকে ২০১৬ সালে বাপেক্স আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এতে নাইকোর কাছে বাপেক্স ১১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশ সরকার ৮৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে ইকসিডে নালিশ করা হয়। ইকসিড ট্রাইব্যুনাল বিস্ফোরণের জন্য যৌথ উদ্যোগ চুক্তির অধীন শর্তসমূহ ভঙ্গের জন্য নাইকোকে অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন।
নাইকোকে অভিযুক্ত করে ওই ঘটনা থেকে সরাসরি উদ্ভূত যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতির জন্য বাপেক্সকে ক্ষতিপূরণ দিতে ট্রাইব্যুনাল আদেশ প্রদান করে। সেই সঙ্গে এ ঘটনায় ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে নির্গত গ্যাসের জন্যও বাপেক্সকে ক্ষতিপূরণ দিতে নাইকোর প্রতি ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ প্রদান করেন। পরিবেশসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ইকসিডে উত্থাপনের র্নিদেশ প্রদান করা হয়। সেই ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে (প্রাইস অ্যাওয়ার্ড) যে কোন দিনে আদেশ আসতে পারে।
সম্ভাবনাময় এই গ্যাস ফিল্ডটি ফাটল থাকলেও ছাতক পূর্ব ও ছাতক পশ্চিম (টেংরাটিলা) নামে বিভক্ত। অগ্নিকাণ্ডে ছাতক পশ্চিমের একটি স্তুরের গ্যাস পুড়ে যায়, অন্যান্য স্তর এবং ছাতক পূর্বের মজুদ বিদ্যমান। সম্ভাব্য মজুদ ২ থেকে ৫ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) বিবেচনা করা হয়। সেখানে গ্যাস পাওয়া গেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরবরাহ করা সম্ভব।
বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ধরেই নিলাম ফিল্ডে গিয়ে কাজ করতে গেলে আইনগত জটিলতা হতে পারে। কিন্তু ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) প্রস্তুত করতে বাধা কোথায়। ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় লেগে যায় পেপার ওয়ার্কে, সেই কাজটুকু এগিয়ে রাখতে বাধা থাকার কথা না। আসলে কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে চায় না। গ্যাসের এই মহাসংকটকালে গ্যাস ফিল্ড এভাবে ফেলে রাখা উচিৎ হচ্ছে না। ফিল্ডটি নিয়ে দ্রুত কাজ শুরু করা উচিত।
দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর মজুদ ফুরিয়ে আসছে, এতে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে উৎপাদন। এক সময় দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেতো এখন ১৯৩২ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। সরবরাহ বাড়াতে দুটি এফএসআরইউ দিয়ে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে।
পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, দেশে ৮টি গ্রাহক শ্রেণিতে অনুমোদিত লোডের পরিমাণ রয়েছে ৫ হাজার ৩৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট (দৈনিক)। এর বিপরীতে চাহিদা ৩৮০০ থেকে ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে, আর ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ১ ২০০ মিলিয়নের মতো। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড়ে ২ হাজার ৪৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড থেকে ১ টাকা দরে, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি থেকে ১.২৫ টাকা দরে, বাপেক্স থেকে ৪ টাকা দরে প্রতি ঘনফুট গ্যাস কেনা হয়। এরপর বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ ও টাল্লোর কাছ থেকে কেনা গ্যাসের সংমিশ্রণে গড় দর দাঁড়ায় ৬.০৭ টাকা ঘনমিটার। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪০০ মিলিয়নের (দৈনিক) মতো আমদানির পর গড় মূল্য দাড়িয়েছে ২৪.৩৮ টাকা।
দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও ঘাটতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। শিল্প এবং ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম প্রায় ১৫২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। যথাযথ পরিকল্পনা নেওয়া গেলে দেশীয় উৎস থেকে আরও উৎপাদন বাড়ানো যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদনে ঢিলেমির কারণে আজকের এই পরিণতি বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।