জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী মৌটুসী বিশ্বাসকে ইদানিং নতুন কাজে একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ গত একটা বছর টানা কাজ করেছেন ক্যামেরার পেছনে। ব্র্যাকের ‘অতিথি’ প্রজেক্টের একজন গবেষণাকর্মী হিসেবে ব্যস্ত ছিলেন। তবে কাজটি দর্শকের সামনে আসতে আসতে তাকেও নিয়ে আসা হয়েছে ক্যামেরার সামনে। সেই কাজটিই এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় দারুণ প্রশংসা কুড়াচ্ছে। ‘অতিথি’র আদ্যোপান্ত নিয়ে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসিদ রণ
মাসিদ রণ: ব্র্যাকের ‘অতিথি’ প্রজেক্টের অডিও ভিজ্যুয়াল সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশের পর দারুণ প্রশংসা শোনা যাচ্ছে...
মৌটুসী বিশ্বাস: সত্যি আমি এতো ভালো ভালো মন্তব্য ও কাজটির গুণগত মানের প্রশংসা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। কারণ আমি শুধু এই অডিও ভিজ্যুয়ালে একজন মডেল হিসেবেই কাজ করিনি। ক্যামেরার পেছনে দিনের পর দিন কাজ করেছি। এর প্রতিটি ফ্রেমে রয়েছে আমিসহ পুরো টিমের অনেক পরিশ্রম ও আন্তরিকতা। আজকাল তো ভালো মানের কনটেন্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে সাড়া ফেলে না। তবে আমাদের কাজটি দর্শকের এতো ভালো লেগেছে দেখে সকল পরিশ্রম সার্থক মনে হচ্ছে। আমার পুরো মডেলিং ক্যারিয়ারে এতো ভালো সাড়া কোন কাজে পাইনি।
মাসিদ রণ: ‘অতিথি’ প্রজেক্টটি কিছু বলুন...
মৌটুসী বিশ্বাস: বাংলাদেশে ভ্রমণের প্রসঙ্গ আসলেই কক্সবাজারের সি বিচ, সিলেটের চা বাগান, সুন্দরবন কিংবা বান্দরবানের পাহাড়- এমন গুটি কয়েক জায়গার কথাই মনে পড়ে। কিন্তু এর বাইরেও যে আমাদের সবুজ শ্যামল দেশের কতো জায়গা ঘুরে দেখার আছে, কতো ইতিহাস-ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জায়গা রয়েছে, সেসব জায়গাকে আরেকবার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ব্র্যাকের মতো একটি ওয়ার্ল্ড ফেমাস এনজিও এই প্রজেক্টটি হাতে নিয়েছে। এজন্য তাদের সাধুবাদ না নিয়ে পারছি না।
খেয়াল করে দেখবেন, শ্রীলংকা, ভুটান এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতেও টুরিজ্যমে আগ্রহী করে তোলার জন্য কতো ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রোজেক্ট হয়। কতো অর্থ লগ্নি হয় এই কাজগুলোর পেছনে। এর ফলে যেখানে প্রচুর টুরিস্টদের আগমন হয়। দেশের অর্থনীতিতে যা দারুণভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তেমনি একটি কাজ করতে চেয়েছে ব্র্যাক।
প্রতিষ্ঠানটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আসিফ সালেহ’র মস্তিষ্কপ্রসূত এই আইডিয়াটির নামই হলো ‘অতিথি’। বেশ আগে থেকেই এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শুরুতেই তারা এমন একটি জেলাকে বেছে নিয়েছে যেখানে ভ্রমণের কথা কেউ চিন্তাও করে না। সেটি হলো ‘রাজশাহী’। এই বিভাগটি যে শুধু আমের জন্য বিখ্যাত নয়, এখানেও যে ভ্রমণের অসাধারণ উপকরণ রয়েছে, এটাও যে ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি খনি, হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতির খনি তা জানাতে চেয়েছি আমরা।
মাসিদ রণ: এই প্রোজেক্টে যুক্ত হওয়ার প্রধাণ কারণ কী?
মৌটুসী বিশ্বাস: ওই যে বললাম, এই প্রোজেক্টটি দেশের মানুষ, দেশের অর্থনীতি তথা পিছিয়ে পড়া কমিউনিটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। ফলে আমার মনে হয়েছে, যে কাজটি আমি প্রফেশনালি করছি সেটা আমার দেশের জন্য দারুণ সহায়ক হবে। তাই পুরো জার্নিতে আমার বার বার মনে হয়েছে আমি দেশের জন্য কিছু একটা করছি। তাই ওমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে টানা কাজ করতে গিয়ে ক্লান্তি ভর করলেও পরক্ষণেই দেশের কথা ভাবতেই আমার মধ্যে শক্তি সঞ্চার হয়েছে। আমি মনে করেছি, কাজটি ভালো করে করতে পারলে কতো মানুষ রাজশাহীতে ভ্রমণের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
মাসিদ রণ: কবে কিভাবে যুক্ত হলেন?
মৌটুসী বিশ্বাস: এই প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি প্রায় এক বছর আগে। ব্র্যাক থেকেই আমাকে প্রস্তাবটি দেওয়া হয়। আমি এর আগেও স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের জন্য ভ্রমণবিষয়ক শো হোস্ট করেছি লম্বা সময় ধরে। সেই শোটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। তাই আমার অভিজ্ঞতার ব্যাপারে ধারণা ছিলো ব্র্যাকের। তারা যখন আমাকে এতো লম্বা সময়ের জন্য কাজটির প্রস্তাব দেয়, আমি একটু ভেবে চিন্তে রাজী হই। কারণ আপনারা জানেন, আমি আগের মতো টিভিতে নিয়মিত নাটক করি না। খুব বেছে বছরে একটা বা দুইটা কাজ করি। কারণ মানহীন কাজে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। তাই এই প্রোজেক্টে এতো লম্বা সময় দেবো কি না সেটি ভাবতে হয়েছে। কারণ আমি এখানে শুধু একজন মডেল হিসেবে কাজ করিনি। আমি ব্র্যাকের টিমের একজন সদস্য হিসেবে দিনের পর দিন কাজ করেছি। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে ফিল্ড ওয়ার্ক-এর মাধ্যমে জায়গাগুলো সম্পর্কে জেনেছি, বইপত্র থেকেও জেনেছি। যার ফলাফল দর্শক এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখতে পাচ্ছেন।
মাসিদ রণ: কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
মৌটুসী বিশ্বাস: মানুষ একটি কাজ শুরু করার সময় তো এক ধরনের প্রত্যাশা নিয়েই শুরু করে। কিন্তু কাজটি শেষ করে মনে হয়েছে, আমি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি। ব্র্যাকের সঙ্গে আমার কাজের অভিজ্ঞতা খুবই ভালো। তারা একইসঙ্গে ভীষণ প্রফেশনাল এবং আন্তরিক। নারীদের কতোটা সম্মান ও কমফোর্ট দিয়ে কাজ করাতে হয় সেটি ব্র্যাকের কাছ থেকে আমাদের দেশের অনেকের শেখার আছে। এমন কর্মপরিবেশ না পেলে আমি কাজটা শেষ করতে পারতাম কি না সন্দেহ আছে। কারণ আমি অভিনয় করতে গিয়েও কর্মপরিবেশ ভালো লাগেনি বলে সেই টিমের সঙ্গে আর কাজ করিনি এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে।
অনেক লম্বা সময় দিতে হয়েছে কাজটির জন্য। কিন্তু আমার কোন অসুবিধা হয়নি। তবে সংসার আর গ্রামের বাড়ির দায়িত্ব ব্যালেন্স করতে এক ধরনের বেগ তো পেতেই হয়েছে। তবে আমি খুবই খুশি যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছিলাম। কারণ এই জার্নিটাকে আমি আনন্দময় করে নিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছে কাজটি না করলে একটি একটি বড় অংশের এতো সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে জানতেই পারতাম না।
মাসিদ রণ: এই কাজটি সমাজের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
মৌটুসী বিশ্বাস: ‘অতিথি’ প্রোজেক্টটিকে বলা হচ্ছে কমিউনিটি বেইজড সাসটেইবল টুরিজ্যম। অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন কমিউনিটিকে এখানে তুলে ধরা হবে। যার মাধ্যমে ভ্রমণপিপাসুরা তাদের ব্যাপারে উৎসাহী হবেন। এতে করে ওই কমিউনিটির জীবনযাত্রার মানে এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে যা সাময়িক সময়ের জন্য নয়। বছরের পর বছর এর সুফল তারা ভোগ করবেন। ফলে সমাজের জন্য এই কাজটি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ বুঝতেই পারছেন। রাজশাহীর বিভিন্ন কমিউনিটি নিয়ে আমরা কাজ করেছি। একটি উদাহরণ দিই, আমরা সাওতাল কমিউনিটিতে গিয়েছি। বিস্তারিতভাবে তাদের কালচার সম্পর্কে জেনেছি। অনেকেই তাদের সম্পর্কে জানতে চান কিন্তু সুযোগ-সুবিধার অভাবে তাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন না। আমার সেইসব মানুষের ব্রিজ হিসেবে কাজ করেছি। বিভিন্ন কমিউনিটির যতো ধরনের উৎকর্ষতা আছে তা তুলে ধরেছি।
এছাড়া আমরা রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, পুঠিয়া রাজবাড়ি, পদ্মাসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে কাজ করেছি। এসব মোটামুটি পরিচিত দেশের মানুষের কাছে। কিন্তু আমরা সবগুলোকেই নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরতে চেয়েছি যাতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আকর্ষণ তৈরি হয়। মোটকথা যারা রাজশাহী ভ্রমণ করবেন তাদের সঙ্গে এই বিভাগ এবং কমিউনিটিগুলোর যেন একটা বন্ধন তৈরি হয় সেই কাজটি করার চেষ্টা করেছি।
মাসিদ রণ: শুরুতে কি ভেবেছিলেন আপনাকেও ক্যামেরার সামনে আসতে হবে?
মৌটুসী বিশ্বাস: শুরুতে তো আমি একজন গবেষনাকর্মী হিসেবেই কাজ করছিলাম নিষ্ঠার সঙ্গে। ভেবেছিলাম, আমি ক্যামেরার পেছনেই কাজ করবো। অডিও ভিজ্যুয়ালে হয়তো অন্য মডেল আনা হবে। কিন্তু একটা পর্যায়ে ব্র্যাক থেকে আমাকে বলা হলো ক্যামেরার সামনেও থাকতে হবে। তখন বরং একটু জটিল লাগছিলো বিষয়টি আমার কাছে। কারণ একইসঙ্গে ক্যামেরার সামনে ও পেছনে কাজ করাটা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং কাজ। কিন্তু পরে কাজটি করেছি কারণ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের অংশ হওয়া খুবই আনন্দের।