ভিউ সর্বস্ব নির্ভর সময়ে আশফাক নিপুনের নাটকে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ নেই কেন?
ঈদুল আযহার অসংখ্য নাটকের ভিড়ে সর্বাধিক প্রশংসিত ও আলোচিত টেলিফিল্ম ‘ভিকটিম’ ও ‘ইতি, মা’। টেলিফিল্ম দুইটি রচনা ও নির্মাণ করেছেন দর্শক নন্দিত নির্মাতা আশফাক নিপুন। ঈদ নাটকে আলোচনার শীর্ষে থাকা এই নির্মাতা সম্প্রতি বার্তা২৪.কমের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন। আজ প্রথম পর্বে থাকছে ঈদ নাটক ও ইউটিউব ভিউ প্রসঙ্গ। আশফাক নিপুনকে ফোনে ধরেছেন ইসমাইল উদ্দীন সাকিব।
বার্তা২৪.কম: ‘ভিকটিম’ খোঁজার দায়িত্ব নিলেন কেন?
আশফাক নিপুন: ‘ভিকটিম’ গল্পটা বানানোর কথা গত বছর। ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলন কেন্দ্র করে একটা গল্প করার পরিকল্পনা ছিল। যেসব ইস্যু সেনসিটিভ, চলমান এবং ঝুঁকিপূর্ণ; যেগুলো নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না, সাহস পায় না ওসব কাজ আমি বেশি করি। কারণ আমি মনে করি আমার হাতে থাকা শক্তিশালী ভিজুয়াল মাধ্যমে কথাগুলো বলা দরকার। মেয়েদের বিরুদ্ধে সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট কিন্তু বছর বছর ধরে চলে আসছে। কাজের মধ্যে, পরিবারের মধ্যে, রাস্তাঘাটে সব জায়গায় সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট হয়। এটি এমন একটা বিষয় যেটা নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না। এই টপিকটা গত বছর ট্রেন্ডিং থাকায় আমার মনে হলো এটা নিয়ে আরেকটু গবেষণা করে কাজ না করলে ভুল হবে। তখন অপি আর নিশো দুইজনেরই শিডিউল নেওয়া ছিল। ৩ দিনে আমি স্ক্রিপ্টটা লিখেও ছিলাম। কিছুদূর স্ক্রিপ্ট লিখে আবার রেখে দিলাম। এরপর আমি ‘মিস শিউলী’ বানালাম অপি করিম আর নিশোকে নিয়েই। অপি আর নিশোর প্রথম কাজ হওয়ার কথা ছিল ভিকটিম, হয়ে গেল ‘মিস শিউলী’। ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলন এখন থেমে গেছে কিন্তু সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট এখনো আছে সব জায়গায়। তখন আমি চিন্তা করলাম এটা নিয়ে কাজ করা দরকার। তবে এই পুরো বিষয়টা আসলে খুব জটিল। আমাদের সমাজে সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্টকে দুইভাবে দেখা হয়। একটা হচ্ছে সত্যি সত্যি কোনো একটা হ্যারেজমেন্ট হয়েছে যেটা বস তার সাব-অর্ডিনেটের সাথে করে। আবার অনেক সময় শোনা যায় বসের সাথে একান্ত সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট করে থাকে মেয়েটাই। হ্যারাজমেন্টের আবার বিভিন্ন স্তর আছে। সাদা চোখে এটি ধর্ষণের মতো না। মেডিক্যাল টেস্ট করালে বুঝা যায় ধর্ষণ হয়েছে কি হয়নি। কিন্তু সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট প্রমাণ করা খুব কঠিন। ঐ চ্যালেঞ্জ থেকে ইচ্ছা ছিল এটা নিয়ে কাজ করার। তবে এক বছর পর এটা নিয়ে কাজ করার সুবিধা হলো নানান দৃষ্টিভঙ্গি ধরে কাজটা করতে পেরেছি, নির্মোহ থাকতে পেরেছি। এখন আমার ভিকটিম নাটকটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে মোটামুটি একটা হৈচৈ পড়ে গেছে আসলে দোষী কে আর ভিকটিম কে? এ ধরণের ঘটনা যখন ঘটে তখন অনেকগুলো পক্ষ তৈরি হয়ে যায়। এক পক্ষ ধরে নেয় এ দোষী, আরেক পক্ষ ধরে নেয় ও দোষী। কিন্তু আসল ঘটনাটা কি হতে পারে, সেটা নিয়ে বাহাস তৈরি করার উদ্দেশ্যেই ভিকটিম টেলিফিল্মটা বানিয়েছি আমি।
বার্তা২৪.কম: গল্প এবং কাস্টিং এর ভিন্নতা...
আশফাক নিপুন: আমি সবসময় চিন্তা করি, দর্শক দেখতে বসে যেন একটা গল্পের সাথে আরেকটার কোন মিল না পায়। হয়তো অভিনয় শিল্পী মিলে যাবে। কিন্তু চরিত্রে বৈচিত্র্য থাকবে। আমার দুই টেলিফিল্ম ‘ভিকটিম’ ও ‘ইতি, মা’তে নিশো ছাড়া আর কোনো অভিনয়শিল্পীর মিল নাই। আমার শর্ট ফিল্ম ‘অযান্ত্রিক’ এ আমি অভিনেতা সোলায়মান খোকাকে নিয়েছি, যিনি শিক্ষকের চরিত্র করেছেন। উনি অনেকদিন ধরে টেলিভিশনে নিয়মিত না। বা দেখা যায় ছোটখাটো চরিত্র করছেন। উনাকে আমি প্রধান চরিত্র নিয়েছি। কারণ আমি চেয়েছি নতুন ভাবে উনাকে উপস্থাপন করতে। আমি অপি করিম, ঈশিতাকে নিয়েছি; যারা নিয়মিত কাজ করেন না; কিন্তু নিয়েছি গল্পের, চরিত্রের এবং অভিনয়ের প্রয়োজনে। এবং আমি কখনোই চাইনা গল্পের প্রয়োজনে কোনোরকম ছাড় দিয়ে দর্শকদের ঠকাতে। এদের দুইজনকে নিয়েই কিন্তু এই ঈদে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে প্রশংসা হচ্ছে।
বার্তা২৪.কম: আফরান নিশোকে ঈদের দুই নাটকে কাস্টিং করলেন। নিশো ঠিক কতটা ভিন্ন অন্যদের তুলনায়?
আশফাক নিপুন: আমি প্রধানত যখন যাকে যেই চরিত্রে প্রয়োজন সেই চরিত্রে তাকে কাস্ট করি। আমার কাছে মনে হয়েছে ভিকটিম টেলিফিল্মে ‘রুশোর’ চরিত্র নিশো আগে কখনো করেনি। তাই আমার মনে হয়েছে নিশোকে নিলে চ্যালেঞ্জিং হবে, তার জন্যে এবং আমার জন্যেও। রুশো চরিত্রের উপরই গল্পের গতিপথ নির্ভর করছিল। তাছাড়া নিশোর সাথে আমার কাজের অভিজ্ঞতা খুব ভালো। ওর সাথে কাজ করলে আমি ওকে অন্য ধরণের চরিত্রের যত চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দেই না কেন ও সেটা গ্রহণ করে সাগ্রহে। নিজে প্রচুর হোমওয়ার্ক করে, প্রচুর খাটে। ভিকটিম প্রচার হওয়ার পর ইন্ডাস্ট্রির সবাই ভিকটিমের প্রশংসা করেছে, আমার প্রশংসা করছে, সাথে সাথে সবাই এটাও বলছে যে এটা সম্ভবত নিশোর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা অভিনয়। রুশো চরিত্রটাই শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। আর ইতি মাতে ওকে নেওয়ার কারণ নিশোকে আগে কখনো শুধুমাত্র ভাইবোনের গল্পে দেখা যায়নি। তাও আবার বোনের সাথে যার সম্পর্ক নানান লেয়ারে। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রায়ণে পারদর্শিতার জন্যেই নিশোকে কাস্ট করেছি দুটো কাজেই।
বার্তা২৪.কম: এবারের ঈদের ‘ভিকটিম’, ‘ইতি, মা’ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’র মধ্যে কোনটি নির্মাণে সবচেয়ে বেগ পেতে হয়েছে?
আশফাক নিপুন: তিনটা তিন রকমের। ‘ভিকটিম’ হচ্ছে একটি অত্যন্ত সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে এবং আমি নির্মোহ ভাবে একটা ঘটনার তিনটা পার্স্পেকটিভ তুলে ধরতে চেয়েছি। এবার দর্শকরা ঠিক করুক কে দোষী আর কে ভিকটিম। এধরণের স্ক্রিপ্টকে বলে স্লো বার্ন সাইকোলজিক্যাল ড্রামা। এ ধরণের কাজ লেখা আর বানানো একটু কঠিন। ‘ইতি, মা’ আবার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় শুট করা। কুমিল্লায়, ঢাকায়, এয়ারপোর্টে শুট করেছি। এয়ারপোর্টে অনুমতি পাওয়াও খুব কঠিন আর সময়সাপেক্ষ। ফিজিক্যাল শুটিং অনুযায়ী ‘ইতি, মা’টা একটু কঠিন। ‘অযান্ত্রিক’টা ঈদের চার পাঁচ দিন আগে করা। এটার চ্যালেঞ্জ আবার ভিন্ন। একজন ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ শিক্ষকের গল্প দর্শক কেনো দেখবে। এই ধরনের গল্পে সাধারণ দর্শকের আগ্রহ একটু কম থাকে। কিন্তু প্রচারের পর বেশ ভাল সাড়া পেয়েছি। এটাই আশার কথা।
বার্তা২৪.কম: ভিউ সর্বস্ব নির্ভর সময়ে আশফাক নিপুনের নাটকে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ নেই কেন?
আশফাক নিপুন: দেখেন, একেকটা কাজের দর্শন আর তার দর্শক একেকরকম। প্রতিটা ঘরে আপনি রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ূন আজাদের বই পাবেন না। তৌকির আহমেদ ‘ভিকটিম’ দেখে বলেছেন, ‘তুমি যেকোন দোকানে গেলেই চিপস পাবে। তার মানে এই না যে চিপস যে খুব স্বাস্থ্যসম্মত কোন খাদ্য। আবার স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য তুমি সব দোকানে পাবেও না।’ এটাও ঠিক তেমন। শুধু বাংলাদেশে না, এটা বিশ্বের সব জায়গায় আছে। হলিউডে তথা সারাবিশ্বে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ‘এভেঞ্জারস’ সিনেমা কিন্তু অলটাইম ক্লাসিক ‘রোমা’, ‘শিণ্ডলার্স লিষ্ট’র দর্শকও আছে। আমি জাস্ট উদাহরণ হিসেবে বললাম দর্শক চাহিদার ব্যাপারটা বোঝার জন্য, ওদের মানের সাথে আমাদের তুলনা করছিনা। কথা হচ্ছে আপনি কাদের জন্য বানাচ্ছেন, কি ধরণের গল্প বানাচ্ছেন। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আপনি যদি কোন কন্টেন্ট এক মিনিটও দেখেন ওটার ভিউ কাউন্ট হয়ে যাবে। এক মিনিট দেখে ভালো না লাগলে উঠে গেলেন, কিন্তু ভিউটা ঠিকই যোগ হয়ে গেল। আপনাকে আসলে দেখতে হবে কন্টেন্টের ওয়াচ টাইম। কন্টেন্টটা কত দীর্ঘ সময় ধরে দর্শককে ধরে রাখলো। কিন্তু আমাদের এখানে ওয়াচ টাইমটা বলা হয় না। অনেক মিলিয়ন ভিউ নাটকের ওয়াচ টাইম মাত্র ১২-১৩ শতাংশ। আবার অনেক কম ভিউ নাটকের ওয়াচ টাইম ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। আমার টেলিফিল্ম ‘মিস শিউলি’র ব্যাপারে আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যও তাই, ওয়াচ টাইম অনেক বেশি। সব মিলিয়ন ভিউ নাটক নিয়ে কি বছর শেষে আলোচনা হয়? সব কাজ কি দর্শকের মনকে নাড়া দিতে পারে দীর্ঘদিন ধরে? ব্যাবসায়িক কারণে হয়ত ওয়াচ টাইমের চেয়ে ভিউকে বেশি প্রমোট করা হয়। কারণ, প্রাথমিক ভিউ সংখ্যা দেখে বেশিরভাগই কাজটা দেখতে যায় , কেন এত ভিউ হল। তবে আমার সব কাজে হয়ত মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয় না আবার আমার অনেক কাজ আছে সেগুলার মিলিয়ন ভিউও আছে।