অর্থ পাচার রোধে বিএফআইইউ’র নতুন নীতিমালা

  • সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচারকে উচ্চ ঝুঁকি বিবেচনার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। পাশাপাশি পাচারকৃত অর্থ চিহ্নিত করতে কৌশলগত বিশ্লেষণের জন্য একজন উপ-মহাব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বুধবার (১১ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার প্রতিরোধে প্রতিটি ব্যাংকের করণীয় বিষয়ে গাইডলাইন তৈরি, বৈদেশিক বাণিজ্যের কাজে নিয়োজিত সকল ব্যাংক কর্মকর্তাকে বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং বিষয়ক প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা, বিদেশে অর্থ পাচারের মামলা তদন্তে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।

জানা যায়, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার বা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগের আওতায় গতকাল মঙ্গলবার গাইডলাইন্স জারি করেছে মানিলন্ডারিং, সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে কার্যরত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিএফআইইউ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ফোকাস গ্রুপ গাইডলাইন্স এর খসড়া প্রণয়ন করে। পরবর্তীতে বিএফআইইউ গাইডলাইন্স জারির পূর্বে সকলের মতামতের জন্য গাইডলাইন্স ওয়েবসাইটে সকলের মতামতের জন্য প্রকাশ করে। সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারের সাথে আলোচনা এবং প্রাপ্ত মতামত পর্যালোচনা করে গতকাল চূড়ান্ত গাইডলাইন্স সম্বলিত সার্কুলার জারি করা হয়। সার্কুলার অনুযায়ী বিএফআইইউ এর গাইডলাইন্স এর আলোকে প্রতিটি ব্যাংক বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে নিজস্ব গাইডলাইন্স প্রস্তুত করে ২০২০ সালের ১০ মার্চের মধ্যে বিএফআইইউ-এ দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১ জুন থেকে এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে বলেও জানানো হয় ওই প্রজ্ঞাপনে।

বিজ্ঞাপন

উল্লেখ্য, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পাচারকৃত অর্থের বেশীরভাগ অর্থাৎ, ৮০ শতাংশেরও বেশী বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন ও সংবাদ মাধ্যমেও বাংলাদেশ হতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশী মানিলন্ডারিং বা অর্থ পাচার হচ্ছে। এছাড়াও বিএফআইইউ, দুদক ও সিআইডি’র যৌথ উদ্যোগে প্রণীত ‘বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন ঝুঁকি নিরূপণ প্রতিবেদন’ এ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং ও বিদেশে অর্থ পাচারকে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) কর্তৃক অর্থ পাচার বিষয়ক গত ২৯ জানুয়ারি (২০১৯) তারিখে প্রকাশিত ‘Illicit financial flows to and from 148 developing countries: 2006-2015’ প্রতিবেদন অনুযায়ী ট্রেড মিসইনভয়েসিং এর মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ বাইরে চলে গেছে এমন প্রথম ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম। একইভাবে সেই রিপোর্টে ট্রেড মিসইনভয়েসিং এর মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ দেশে প্রবেশ করেছে এমন প্রথম ৫০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে।

উল্লেখ্য, মানিলন্ডারিং কিংবা পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যাংক ও অন্যান্য বিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থা হতে প্রেরিত সন্দেহজনক লেনদেন পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ শেষে নির্ধারিত তদন্ত সংস্থায় প্রেরণ করে থাকে। প্রতি অর্থ বছরে প্রকাশিত এবং ওয়েবসাইটে আপলোডকৃত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায়ও দেখা যায় ইউনিট কর্তৃক তদন্ত সংস্থায় যতগুলো কেস প্রেরণ করা হয় তার বেশির ভাগই বাণিজ্য ভিত্তিক মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত।

প্রসঙ্গতঃ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে অর্থ পাচারের হার সবেচেয়ে বেশি। আমদানিযোগ্য পণ্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি করে বিশেষতঃ যে সকল পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক কম যেমন মুলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, কম্পিউটার সামগ্রী ইত্যাদি বা যেসকল পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণ কঠিন সেসকল পণ্য বা সেবা আমদানির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। বিপরীতদিকে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে অবশিষ্ট অর্থ বিদেশে রেখেও অর্থ পাচার ঘটে থাকে। পাশাপাশি আমদানিকৃত পণ্যের বিবরণ পরিবর্তন করে বা কোনো পণ্য আমদানি না করে শুধুমাত্র ডকুমেন্টের বিপরীতে মূল্য পরিশোধ করেও অর্থ পাচার হয়ে থাকে। তা ছাড়া, একই পণ্য বা সেবার একাধিক চালান ইস্যুকরণ, ঘোষণার তুলনায় পণ্য বা সেবা বেশি বা কম জাহাজীকরণের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়ে থাকে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধিকাংশই ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কর্তৃক এ ইউনিটকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। এছাড়া, মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভার সভাপতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব অর্থ পাচারের পূর্বেই তা চিহ্নিতকরণ এবং পাচার রোধে সম্ভাব্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিএফআইইউ-কে নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

সার্বিক প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে অন্যান্য উদ্যোগের পাশাপাশি গতকাল বিএফআইইউ কর্তৃক এ গাইডলাইন্স জারি করা হয়। চীন কিংবা ভারতের মতো দেশগুলো থেকে অর্থপাচার বেশি হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশই বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের জন্য বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে Prevention of Trade Based Money Laundering গাইডলাইন্স জারি করলো।