‘নভেম্বর রেইন’ হয়তো আমার বেদনা আরও বাড়িয়ে দেবে: মৌটুসী
বর্ষাকাল পেরিয়ে শরৎ এসেছে বেশ আগে, কিন্তু এখনো হুট করে নেমে পড়ছে ঝুম বৃষ্টি। এই বৃষ্টিটাই শীত নামিয়ে দেয়- আমাদের দেশে এমন ধারণাই প্রচলিত। এই বৃষ্টি ‘নভেম্বর রেইন’ নামে পরিচিত, যার সঙ্গে সাহিত্য-সঙ্গীতের রয়েছে দারুণ যোগসূত্র। নভেম্বর আসতে আর বেশি বাকী নেই। তারই প্রাক্কালে জনপ্র্রিয় অভিনেত্রী মৌটুসী বিশ্বাস অংশ নিয়েছেন বার্তা২৪.কমের ‘নভেম্বর রেইন’ স্পেশ্যাল ফটোশুটে। সঙ্গে বলেছেন ‘নভেম্বর রেইন’ নিয়ে তার নস্টালজিয়া, চিন্তা-ভাবনার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসিদ রণ
মাসিদ রণ: আপনার কাছে ‘নভেম্বর রেইন’ আসলে কি?
মৌটুসী বিশ্বাস: মার্কিন রক ব্যান্ড ‘গানস এ্যান্ড রোজেস’-এর গান ‘নভেম্বর রেইন’ থেকেই তো টার্মটি বিশ্বব্যাপী চর্চিত হয়েছে। গানটিতে ‘নভেম্বর রেইন’কে বেদনা আর বিষন্নতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। নভেম্বরের হালকা শীতে যখন বৃষ্টি হয় তখন মনের ভেতরের একাকিত্ব কিংবা বহু দিনের জমানো কষ্ট বৃষ্টির সঙ্গে বেরিয়ে পড়তে চায় বলে অনেক কল্পনাপিপাসু মানুষ মনে করে থাকেন। এটা কেন জানি আমারও হয়। এর বাইরে ‘নভেম্বর রেইন’ জানান দেয় যে শীত বস্ত্র নামানোর সময় হয়েছে, নামিয়ে ফেলো (হাহাহা)।
মাসিদ রণ: ‘নভেম্বর রেইন’কে আপনি কিভাবে দেখেন?
মৌটুসী বিশ্বাস: ‘নভেম্বর রেইন’ গানে প্রেম-ভালোবাসার জটিল সমীকরণের কথা বলে। জীবনে যে কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয় সে কথাও মনে করিয়ে দেয়। জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমার তো প্রেম-ভালোবাসার কমপ্লেসিটি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। তবে এটা এখন খুব ভাবায় যে, জীবনে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সেটা ব্যক্তিজীবনে হতে পারে, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় নানা ক্ষেত্রেই হতে পারে। যেমন, আমরা ছোটবেলায় খেলার মাঠ পেয়েছি, এখন শহরের শিশুরা তা পায় না বললেই চলে। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, বাবা-মা দুজনই চাকরি করতেন। আমার বাবাকে দেখেছি, অন্তত ব্যাগ ভরে বাজার নিয়ে ঘরে ফিরতেন। নিয়মিত মাছ, মাংস খাওয়ার একটা চল ছিলো মধ্যবিত্ত পরিবারে। কিন্তু এখন দ্রব্যমূল্যের যে দাম তাতে সেটিও তারা পারছেন না।
আমার বাবা পুরোটা শিক্ষাজীবন সরকারি প্রতিষ্ঠানে শেষ করেছেন, সেই পড়াশুনা দিয়েই চট্টোগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। কিন্তু এখন অভিভাবকরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর সেই আস্থাটাই রাখতে পারেন না, কারণ সেখানকার শিক্ষার মান আস্থা রাখার মতো নয়। তাই অনেকেই অনেক কষ্ট করে হলেও বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন। আমার ছোটবেলায় দেখেছি স্কুলে প্রতি বছর সরস্বতী পুজো হতো। তাতে আমি সনাতনী ধর্মের হয়েও যতোটা না উৎসাহী থাকতাম তার চেয়ে বেশি উৎসাহ দেখেছি মুসলমান বন্ধুদের। কিভাবে সুন্দরভাবে পুজোটি শেষ করা যায় তা নিয়ে তাদের আন্তরিকতা মুগ্ধ করতো। ঈদের সময় আমিও মুসলমান বন্ধুদের বাড়িতে সেমাই খেতে অবশ্যই যেতাম।
কিন্তু ইদানিং পূজা মণ্ডপে হামলা, প্রতিমা ভাঙা, পুজোর আয়োজনে বাঁধা দেওয়াসহ কতো কি দেখতে পাই। কেমন যেন দেশের সবকিছু ভাগ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এটা কিন্তু একটি জাতির জন্য খুবই চিন্তার বিষয়। এই পরিবর্তনগুলো আমাকে এখন চিন্তিত করে। আবারও ভাবতে বাধ্য করে যে, সবকিছুই পরিবর্তন হয়, কিছুই স্থায়ী থাকে না, ভালোটাও না মন্দটাও না। এই যে, সংখ্যালঘুদের নানা ধরনের ভয় দেখানো হচ্ছে, এটাও চিরস্থায়ী হবে না। আবারও নতুন জোয়ার আসবে। আমাদের শুধু সব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়!
মাসিদ রণ: ‘নভেম্বর রেইন’-এর সঙ্গে আপনার জীবনের কোন যোগসূত্র আছে কি?
মৌটুসী বিশ্বাস: জীবনে কারোরই তো সবটা সময় ফুলে মোড়ানো হয় না। ছোট দুঃখ, বড় দুঃখ নিয়েই জীবন। নভেম্বর রেইন-এ ঘরে থাকলে বা একটু অবসরে থাকলে এই দুঃখবিলাশটা বেশি করে ভর করে নিজের ভেতর। এবার হয়তো আবেগের প্রকাশ আরও অণ্যরকম হবে। কারণ গত শীতেও বাবা ছিলেন, এবার তাকে ছাড়াই কাটবে! এখন আমার সারা সময়ের সঙ্গী বাবা হারানোর বেদনা। ‘নভেম্বর রেইন’ হয়তো সেই কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেবে।
মাসিদ রণ: আপনার শীতের ফ্যাশন নিয়ে জানতে চাই...
মৌটুসী বিশ্বাস: শীতের ফ্যাশন মানেই আমার কাছে টার্টল নেকের ফুলহাতা টি শার্ট। আর শীত মানেই আমার কাছে বুট জুতা। সব সময় ব্র্যাডের কাপড়, জুতা, ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে এটা মনে করি না। ব্র্যান্ড, নন ব্র্যান্ড সবই ব্যবহার করি। এমনকি জুতা কিনতে ফুটপাতের মার্কেটেও চলে যাই অনেক সময়। বিদেশে গেলেও সব ধরনের মার্কেটেই যাই। যেখান থেকে যেটা মনমতো হয় সেটাই কিনে ফেলি। এবার আমেরিকা থেকে বেশকিছু শপিং করা হয়েছে নিজের জন্য। শীতে সেগুলোই পরা হবে বেশি।
শুধু শীতে নয়, যে কোন সময় পোশাক নির্বাচনে আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিই কোথায় যাচ্ছি সেটার উপর। আমি যেহেতু লম্বা তাই বারো মাস ট্রাউজার পরতে ভালোবাসি। শীতে ট্রাউজারের কাপড়টা একটু মোটা হয় এই যা। এছাড়া মাফলারের কালচারের আমাদের বাবাদের আমলে শেষ হয়ে গেলেও আমি স্টোল মাফলারের মতো পেচিয়ে ব্যবহার করি। আর সাজগোজ এমনিতেই পছন্দ করি না শুটিং ছাড়া। তবে শীত এলে একটু ডার্ক কালারের লিপস্টিক দিতে ভালো লাগে।
মাসিদ রণ: শীতে বই পড়া হয় কতোটা?
মৌটুসী বিশ্বাস: কিশোর বয়সে শীতকালে লেপের মধ্যে ঢুকে ভূতের গল্প পড়াটাই ছিলো আমার সৌখিনতা। তবে বড়বেলায় বইয়ের জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে নেটফ্লিক্স। বই পড়ার ইচ্ছেটা রয়ে গেলেও অভ্যাসটা খানিকটা কমেছে। কারণ কাজের সূত্রে আমাকে ঢাকা, রাজশাহী আর খুলনা নিয়মিত যাতায়াত করতে হচ্ছে। তবে এবার শীতে চেষ্টা থাকবে বই পড়ার অভ্যাসটা ফেরত আনার। অনেক বই জমে গেছে, সেই বইগুলো শীতকালেই শেষ করতে চাই। গ্রামের বাড়ি খুলনাতেও কিছু বই রাখা আছে। গ্রামের বাড়ির বারান্দাটা বেশ বড়, বেতের চেয়ার রাখা আছে, রোদ আসে। সেখানে বসে বই পড়তে সত্যি খুব ভালো লাগে।
এখন ফিকশনের চেয়ে নন ফিকশনে বেশি আগ্রহই আমার। সেটা অটো বায়োগ্রাফি হোক বা প্রবন্ধ। এখন মাওলানা ভাসনিকে নিয়ে একটি বই পড়ছি। উনাকে একেবারেই নতুনভাবে জানার সুযোগ হচ্ছে। রবিশংকর বলের লেখা ‘দোজখনামা’ ধরেছিলাম কিছুদিন আগে। কিন্তু এই বইটা আমার খুব ধীর গতিতে পড়তে হচ্ছে। কিছু বই থাকে এমন, যা ধীরে ধীরে না পড়লে তার নির্যাসটা নিজের ভেতরে নেওয়া হয় না ঠিক করে। তেমনি একটি বই এলিফ শাফাকের ‘দ্য ফোরটি রুলস অব লাভ’। বইটি অনেক আগে গড়-গড়িয়ে পড়েছি একবার, কিন্তু এখন আবার পড়তে গিয়ে একদম নতুন সব অর্থ খুঁজে পাচ্ছি।