আমি শাবনূরের, শাবনূর আমার: কনক চাঁপা
বাংলা সংগীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম রোমানা মোর্শেদ কনক চাঁপা। অসংখ্য গান গেয়ে কোটি কোটি শ্রোতার মন জয় করে আছেন তিনি। শুধু প্লে ব্যাকেই নয়, আধুনিক গান, নজরুল সঙ্গীত, লোকগীতিসহ প্রায় সবধরনের গানে কনক চাঁপা সমান পারদর্শী। দীর্ঘ ৩৪ বছরের ক্যারিয়ারে তিন হাজারেরও বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। প্রকাশিত হয়েছে ৩৫টি একক গানের অ্যালবাম।
তবে নিজের প্লেব্যাকের ক্যারিয়ার যখন তুঙ্গে তখন চিত্রনায়িকা শাবনূরের ঠোঁটে অসংখ্য গান জনপ্রিয়তা পায় তার। শাবনূরের ঠোঁটে যে গানই শোনা যেত তার কণ্ঠই ছিলো কনক চাঁপার। সে স্মৃতি রোমন্থন করেই বুধবার (৬ অক্টোবর) নিজের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে শাবনূরকে নিয়ে একটি দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন কনক চাঁপা। বার্তা ২৪.কমের সঙ্গেও আলাপ হলো সেই সূত্রে।
শাবনূরকে নিয়ে কনক চাঁপা লিখেছেন, “দু’জনকে বলা যায় দুই দেহ এক উপস্থাপন। আমি শাবনূরের অথবা শাবনূর আমার। প্লেব্যাকের পুরোটা উজ্জ্বল সময় আমি প্রধানত শাবনূরের জন্য গেয়েছি। আমি গাইলে নাকি ডিরেক্টরদের মনে হতো তিনি গেয়েছেন। তাই তার ছবির গানে কনক চাঁপার কণ্ঠ আবশ্যম্ভাবী। এসব কথা বা ব্যখ্যা অথবা বাস্তব ঘটনা যারা ছবি দেখতেন বা ছবির ভক্ত ছিলেন তারা সবাই জানেন।"
অথচ শাবনূরের সাথে নাকি কনক চাঁপার দেখা-সাক্ষাত হয়েছে হাতে গোনা কয়েকবার।
“কিন্তু একটি কথা একদম অজানা যেমন পুরো পেশাদার জীবনে শাবনূর আর আমার খুব কম দেখা হয়েছে। প্লেব্যাক এর প্রথম দিকে দুজন মিলে একটা টিভি চ্যানেলের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। এরপর হঠাৎ হঠাৎ হয়তো চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কোন অনুষ্ঠানে মিতবাক শাবনূরের সাথে আমার খুবই কম সময়ের জন্য দেখা হয়েছে। দুয়েকটা বাক্য বিনিময় ছাড়া আর কিছু হয়নি আমাদের মাঝে।
তো মাশুকের বিয়ের সময় দাওয়াত দিতে গেলাম তার বাসায়। বাসায় যাওয়ার পরে আবেগে উচ্ছ্বাসে একদম উল্লসিত হয়ে গেলো। আমার বাসা ওর বাসার কাছে শুনে বললো "ও আল্লাহ! তাইলে তো আপনার নিঃশ্বাস ও আমি পাই।”
যোগ করে কনক চাঁপা আর লিখেছেন, “দুপুর বেলা গড়িয়ে গেলেও সে কিছুতেই না খেয়ে আসতে দিলো না। নিজ হাতে বেড়ে বেড়ে নিজের করা রান্না আমাদের খাওয়ালো। আমি বারবার শাবনূরের চোখের দিকে তাকাচ্ছিলাম! এবং চমকে যাচ্ছিলাম। তার চোখ এতো সুন্দর যে বেশীক্ষণ তাকানো যায় না! চলা-বলায় এতো ভোলাভালা যে আমি বারবার ভাবছিলাম একটা মানুষ এতো নিখুঁত অভিনয় কিভাবে করে! কিভাবে পারে! ”
এতদিন পর কোন সূত্রে মনে পড়লো দূরের সখাকে?
বার্তা টোয়েন্টিফোরের সঙ্গে আলাপচারিতায় কনক চাঁপা বললেন, “গুগল ফটো থেকে কিছু ছবি বাদ দিচ্ছিলাম তখনই সামনে হঠাৎ আমার আর শাবনূরের একসঙ্গে তোলা ছবিটি চোখে পড়লো তাই ভাবলাম পোস্ট করি। আগে তো কখনও করা হয়নি। ছবিটি আমার ছেলের বিয়েতে তোলা। ছবিটি পোস্ট করতে গিয়েই মনে হলো সারাজীবন একসঙ্গে গান গেয়েছি। আমি গেয়েছি আর তিনি ঠোঁটে ধরেছেন। তাই সেক্ষেত্রে সফল জুটি বলা যায় আমাদের।”
শাবনূরের অভিনয়ে যেসব গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার মাঝে কোন গানগুলোর প্রতি বেশি ভালো লাগা কনক চাঁপার?
জানতে চাইলে তিনি বলেন, “জনপ্রিয় গানের কথা আমি কখনও বলি না। এটি তো শ্রোতারাই ভালো বলতে পারবে। আর তাছাড়া শাবনূরের সব গান যে আমি স্ক্রিনে দেখেছি সেটিও কিন্তু না। কারণ শাবনূরের গানের জন্যই এতো ব্যস্ত থাকতাম যে স্ক্রিনে দেখা সম্ভব ছিলো না। তারপরও কিছু গান যেমন ‘ভালোবাসা ভালোবাসা থাকো তুমি দূরে’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে’ এই ধরনের কিছু স্যাড রোম্যান্টিক গান আমার চোখে পড়েছে যা দেখার পর মনে হয়েছে এগুলোতে তার চাইতে ভালো অভিনয় আর কেউ করতে পারতেন না। ”
নব্বই দশকের চলচ্চিত্রে শাবনূরের ক্যারিয়ার যখন তুঙ্গে তখন কনক চাঁপাও গাইছেন একের পর এক জনপ্রিয় সব গান। শাবনূরের লিপের জন্য তার উপর দারুণ নির্ভরশীল ছিলেন প্রযোজক ও সংগীত পরিচালকরা।
“আমার মনে হয় যে, শাবনূরের সম্পূর্ণ লাইফের এপিসোড আমিই কভার করেছি দুই চারটি গান ছাড়া। হয়তো এক বা দুই পারসেন্ট গান বাকিরা গেয়েছেন।”
শাবনূরের সাথে কম দেখা হয়েছে বটে কিন্তু শিল্পীর প্রতি শিল্পীর যে সম্মান তা কয়েকবারের সাক্ষাতেই দু’জন দু’জনকে দিয়েছিলেন প্রাণভরে।
“সারাজীবনে হয়তো চার থেকে পাঁচবার দেখা হয়েছে। তারপর ছেলের বিয়েতে দাওয়াত দিতে শাবনূরের বাড়িতে গিয়ে তার যে উচ্ছ্বাসটা ও শ্রদ্ধাবোধ এবং একজন শিল্পীর প্রতি সম্মান তাতে আমি মুগ্ধ। এটি ছিলো আমার জন্য অনেক বড় একটি পাওয়া। কারণ তিনি আমাকে এভাবে ভাবেন। তারপর অনেক যত্ন করে আমাকে খাওয়ালেন।”
শিল্পীদের প্রতি শিল্পীদের এ সম্মান সবসময়ই থাকা উচিত বলে মানেন কনক চাঁপা। সম্পর্ক থাকুক বা নাই থাকুক- প্রশংসা করতে কার্পন্য নেই তার।
“আমি কারও প্রশংসা করতে কার্পন্য করি না। শিল্পীদের কর্ম ও মেধা নিয়ে কথা বলতে পছন্দ বরি। কারণ এরা তো আমাদেরই সম্পদ। কবরী বলেন, সাবিনা আপা বা রুনা আপাই বলেন। সবাই আমাদের সম্পদ। আর আমি আমাদের এই শিল্প জগতে যতো সম্পদ আছে সবাইকে আমি ভালোবাসি শ্রদ্ধা করি। এটিই আমার পেশাদার জগতের একটি বলয়। আর এই বলয়ের মধ্যেই আমি একজন। সেটি নিয়ে আমি সবসময় গর্ব অনুভব করি।”
চিত্রনায়িকা শাবনূর এখন আর বড় পর্দায় সক্রিয় নেই। যদিও তার সমসাময়িক অনেকেরই এখনো পর্দায় সরব উপস্থিতি। শাবনূরের আড়ালে সরে যাওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন কনক চাঁপা।
“শিল্পীদের আসলে জানতে হয় কোথায় থামা উচিত। যেমন ধরুন শাবনূর যদি মায়ের চরিত্র বা বুড়ি দাদীর চরিত্রে অভিনয় করতো তাহলে একটা সময় আপনার কাছে তার ওই রূপটা মনে ভাসতে থাকতো। তাই আমার মনে হয় শাবনূর তার জায়গায় ঠিক আছেন এবং সঠিক সময়ে থেকে গিয়েছেন। একজন শিল্পী তার সীমানাটা জানলে খুব ভালো হয়। এদেরকে আমি খুব ভালো চোখে দেখি।”
নিজের ব্যাস্ততার কথাও জানালেন কনক চাঁপা। সংসারেই সময় কাটছে তার। মহামারির মাঝেও দেশের বাইরে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন।
তবে নতুন গান আটকে আছে সাবধানতার কারণেই- “ছবির জন্য গানের ডাক আসে কিন্তু স্টুডিওগুলো আমি রিস্ক মনে করি যার ফলে সেটি একটু এড়িয়ে চলছি।”
চার নাতি-নাতনির সঙ্গে বাগানের ফুল ও পাখিদের সঙ্গে সংসারের নিত্যকাজে সুখেই আছেন কনক চাঁপা।