আওয়ামী লীগ সরকারের আমলাতন্ত্রের পথেই হাঁটছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। নানান মারপ্যাঁচ দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা নিজের হাতেই রাখার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করে কালক্ষেপণ করার কৌশল নিয়েছে। ৬ মাস পার হলেও জ্বালানি তেলের প্রবিধান ঝুঁলিয়ে রেখে দিয়েছে, যেভাবে আওয়ামী লীগ সরকার ঝুঁলিয়ে রেখেছিল। এতে করে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইনে সব ধরনের জ্বালানির দর নির্ধারণের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠানটির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। ৩৪ (৩) ধারায় বলা হয়েছে বিইআরসি প্রবিধানমালা প্রণয়ন করবে। তবে শর্ত থাকে যে, প্রবিধানমালা প্রণয়ন না করা পর্যন্ত সরকার প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারণ করতে পারবে। দীর্ঘ এক যুগ নানা কায়দায় প্রবিধান ঝুলিয়ে রেখে নির্বাহী আদেশে নির্ধারণ করা হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও একই পথে চলায় অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক সদস্য মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ৬ মাসেও কেন প্রবিধানমালা অনুমোদন হলো না সেটা খুবই অবাক করার বিষয়।
বিইআরসিকে কার্যকর করলেই সব থেকে বড় সংস্কার হয়ে যাবে। বিইআরসি শক্তিশালী হলে অনেক দুর্নীতি-অনিয়ম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
২০০৩ সালে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন পাশের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও আধাবিচারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিইআরসি গঠন করা হয়। বিইআরসি মূলত ২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এ পর্যন্ত ১৩টি প্রবিধানমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আরও ১২টি প্রবিধানমালা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে রেখেছে মন্ত্রণালয়।
আইনে সব ধরনের জ্বালানির দাম নির্ধারণের এখতিয়ার দেওয়া হলেও প্রবিধানমালা ঝুলে থাকায় শুধুমাত্র গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করে আসছিল বিইআরসি। ২০২৩ সালে হঠাৎ করেই আইন সংশোধন করে নির্বাহী আদেশে দাম সমন্বয় (কম/বেশি) করার বিধান যুক্ত করা হয়। তারপর থেকে নির্বাহী আদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করায় কার্যত বেকার হয়ে পড়ে রেগুলেটরি কমিশন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথম সপ্তাহেই ঘোষণা দেয় নির্বাহী আদেশে আর বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হবে না। সে অনুযায়ী আইনে সংশোধনী এনে বিইআরসির হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু জ্বালানি তেলের বিষয়টি বিগত সরকারের মতো হাতেই রেখে দিয়েছে। আগের মতোই পেট্রোলিয়ামের বিধিমালা অনুমোদন না হওয়ায় ধুয়া তুলে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। গত মাসেও ডিজেল, পেট্রোল, অকটেনের দাম সমন্বয় করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা বিইআরসিকে ভবিষ্যতে শক্তিশালী ও কার্যকর দেখতে চাই। এখন পর্যন্ত বিইআরসি ইস্যুতে সরকারের অবস্থান আমাদের কাছে খুব একটা পরিস্কার নয়। আগের সরকারের পথ ধরেই তারাও জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করছে। আগের সরকারের সুরেই কথা বলছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করছি, প্রয়োজন হলে যেভাবে এলপিজির দর (রিট দায়েরের মাধ্যমে) ঘোষণার আদেশ আদায় করে নিয়েছি। জ্বালানি তেল প্রশ্নে সেই পথে হাঁটতে পিছপা হবে না ক্যাব।
বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমি যোগদানের আগে থেকেই প্রবিধানমালা মন্ত্রণালয়ে জমা রয়েছে। আমি যোগদানের পর এগুলো অনুমোদনের বিষয়ে জোর দিচ্ছি। তবে জ্বালানি তেলের পৃথক তিনটি প্রবিধানমালা (বিতরণ, সঞ্চালন ও খুচরা বিক্রয়) না করে একত্রে করার বিষয়টি সামনে এসেছে। আমরা ৩টি একত্রে করে পাঠিয়ে দিয়েছি। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন হঠাৎ করে দাম বেড়ে গেলে ভোক্তা সেই দাম বহন করতে পারবে কিনা। আমি জ্বালানি উপদেষ্টাকে অবহিত করেছি, বিইআরসি দাম নির্ধারণ করলেও প্রয়োজনে ভর্তুকি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে বিইআরসি আইন অনুযায়ী। এ বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ দেখছি না।
বিইআরসির সাবেক সদস্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবু ফারুক বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বিইআরসিকে কার্যকর করা গেলে জ্বালানি খাতের অর্ধেক সংস্কার হয়ে যাবে। আইন অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা দেওয়া গেলে অনেক দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। ভারতসহ অনেক দেশে কোন চুক্তি করতে হলে রেগুলেটরি কমিশনের অনুমোদন নিতে হয়। আমাদের দেশেও যদি করা যায়, তাহলে তারা (বিইআরসি) দেখবে সেটির (প্রকল্প) আদৌ প্রয়োজন কি-না, আবার দর যৌক্তিক কি-না? দেশীয় স্বার্থ থাকলে তারা অনুমোদন দেবে। এতে ম্যাক্রো লেভেলে হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
বিইআরসি গণশুনানির মাধ্যমে দাম চূড়ান্ত করায় ইউটিলিটিগুলোর নানা রকম অসঙ্গতি সামনে আসতো। এতে করে তাদের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়, দিনে দিনে একটি কালচারে পরিণত হতে যাচ্ছিল। সেই প্রক্রিয়াকে গলাটিপে হত্যা করে আওয়ামী লীগ সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (২৭ আগস্ট) নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের আইন বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের একক ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে বিইআরসি। কিন্তু বিধিমালা না থাকায় জ্বালানি তেলের দাম এখনও নির্বাহী আদেশে নির্ধারিত হয়ে আসছে। এ কারণে অনেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিপিসি নিজে তেল আমদানি করে, আবার কোম্পানি ও ডিলারের মাধ্যমে বিপণন করে। তারাই যদি দাম নির্ধারণ করে তাহলে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব না। দ্বৈত স্বত্বা হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে বিপিসি। হয় তারা রেগুলেট করবে, না হলে তারা বিপণন করবে। এখন যা হচ্ছে সম্পর্ণ আইনের পরিপন্থী।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা বিধিমালা নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে, আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে করতে পারবো।