অস্থির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ফলের বাজার
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি ফলের বাজারও অস্থির হয়ে উঠেছে। প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিবেদনে এই তথ্য বাণিজ্য মন্ত্রনালয়কে জানানো হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিত্য পণ্যের বেশিরভাগই আমদানি করা হয় চীন থেকে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দেশটির সঙ্গে আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে। ফলে চাহিদার তুলনায় মজুদের সংকট দেখা গিয়েছে। এ অজুহাতে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে নগরীর ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার। দিন যতই যাচ্ছে অস্থিরতা আরও বাড়ছে।
কাওরান বাজার কিচেন মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি, ঢাকা। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, চীন থেকে আমদানি বন্ধের কারণে বাজারে মাখন, কনডেন্সড মিল্ক, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট নুডলস, চিপস, পিকলড ফ্রুটস, জ্যাম ডেলি, বোতলজাত ফলের রস, সস, টমেটো পেস্ট, ফার্মেন্টড ভিনেগার, ফরটিফায়েড এডিবল রাইস ব্র্যান অয়েলে ইত্যাদির সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে।
শ্যামবাজার বণিক সমিতি বলছে, প্রতি মাসে চীন থেকে পেঁয়াজ, আদা, রসুনের আমদানির পরিমাণ আনুমানিক ৫০০ কন্টেইনার। কন্টেইনারের মূল্য আনুমানিক ৩৫ লাখ টাকা। ভাইরাসের কারণে চীন থেকে আমদানি বন্ধ। তবে আদা ও রসুন ভারত থেকে আমদানি হওয়ায় দেশীয় বাজারে এর প্রভাব কম পড়বে বলে মনে করছে সংগঠনটি।
প্রতিবেদনে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে বলা হয়, চীনে করোনাভাইরাসের অজুহাতে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে নগরীর ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে আদা, রসুন ও পেঁয়াজের দাম।
পেঁয়াজ: ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার পর দেশের বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে মিয়ানমার ও চীনের ওপর। কিছুদিন আগেও মিয়ানমার ও চীন থেকে পেঁয়াজ এনে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে বাজারে চীনের পেঁয়াজ সরবরাহ এক প্রকার বন্ধই রয়েছে। এতে প্রভাব পড়েছে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের দামেও। গত সপ্তাহে মিয়ানমারের প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল যা এখন বেড়ে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রসুন: নিত্যপণ্যের মধ্যে রসুনের দাম নিয়মিতভাবে বাড়ছে। আমদানি করা রসুন কিনতে হচ্ছে ২২০ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশি রসুনের দাম বেড়েছে ১৯১.৬৭ শতাংশ। আর আমদানি করা রসুনের মূল্য বেড়েছে ১৬০ শতাংশ। তবে গত এক মাসের ব্যবধানে আমদানি করা রসুনের দাম বেড়েছে ৮৮.৮৮ শতাংশ। খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, গত বছর যে রসুন ৫০ টাকা কেজিতে পাওয়া যেত এখন সেই রসুন প্রতি কেজি ২০০-২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহেও আমদানি করা রসুন প্রতি কেজি ২২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের মতে, রসুনের কোনো বিকল্প বাজারে না থাকায় দাম ঊর্ধ্বমুখী। ট্যারিফ কমিশনের হিসেবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রসুন উৎপাদিত হয়েছে ৬ লাখ ১৩ হাজার টন। সেখান থেকে পচে যাওয়া রসুন বাদ দিয়ে প্রকৃত উৎপাদন ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২২ হাজার টন। তবে বিবিএসের হিসাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রসুনের উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৬৬ হাজার টন।
আদা: এক সপ্তাহের ব্যবধানে চীনা আদার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। সপ্তাহ আগে চীনা আদার দাম ছিল ১০০ টাকা যা ৫০ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়।
আমদানি সমস্যা
পাইকারি ব্যবসায়ীদের মতো দেশে আমদানিকৃত রসুনের ৯৬ শতাংশই আসে চীন থেকে। করোনা ভাইরাসের কারণে প্রায় এক মাস ধরে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ থাকায় সেখান থেকে রসুন আসছে না। বিকল্প হিসেবে বর্তমানে ভারত ও মিয়ানমার থেকে অল্প পরিমাণ রসুন আমদানি হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ছয় মাসে মোট ৫২ হাজার ৪৬১ টন রসুন আমদানি হয়েছে।
বিগত ২০ জানুয়ারির পর থেকে কোনো আদা-রসুন শিপমেন্ট দিচ্ছে না। ফলে পুরানো শিপমেন্টের পণ্য এখন বাজারে আসছে। নতুন করে চীন থেকে রসুন আসে তা পৌঁছাবে মার্চের শেষ সপ্তাহে। এর মাঝে যে ক’দিন গ্যাপ থাকবে তখন বাজারে ঘাটতি দেখা দেবে। তখন আবার নতুন করে দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার পর চীন ও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ এনে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে বাজারে চীনের পেঁয়াজ সরবরাহ একরকম বন্ধই রয়েছে। রয়েছে আদা-রসুনও। করোনাভাইরাসের কারণে আমদানিকারকরা এই ৩টি পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে নতুন করে তৈরি হয়েছে সংকট। যার প্রভাব পড়েছে পণ্য ৩টির দামে। যারা আগে এলসি খুলেছিল তাদের চালানও আসছে না। নতুন করে কেউ এলসিও খুলতে পারছে না। সব মিলিয়ে বাজারে একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই) বলছেন, চীন থেকে বাংলাদেশ মূলত আদা, রসুন ও দারুচিনিসহ কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানি করে। এ বছর অবশ্য চীনের পেঁয়াজ বাংলাদেশে এসেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী সমুদ্রপথে আমদানি হওয়া রসুনের পুরোটাই চীন থেকে আসে। আর আমদানি হওয়া আদার ৬০ শতাংশ এবং দারুচিনির ৬৭ শতাংশ আসে চীন থেকে।
গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৬৪ হাজার ৭৯৬ টন রসুন আমদানি হয়েছে।এবারও চীনের নববর্ষের ছুটি শুরুর আগেই ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ রসুন ও আদা আমদানি করেছেন। এরমধ্যে ডিসেম্বর মাসেই সাড়ে ১৮ হাজার টন রসুন আমদানি হয়। চীনে নববর্ষের আগে যেসব পণ্য আমদানির প্রক্রিয়া শেষ হয়েছিল, এখনো চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সেসব পণ্য আসছে। ফলে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের বাজারে এখন পর্যন্ত কোনো পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়ার কারণ নেই।
ফলের বাজার নিয়ে বাংলাদেশ ফ্রেশ, ফ্রুটস ইম্পোটার্স এসোসিয়েশন বলছে, রাজধানীর ফলের পাইকারি বাজারগুলোতে আপেল, কমলা, নাশপাতি, আঙ্গুরসহ আমদানিকৃত প্রায় সব ধরনের ফলের সরবরাহ কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে দামেও। খুচরা বাজারে ফল ভেদে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।