পিএইচডি’র জন্য সারা দেশ চষে বেড়িয়েছি : নাজনিন চুমকী
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী নাজনিন হাসান চুমকী এখন ড. নাজনিন হাসান চুমকী। এ দেশের শোবিজ তারকাদের মধ্যে হাতে গোনা দু-চার জন তারকাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী দিয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। তবে পড়াশুনা করে সুষ্ঠু নিয়মে ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়েছেন এমন তারকা একেবারেই কম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই বিরল সম্মান অর্জন করেছেন চুমকী। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের শিশু থিয়েটার চর্চা (১৯৯১-২০১০)’। এ প্রসঙ্গে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন তিনি। তারই অংশ বিশেষ তুলে ধরেছেন মাসিদ রণ
পিএইচডি ডিগ্রী’র মতো বিরল অর্জনের জন্য আপনাকে অভিনন্দন...
আমি আসলে আনন্দে আত্মহারা। বছরের পর বছর গবেষণার কাজে লেগে থেকে যে পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, ডিগ্রী অর্জনের পর আপনারা যেভাবে আমাকে ভালোবাসা জানাচ্ছেন, তাতে সব কষ্ট উবে গেছে। আমি ঠিক জানি না, এতো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য কিনা আমি। তবে এটুকু বলতে পারি, নিষ্ঠা আর সততার সঙ্গে আমার কাজটি করেছি। আমার গবেষণা যদি বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চা তথা সাংস্কৃতিক বিকাশে কোন সহায়তা করতে পারে তবেই হবে সার্থকতা।
কতো সময় লাগলো পুরো গবেষণাকর্ম সম্পাদন করতে?
আমার সত্যি অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সবমিলিয়ে ৭-৮ বছর লেগেছে পিএইচডি শেষ করতে। তবে মূলত কাজটুকু করেছি কোভিডের সময়। অনেক আগে থেকে অভিনয় করলেও আমার পড়াশোনা কিন্তু অন্য বিষয়ে। মাস্টার্সের পর যখন ভাবলাম থিয়েটার নিয়ে গবেষণা করবো, তখন নিয়ম অনুযায়ি এমফিল দিয়ে শুরু করি। সেটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর রেজাল্ট যদি ৬০% এর বেশি হয় তবেই পিএইচডি তে কনভার্ট হওয়া যায়। আমার রেজাল্ট ভালো হয়েছিল বলেই পিএইচডিতে হাত দিই। তবে আমার অনেক প্রতিবন্ধকতা গেছে এরমধ্যে। একজন পেশাদার অভিনেত্রী, তার ওপর অনেক দায়িত্বের চাপ, স্বামীর অসুস্থতা, আমার পিএইচডি’র তত্ত্বাবধায়ন ড. আফসার আহমেদ স্যারের মৃত্যু- সব মিলিয়ে আমি ঠিক শতভাগ মনোনিবেশ করতে পারছিলাম না থিসিসে। ফলে আমার মাঝে বড় বড় বিরতি গেছে। কিন্তু আমি আসলে হাল ছাড়িনি।
গবেষণার দিনগুলো কেমন ছিল সংক্ষেপে যদি বলেন...
কোভিডের সময় ঘরবন্দি জীবনে অনেক কিছুই করার ছিল না। ফলে সেই সময় চেয়েছি একটু পড়াশুনা করতে। ভাবলাম অভিনয়ের ওপর মাস্টার ক্লাস করবো অনলাইনে। কিন্তু আমার ননাস ড. আইরিন আক্তার (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র প্রফেসর) বললেন, ‘মাস্টার ক্লাস কেন করবে? তুমি তো পিএইচডি’টাই শেষ করোনি। এই সময়ে সেটা শেষ করে ফেলো।’
তার কথায় আমিও গুরুত্বটা অনুভব করি। শুরু হয় আমার পড়াশুনা। সব কাজ সামলে পড়া শুরু করতাম সন্ধ্যার পর। কোন কোন দিন রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যেতো। কাজ শুরুর ১৩ দিনের মাথায় আমি প্রথম সেমিনার দিই, এতো পরিমাণ পরিশ্রম করেছি সে সময়। এরপর যখন কোভিড নিয়ন্ত্রণে এলো তখনও শোবিজের কাজ বন্ধ করে দিই। আমি সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছি। লোকজন আমাকে প্রশ্ন করতেন, কেন অভিনয় করছি না। আমি চুপ থাকতাম, কারণ তখন গবেষনার কাজটি করছিলাম। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশের শিশু থিয়েটার চর্চা (১৯৯১-২০১০)’ শীর্ষক আমার গবেষণাপত্র জমা দিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত ২৩ মে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের বিশেষ সভায় সিদ্ধান্ত শেষে ৫ জুন আমাকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. হারুন অর রশীদ খানের তত্ত্বাবধানে আমি পিএইচডি সম্পান্ন করতে সক্ষম হয়েছি।
পিএইচডি’র মতো বড় কলেবরের বিষয়কে যদি ছোট্ট করে বলেন, আপনার গবেষণায় নতুন কোন বিষয়গুলো যোগ হলো থিয়েটার চর্চায়?
আমার গবেষণার সময়কাল ছিল ১৯৯১ থেকে ২০১০ সালের বাংলাদেশের শিশু থিয়েটার চর্চা। এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যে বিষয়গুলো পেয়েছি, তারমধ্যে সবচেয়ে আগে বলতে হয়, যারা শিশু থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, হতবাক হলেও সত্য যে তাদের কেউই জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়েননি।
শিশু থিয়েটার চর্চা যে একজন মানুষকে সৎ, পরিশ্রমী ও বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী করে তোলে সেটা আমার গবেষণায় উঠে এসেছে। সবাই হয়তো সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে এখন আর যুক্ত নেই, তবে যে যে ক্ষেত্রে কাজ করছে স্ব স্ব ক্ষেত্রে দারুণভাবে সফল তারা। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কয়েকজনের নাম বলতে চাই যারা শিশু থিয়েটার চর্চা করেছেন এবং এখনো দারুণ সফল। তারা হলেন- তারানা হালিম, মোরশেদুল ইসলাম, জাহিদ হাসান শোভন, অপি করিম, তারিন জাহান।
শিশু থিয়েটার চর্চা কী শুধুমাত্র রাজধানীকেন্ত্রিক?
না, সারা দেশে দারুণভাবে থিয়েটার চর্চা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটা কথা বলতেই হয়, লিয়াকত আলি লাকী প্রতিষ্ঠিত পিপল’স থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন আমাকে গবেষণার ক্ষেত্রে অসম্ভব সহযোগীতা করেছে। কারণ এই সংগঠনটি শিশু থিয়েটার নিয়েই কাজ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বলা যেতে পারে, পুরো দেশে যে শিশু থিয়েটার চর্চা হচ্ছে তাতে এই সংগঠনের অনেক বড় অবদান রয়েছে। তবে শিশুরা পরিচর্যার অভাবে থিয়েটারের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকতে পারে না। এই বিচ্ছিন্নতা শুরু হয় স্কুলজীবন শেষ হলে। অথচ জীবনে সবচেয়ে বড় শেখায় সময়টাই তখন।
এর কারণ হিসেবে কি পেয়েছেন আপনি?
এটি হয় মূলত সামাজিক বাস্তবতার কারণে। সামাজিকভাবে শুধু নারীদের বা প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকে বাধাগ্রস্ত করা হয় না। শিশুকেও নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। এসব তথ্য মাঠ পর্যায়ে অনেকের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বেরিয়ে এনেছি। সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি আরও যে বিষয়গুলো এর কারণ তা হলো- প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যাবস্থার যে সিস্টেম সেটি এক্সট্রা কারিকুলার এ্যাকটিভিটিকে বাধাগ্রস্ত করে। এছাড়া অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতাতো রয়েছেই।