জন্মদিনে গানের মানুষ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই অবিভক্ত বঙ্গদেশের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কার্তিকেয় চন্দ্র রায় ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর নদীয়ার একজন কীর্তিমান পুরুষ। তাঁর জননী প্রসন্নময়ী দেবী। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন তাঁদের কনিষ্ঠ পুত্র। কার্তিকেয় চন্দ্র রায় কৃষ্ণনগরের দেওয়ান ছিলেন। তিনি বহু গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি একাধারে যেমন সুপন্ডিত ছিলেন, বিদ্বান ছিলেন, তেমনি আবার সুগায়ক ও সুপুরুষ ছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যজীবনের উপর তাঁর পিতার প্রভাব ছিল অপরিসীম।
১৮৯৭ সালের ২২ জানুয়ারি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও সুরবালা দেবীর প্রথম সন্তান দিলীপকুমার রায় জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর পুত্রকে ‘মন্টু’ নামে সম্বোধন করতেন। ১৮৯৯ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল ও সুরবালা দেবীর কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর নাম রাখা হয় মায়া।
দিলীপকুমারের বয়স যখন ৬ এবং মায়া দেবীর বয়স যখন ৪, তখন সুরবালা দেবীর মৃত্যু হয়। দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর পত্নীর আকস্মিক বিয়োগ ব্যথা ভুলতে পারেননি, তাঁর বহু কবিতায়, সঙ্গীতে এই ব্যথা বেদনা তিনি ব্যক্ত করেছেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল বাল্যকাল থেকেই তাঁর শান্ত, নির্ভীক পিতাকে দেখেই বড় হয়েছেন। এ বিষয়ে পুত্র দিলীপকুমার রায় তাঁর উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল গ্রন্থে লিখেছেন, “প্রায়ই বলতেন, ওরে জানিস আমি কার ছেলে? কার্তিক দাওয়ানের। আমি কবির কাছে শুনেছিলাম ছেলেবেলা থেকেই যে তাঁর পিতার চরিত্র তাঁকে খুব বেশী প্রভাবিত করেছিল। বিশেষ করে সত্য নিষ্ঠা, মনের জোর ও সরলতা এই তিনটি গুণ যেন উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া।”
দিলীপকুমার রায় তাঁর সম্পর্কে এক জায়গায় লিখেছেন, “একটি জিনিস সেই ছেলেবেলাতেই আমার চোখে পড়েছিল যে কবির মধ্যে দুটো মানুষ ছিল। একজন তীক্ষ্ণ বিচারক, বিবেকী, বিশ্লেষক আর একজন সরল, প্রণয়ী, উদাসী প্রেমিক”
দিলীপকুমার রায় নিজের পিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, “আমি তাঁকে আগে কবি বলেই বিশ্বাস করি। লোকের কাছে প্রায়ই শুনি তিনি ছিলেন প্রথমে নাট্যকার ও হাসির গানের কবি। আমি বলি না, তিনি ছিলেন সবার আগে কবি, গীতিকার ও সুরকার - composer - তার পরে আর যা বলতে চান বলুন।”
তাঁর পিতার সঙ্গীতচর্চা সম্পর্কে বলতে গিয়ে দিলীপকুমার রায় বলেছেন, “তিনি সুগায়ক ছিলেন, কিন্তু ওস্তাদ ছিলেন না, যেমন ছিলেন ঠাকুর্দা। শিখলে ওস্তাদ হতে পারতেন কিন্তু আশৈশব তাঁকে পড়াশোনাই বেশী করতে হয়েছিল, ফিরে এসে চাকরির হাড় ভাঙ্গা খাটুনি। কাজেই আমি নিজে গান শিখবার যেমন সুযোগ পেয়েছিলাম সেরকম সুযোগ তিনি পাবেন কোথা থেকে বলুন? কিন্তু তাঁর কন্ঠস্বরের এমন উদাত্ত লাবণ্য ছিল যে তাঁর গান সত্যিই চিত্ত হরণ করত। খোলা কণ্ঠ যত চড়াতেন ততই মিষ্ট হত - আর চড়াতেন গলা না চেপে- মিউমিউ ভঙ্গিতে নয়। তাই তাঁর গানে অত সহজে আগুন জ্বলে উঠত। শুধু স্বদেশী গানে বা যুদ্ধের গানে নয়, যখন হাসির গান গাইতেন তখনও।”
দিলীপকুমার রায় তাঁর স্মৃতিচারণ গ্রন্থে লিখেছেন, “তিনি শুধু একজন প্রথম শ্রেণির কবি ও সুরকার ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন যাকে সাহেবি ভাষায় বলে, ‘first class lover’ তাঁর দিকে এতলোক আকৃষ্ট হত প্রধানত তাঁর অসামান্য স্নেহ শক্তির জন্যেই।"
কল্যাণী কাজী সম্পাদিত শত কথায় নজরুল গ্রন্থে আলোর বাণীবহ নজরুল শীর্ষক রচনায় দিলীপকুমার রায় লিখেছেন, “দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন গানের এক দিকপাল- ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, কীর্তন, বাউল ও বহুভঙ্গিম প্রেমের গানে, স্বদেশী গানে তাঁর দান যে অসামান্য আজ সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু তাঁর গানে ঠুংরির চাল মেলেনা- পেলবতা ও সৌকুমার্যের সমন্বয়ে।
বাংলায় এ চাল প্রথমে আনেন অতুলপ্রসাদ। তাঁর সম্বন্ধে আমি অন্যত্র বহু আলোচনা করেছি। কাজীর সম্বন্ধেও করেছি আমার দুটি নিবন্ধে। তাতে দেখাতে চেষ্টা করেছি কিভাবে আমাদের বাংলা গানকে কাজী সমৃদ্ধ করে গেছে গজলের প্রেমের দুলকি চালে। এর পরে ও ঠুংরিতেও অনেকগুলি গান বাঁধে অতুলপ্রসাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। কিন্তু সে গানগুলি চমৎকার হলেও গানে ওর স্বকীয়তা ফুটে উঠেছিল সবচেয়ে বেশী ওর বাংলা গজলেই বলব। আমার বিশেষ প্রিয় ছিল ওর একটি গজল যেটি ভ্রাম্যমান হয়ে সর্বত্র গেয়ে আমি সব শ্রোতাকেই সচকিত করে তুলেছিলাম-
“বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল”
বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত নজরুল স্মৃতি গ্রন্থ থেকে জানা যায়- দিলীপকুমার রায় স্মৃতিচারণ করেছেন- “কাজীর সঙ্গে আমার আর একটি মস্ত মিল ছিল এইখানে যে, সে তার গানে সুরবিহারের স্বাধীনতা আমাকে সানন্দেই দিত, যেমন দিতেন আমার পিতা ও অতুলপ্রসাদ। এ নিয়ে কবিগুরুর সঙ্গে আমার মতভেদে কাজী ও অতুলপ্রসাদ বরাবরই ছিলেন আমার দিকে। তাই তো বুলবুল -এর উৎসর্গে কাজী আমাকে লিখেছিল:
যে গান গেয়েছি একাকী নিশীথে কুসুমের কানে কানে,
ওগো গুণী, তুমি জড়ালে তাহারে সব বুকে, সবখানে
বুকে বুকে আজ পেল আশ্রয় আমার নীড়ের পাখি,
মুক্ত পক্ষ উড়িতে যে চায় কেন তারে বেঁধে রাখি?
সে গুণী ছিল তাই বুঝত যে মুক্তপক্ষ সুরকে স্বরলিপির কাঠামোতে বেঁধে রাখলে তার গগনবিহার ব্যাহত হয়ই হয়। আজ শুনি একদল অগায়ক ক্রিটিকের মুখে যে এ স্বাধীনতা অক্ষমনীয়। কিন্তু অতুলপ্রসাদ ও কাজীর অনুমতি পাওয়ার পরে এ সব রুক্ষ ক্রিটিকদের মাথা-নাড়া উপেক্ষা করা চলে। কাজী আমার মুখে তার গানের নানা সুরবিহারে বিশেষ উৎফুল্ল হয়েছিল। সে যুগে আমার বাংলা গানের পাঁচটি ধারা ছিল - দ্বিজেন্দ্রলালের, অতুলপ্রসাদের, রজনীকান্তের, কাজীর ও আমার নিজের। পন্ডিচেরী চলে আসার আগে আমি সবচেয়ে বেশী গাইতাম অতুলপ্রসাদ ও কাজীর গান। মনে পড়ে কত আসরে এ দুই সুরকারকেই একসঙ্গে শুনিয়েছি তাঁদেরই রচিত গান। এ সৌভাগ্য কজন গায়কের হয়েছে জানিনা।”
দিলীপকুমার রায় উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল গ্রন্থে দ্বিজেন্দ্রলাল সম্পর্কে লিখেছেন “অত্যধিক স্পর্শ কাতর মানুষ, যেখনেই আত্মগ্লানির ছায়া দেখতেন সেখানেই তাঁর সমগ্র মনটি উঠত দুলে। শুধু গ্লানির ক্ষেত্রেই নয়, তাই বলে - সমবেদনায়ও।”
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শেষ জীবন সম্পর্কে তাঁর পুত্র বলেছেন “এই মানুষকে শেষ জীবনে যাপন করতে দেখেছি বিধবাদের জীবন। তখন বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন বুঝতে পারি - জীবনে আসক্তি বলতে যা বোঝায় সেটা তাঁর ছিলনা কোনোদিনই। তাই যা-ই ধরতেন, আঁকড়ে ধরলেও ধরতেন শিথিল মুষ্ঠিতে। ধরাটা তাঁর প্রবল ছিল কারণ তিনি স্বভাবে ছিলেন বলিষ্ঠ কিন্তু ব্যাকুল ছিলেন না, তার কারণ অন্তরে তিনি ছিলেন অনাসক্ত। তাই মরণে তাঁর ভয় ছিল না কোনো দিনই।”
তথ্য ঋণ: দ্বিজেন্দ্রলাল, ড. সুশীল ভট্টাচার্য, নজরুল স্মৃতি, বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত, শত কথায় নজরুল, কল্যাণী কাজী সম্পাদিত।
লেখক: সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)।