সাদি মহম্মদের অভিমানী মৃত্যুতে তারকাদের হৃদয় নিংড়ানো অভিব্যক্তি

  • মাসিদ রণ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সাদি মহম্মদ

সাদি মহম্মদ

দেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার ঘটনা শিল্পী সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। শিল্পীর অভিমান, একাকিত্ব, প্রাপ্য সম্মানের প্রশ্ন উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এমন বিনয়ী মানুষের এভাবে চলে যাওয়ায় শোকে স্তব্ধ শিল্পী সমাজ। ফেসবুক যেন হয়ে উঠেছে শোক বই। সাদি মহম্মদের শেষ বিদায়ে তাকে নিয়ে লেখা কয়েকজন শিল্পীর স্ট্যাটাস নিয়ে এই আয়োজন

ক্ষমা করে দিও সাদি ভাই

সুবর্ণা মুস্তাফা, অভিনয়শিল্পী
‘ক্ষমা করে দিও সাদি ভাই
তোমার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবো আমরা।
শান্তিতে মায়ের কোলে ঘুমাও
শ্রদ্ধা মহান শিল্পী’

ইয়াসমিন মুশতারি ও সাদি মহম্মদ

ভীষণ অভিমান বোধ হচ্ছে!

ইয়াসমিন মুশতারি, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী
‘এই ছবির মত আদর থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলাম। তার চলে যাওয়াতে খুব কষ্ট। তবে, তার থেকেও ভীষণ অভিমান বোধ হচ্ছে! কেন সাদি ভাই? সারা পৃথিবীর বাঙ্গালী আমরা সবাই তো আপনাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। আল্লাহ্ পাক তুমি তাকে বেহেস্ত নসিব করো। আমিন।’

বিজ্ঞাপন

অভিমান করে শুধু কষ্টই বাড়ে, বাড়ে বিষন্নতা

ফাহিমদা নবী, সঙ্গীতশিল্পী
‘কি শুনলাম! সাদি ভাই নেই! দেখা হলেই সব সময় ভালো ব্যবহারে আর কথার মিষ্টতায় মন খুশি করে রাখতেন যে মানুষটি, সে চলে গেলেন না ফেরার দেশে স্বেচ্ছা মৃত্যুতে! এমন কখনো দেখিনি, অনেক কিছু চাই তার, সম্মানটুকু ছাড়া। খুব সাধারন একজন অভিমানী শিল্পী। শিল্পীর অভিমান তো থাকবেই, সেটাই তার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু অভিমান করে শুধু কষ্টই বাড়ে, বাড়ে বিষন্নতা! তা একপর্যায়ে তিনি হয়তো মানতে পারেননি। বহুবার বলেছি অভিমান করবেন না। কিন্তু একাকী অভিমানের ওজন এতোটাই হয়তো বেড়ে গিয়েছিলো, পারলেন না আর সেই দৌড়ে নিজেকে বাঁচাতে! আত্মোহননের পথ বেছে নিলেন! কেন? অভিমান, কষ্ট থেকে পরিত্রানের এ পথ তো বেছে নেয়া ঠিক হলো না সাদি ভাই! হারালাম আমরা দরদী কন্ঠের সাদি মোহম্মদকে, যার কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভিন্ন এক মাত্রা পেয়েছিলো। খুব সচেতন হয়ে গান গাইতেন। গান গাইতেন ভালোবেসে। আমাকে আর সুমাকে (সামিনা চৌধুরী) খুব ভালোবাসতেন। সাদি ভাই, অনেক কান্না পাচ্ছে আপনার চলে যাওয়ায়। আল্লাহ যেন তাকে মাফ করে দেন। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করছি, আমিন।’

সাদি মহম্মদ ও ফাহমিদা নবী

শিবলী ভাইটার কথা একবার ভাবতে ভুলে গেলেন?

সামিনা চৌধুরী, সঙ্গীতশিল্পী

বিজ্ঞাপন

কেন সাদি ভাই, কেন? আমাদের কথা বাদ, শিবলী ভাইটার কথা (সাদি মহম্মদের ছোট ভাই, প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী) একবার ভাবতে ভুলে গেলেন? কী কষ্ট হচ্ছিল মনের ভেতরে যে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন সাদি ভাই?’

কি এমন তাড়া ছিলো?

অরুনা বিশ্বাস, চলচ্চিত্র অভিনেত্রী
‘শ্রদ্ধেয় সাদি মোহাম্মদ ভাই, কি এমন তাড়া ছিলো? ভালো থাকবেন অনন্তলোকে।’

এ অভিমানে কোন কিছু কি বদলাবে!

মুনমুন আহেমদ, নৃত্যশিল্পী
‘হে গুণী, আপনার এ অভিমানে কোন কিছু কি বদলাবে!’

নিজের তালিমের ঘরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শিল্পী

কারণে-অকারণে কল করতেন, সেটা মিস করবো

বন্যা মির্জা, অভিনয়শিল্পী

সাদি ভাই, আর একটু বেশী বেঁচে গেলে কি আপনার অনেক বেশী কষ্ট হতো? যদি তাই হয় তাহলে হয়তো ঠিকই আছে। আপনি যে কারণে-অকারণে কল করতেন, সেটা মিস করবো। তারপর একদিন ভুলেও যাবো। আপনার আত্মা শান্তি পাক।’

তাকে নিয়ে ভাববার সময় কি আসলেই আমাদের হাতে ছিলো?

চঞ্চল চৌধুরী, অভিনয়শিল্পী
‘প্রাচীন এই পৃথিবীতে জন্ম এবং মৃত্যু প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। জন্ম যেমন আনন্দের, মৃত্যু ততোধিক শোকের। স্বাভাবিক মৃত্যুতে শুধুই শোক বিরাজমান কিন্তু এ কেমন মৃত্যু? এ কেমন চলে যাওয়া? পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র এর কতটুকু দায় নেবে জানিনা, তবে সাদি ভাইয়ের মৃত্যু অন্য কোন অভিমান বা বেদনার কথা কয়ে যায়। কাল রাতে এই দুঃসংবাদটি শোনার পর থেকে ওনাকে নিয়ে কিছু লিখবার সাহস হচ্ছিলো না। আবার প্রিয় শিল্পী সাদি মোহাম্মদের এমনভাবে চলে যাওয়াটাও মেনে নিতে পারছিলাম না। তাকে নিয়ে ভাববার সময় কি আসলেই আমাদের হাতে ছিলো? যখন কোন মানুষ একান্তই একা হয়ে যায়, পৃথিবীর কোন মায়া যখন তাকে আর আটকাতে পারে না, তখনই সে এমন কিছু করে। আমরাই তাকে একা করে দিয়েছি, যোগ্য সম্মান দিতে পারিনি। এই দেশটির জন্য সাদি ভাইয়ের পরিবারের আত্মত্যাগের কথাও নিশ্চয়ই আমরা ভুলে গেছি বা যাবো! আমাদের ক্ষমা করে দিন সাদি ভাই। আপনি স্বেচ্ছায় যেখানে চলে গেলেন, সেখানে ভালো থাকবেন। অসীম শ্রদ্ধা।’

রুনা খান

ওর মৃত্যুতে আপনি কী শোকগাথা লিখবেন!

রুনা খান, অভিনয়শিল্পী
‘সাদি মহম্মদের জন্যে একটা শোকগাথা লিখতে ইচ্ছে করছে, পারছি না। আপনারা যখন সাদি মহম্মদকে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে দেখেন আমি তো সেই কিশোরকে দেখি যে একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলিতে পরম যত্নে বাংলাদেশ নামক আমাদের স্বপ্নের সোনার দেশটির নতুন গৃহীত পতাকাটি এঁকেছে সবুজ লাল আর সোনালী বস্ত্রখণ্ডে। ওর মা হৃদয় নিংড়ে মমতা মাখিয়ে সেই পতাকাটি সেলাই করেছিল। ওর সাহসী পিতা ওদের তাজমহল রোডের বাড়ীতে সেই পতাকাটি উড়িয়ে দিয়েছিল।
সাদি মহম্মদ হচ্ছেন সেই কিশোর যে কিনা ওর বীর পিতাকে দেখেছে আকাশে উড়িয়ে দিতে স্বাধীন বাংলাদেশের দুরন্ত পতাকা। আবার সেই কিশোরই দেখেছে কাপুরুষ কিছু বিহারী পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে ওদের বাড়ীতে আক্রমণ করেছে। কিশোর সাদির সামনে সেইসব কাপুরুষেরা হত্যা করেছে ওর পিতাকে। ছোট একটি কিশোর দেখেছে ওর চোখের সামনে ওঁরা ওর পিতাকে হত্যা করেছে, ওদের বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। মাতৃভূমির জন্যে সাদি মহম্মদের এইটুকুই নৈবেদ্য। আপনি ভাবুন তো, সাদি মহম্মদ যখন গাইতেন আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি অথবা অন্য কোন দেশের গান সেই গানটির অর্থ কি দাঁড়ায়! শুধু জাতীয় সঙ্গীত বা দেশের গানের কথা শুধু নয়। সাদি মহম্মদের কণ্ঠ প্রতিটা বাংলা গান- হোক সে রবীন্দ্রনাথের গান বা পঞ্চকবির গান যা যেকোন বাংলা গান- সেই গান আর শুদ্ধ একটি গান মাত্র থাকে না, সেটি হয়ে যায় বাংলায় পবিত্র উচ্চারণ। এই লোকটি নিজের জন্যে কোনদিন কোন অনুযোগ করেনি, অভিযোগ করেনি। কদাচিৎ কখনো দুঃখ করে দুই একবার হয়তো বলেছে মাতৃভূমির কথা- নিজের কথা নয়। ওর মৃত্যুতে আপনি কী শোকগাথা লিখবেন! কেবল বলতে পারেন সাদি মহম্মদ আপনাকে আমরা ভালোবাসি। এছাড়া আর কী লিখবেন আপনি? কী বলবেন! হৃদয়ে ধারণ করা ভালোবাসা প্রকাশ করার মতো শক্তি আপনার আছে? সেই শক্তি কারো থাকে? আমার তো নেই। আপনাকে আমি ভালোবাসি সাদি মহম্মদ। আমাদের ভালোবাসা আপনার জন্যে সাদি মহম্মদ। আপনি এই পৃথিবীতে শারীরিকভাবে আছেন কি নেই তাতে আমাদের কিসসু যায় আসে না। আমরা আপনাকে ভালোবাসি।
লেখা - ইমতিয়াজ মাহমুদ’

এই পৃথিবীটা আর ভালো লাগছিল না তার

ফারহিন খান জয়িতা, সঙ্গীতশিল্পী
‘গতকাল হাসপাতাল থেকে সাদি মামার বাসা পুরোটা সময় একবারো আমার মনে হয়নি কেন এমন করলো? আমার শুধু মনে হয়েছে এই জীবনটা, এই পৃথিবীটা আর ভালো লাগছিল না তার। জোর করে এই ভালো থাকার ভানটা তাঁর জন্য ক্লান্তিকর ছিল। উচিৎ- অনুচিত... এই তর্কে যাওয়ার কিছু নেই আর।
এই মহান শিল্পী , একজন দারুন ,নরম মানুষ- সাদী মামার যাত্রা সুন্দর হোক, আরামদায়ক হোক। উনার সকল কষ্টের অবসান হোক।

শিবলী মহম্মদ, মৌ ও সাদি মহম্মদ

নোংরা সিস্টেমকে চপেটাঘাত দিয়ে বিদায়

তাহিমনা সুলতানা মৌ, অভিনয়শিল্পী
‘বেঁচে থাকতেই মানুষটা স্পষ্ট বলে গেছেন, আমাকে যেন কোনো মরনোত্তর পদক না দেয়া হয়। সেই অভিমানে তাকে শহীদ মিনারে না নেয়ার সিদ্ধান্ত (আপাতত)। রাষ্ট্রকে শুধু দিয়েই গেলেন মানুষটি! শহীদ পিতার সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে চোখের সামনে বাবার মৃত্যু দেখার ট্রমা নিয়ে বেঁচেছিলেন শুধু গানটা নিয়ে! এতো নির্মোহ মানুষ আর একটাও ছিলো না। চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের একটু আদর! বিনিময়ে সে রাষ্ট্রের কাছ থেকে। পেলেন প্রবঞ্চনা! কিছু দিন আগে কজনার ছবি দিয়ে অভিমান জানিয়েছিলাম আমি আজ তার একজন ঝরে গেলেন! রাষ্ট্র কারো কারোকে নিয়ে তুমুল উৎসব করবেন, অথচ প্রকৃত নির্মোহ শিল্পীদের কারো কারো জন্য রেখে যাবেন অন্ধকার! ঠিক তাই যেন তীব্র অভিমানে নিজের তানপুরাটা ছেড়েই স্বেচ্ছামৃত্যু! এই নোংরা সিস্টেমকে চপেটাঘাত দিয়ে যেন বিদায় দিলেন নিজের অভিমানের!
সাদি মোহাম্মদ! রাষ্ট্র প্রকৃত শিল্পীকে লালন না করতে জানলে এ বিষাদ বাড়বে! এ বিষাদের দায় আমার আপনার অনেকের! বিদায় হে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজা। ভাল থাকবেন।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের লাশঘর থেকে
১৪ মার্চ, বিশচব্বিশ
Tanvir Tareq এর ওয়াল থেকে নেয়া।’