হোমল্যান্ডে বিমা করে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

একটি ছাত্রাবাসে রান্না করেন শাবানা বেগম। হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সে একটি বিমা করেছিলেন, খেয়ে না খেয়ে মাসে ১৩৫০ টাকা করে কিস্তি দিতেন।

আরও কয়েকজনের সঙ্গে তারও বাসা থেকেই কিস্তি নিয়ে যেতেন বিমা কর্মী ফরিদ হোসেন। ২৭ মাস নিয়মিত কিস্তি দেওয়ার পর হঠাৎ ফরিদ হোসেন আসা বন্ধ করে দেন। শেষ দিনে কিস্তি নিতে এসে প্রয়োজনীয়তার কথা বলে বিমার দলিলও নিয়ে যান ফরিদ হোসেন।

বিজ্ঞাপন

শাবানা বেগম ভেবেছিলেন ফরিদ চলে আসবেন। এভাবে বেশ কয়েক মাস কেটে যায়। এভাবে অপেক্ষার পর পুরো বিমার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে জমানো টাকার জন্য কোম্পানির দ্বারস্থ হন তিনি। কিন্তু বিমা শুরুর সময় যতটা আন্তরিকতা ও অনুনয় বিনুনয় করে বিমা করিয়েছিলেন এখন কোম্পানির চরিত্র পুরোই বিপরীত।

অফিস থেকে তাকে বলা হয়, বিমার দলিল ছাড়া কোনো কিছুই করা সম্ভব না। ডুপ্লিকেট বিমার দলিল পেতে গেলে থানায় জিডি করতে হবে, ৩শ’ টাকার স্ট্যাম্প নিয়ে আসতে হবে। করোনার কারণে এখন তার মেসের কাজ বন্ধ, পেটের ভাত জোটাতে পারছেন না। এ অবস্থায় জিডিই বা করবেন কীভাবে আর স্ট্যাম্পই বা কিনবেন কি দিয়ে।

বিজ্ঞাপন

আবার যখন জানলেন, মাত্র ১১ মাসের টাকা জমা হয়েছে। তখন যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল তার মাথায়। শাবানা বেগমের দাবি, তার কাছে কোম্পানির জমার রসিদ আছে। হোমল্যান্ড কোম্পানির সাফ কথা, এ রসিদ পাকা রসিদ না। পাকা রসিদ ছাড়া কোম্পানি দায় নেবে না। আপনি যাকে টাকা দিয়েছেন, তার কাছে যান। শাবানা বেগম বারবার জমা রসিদগুলো দেখালেও কোম্পানি একই কথা বলে গেল। শাবানা যুক্তি দেন, আপনার অফিসারই তো টাকা নিয়ে রসিদ দিয়েছেন। তাহলে জমা না হলে দায় কে নেবে?

কিন্তু কোনো লাভ হলো না। শেষে আক্ষেপ করে বললেন, আমার মতো গরিবের টাকাও মারতে বাধলো না বিমা কোম্পানির। আল্লাহ ওদের বিচার করুক।

শাবানা বেগম বার্তা২৪.কমকে জানান, তারা থাকেন পল্লবী ৭ নম্বর সেকশনে। ওই এলাকায় আরও কয়েকজন একসঙ্গে ফরিদ মিয়ার কাছে বিমা করেছিলেন। স্বপ্ন ছিল বিমার টাকা তুলে মেয়ের বিয়ে দেবেন। কিন্তু তার সব স্বপ্নেই এখন গুড়েবালি। তার কাছে টাকা জমার রসিদ রয়েছে, বস্তিতে আগুন লাগলে অন্যদের সবকিছু পুড়ে গেছে। তারা বিমার টাকার আশা ছেড়েই দিয়েছেন।

খুঁজলে সারা দেশে শাবানা বেগমের মতো লাখ লাখ ভুক্তভোগী পাওয়া যাবে। যারা বিশ্বাস করে বিমা কর্মীর হাতে দিনের পর দিন টাকা দিয়ে গেছেন। প্রায় সবার অভিজ্ঞতা কমবেশি এক রকমই। মাঝামাঝি কিংবা শেষ দিকে এসে আদায়কারী উধাও হয়ে গেছেন। অফিসে গেলে জানতে পেরেছেন, সামান্য পরিমাণই টাকা জমা হয়েছে। বিমা কোম্পানিগুলো এর কোনো দায় নিচ্ছে না।

সরোয়ার হোসেন নামে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের আরেক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, শুধু মাঠকর্মী নয়, তিনি দু’দফা বিমা কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ে পে-অর্ডার ও চেক মারফত টাকা জমা দিতে গিয়েছিলেন। তখন তাকে যে রসিদ দেওয়া হয়েছে, সেটিও প্রাথমিক রসিদ। নিচে লেখা ছিল পাকা- রসিদ ছাড়া কোম্পানি কোনো রকম দায়ভার গ্রহণ করবে না। তাকে বলা হয়েছিল, যথা সময়ে পাকা রসিদ বাড়িতে পৌঁছে যাবে। কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও তার ঠিকানায় কোনো রসিদ আসেনি। এখন দেখার বিষয়, বিমার মেয়াদ শেষ হলে কি বলে।

বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহক সংগ্রহের জন্য সারা দেশে গ্রামের হাটবাজারে হাজার হাজার কমিশন এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছে। বেকার তরুণ-তরুণীরা সাইনবোর্ড টানিয়ে দিব্যি তহবিল সংগ্রহ করছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। এ কারণে দিনে দিনে বিমার প্রতি মানুষ আস্থা হারাচ্ছে।

গ্রাম পর্যায়ে অফিস খোলার তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে হোমল্যান্ড, ডেল্টালাইফ ইন্স্যুরেন্স, ফারইস্ট ও ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কমবেশি প্রায় সব কোম্পানির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ রয়েছে। কমিশন ভিত্তিক কাজ করা এসব মাঠকর্মীদের দায় নিচ্ছে না বিমাগুলো।

আস্থা সংকটের কারণে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স অনেকদিন ধরে গ্রোথ ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণ গ্রাহকদের মেয়াদ পূর্তিতে যথা সময়ে টাকা না দেওয়া নিত্য নৈম্যক্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইদানিং বোনাসও ঠিক সময়ে দিতে পারছে না। গ্রাহকরা গেলেও লম্বা সময় পর তারিখ ফেলা হচ্ছে।

হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আজিজুল ইসলাম তালুকদার বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমার কাছে এ রকম কোনো তথ্য নেই। যদি কোনো এজেন্ট কিংবা অফিস কর্মকর্তা পলিসির টাকা নিয়ে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সাবেক সদস্য বোরহান উদ্দিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, এটা আইন বিরোধী, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি। এ ধরনের কিছু লোকের কারণে বিমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হচ্ছে।

আইডিআরএ'র চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, এ রকম ঘটনা দুঃখজনক। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।