রবিশঙ্কর: শতবর্ষে সেতারের অলৌকিক ঝঙ্কার

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পণ্ডিত রবিশঙ্কর (১৯২০-২০১২)

পণ্ডিত রবিশঙ্কর (১৯২০-২০১২)

তার নাম আর সেতারের তারগুলো একাকার মিশে আছে অলৌকিক সুর-ঝঙ্কারে। কিংবদন্তিতুল্য সেতার বাদনে বিশ্বে আর কেউ তার সমতুল্য কখন হবে, কে জানে! দক্ষিণ এশিয়ার উপমহাদেশের সুরের আকাশ থেকে বিশ্বের দিগন্তে উজ্জ্বল হয়ে আছেন তিনি, রবিশঙ্কর, যার আদি শেকড় মিশে আছে বাংলাদেশের নড়াইল জেলার কালিয়ার সুমৃত্তিকায়। মঙ্গলবার (৭ এপ্রিল) তার জন্মশতবর্ষ ছুঁয়েছে ইন্দ্রজালিক সুরের মোহময়তায়।

১৯২০ সালে ভারতের বেনারসে জন্ম নিয়ে ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় মারা যান এই বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ। মৃত্যুর আগে গিনেস রেকর্ড বুকে সুদীর্ঘকাল বাদনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রেখে যান বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ, উপমহাদেশের নমস্য সঙ্গীতগুরু, মাইহার সঙ্গীত ঘরানার স্রষ্টা, আচার্য আলাউদ্দীন খানের এই প্রিয়ভাজন শিষ্য।

বিজ্ঞাপন

১৯৩৮ সালে, আঠারো বছর বয়সে রবিশঙ্কর তার বড় ভাই উদয়শঙ্করের নাচের দল ছেড়ে মাইহারে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অমর শিল্পী আচার্য আলাউদ্দীন খান সাহেবের কাছে সেতারের দীক্ষা নিতে শুরু করেন। দীক্ষা গ্রহণকালে আচার্যের পুত্র সরোদ শিল্পী ওস্তাদ আলি আকবর খানের সংস্পর্শে আসেন। তারা পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে সেতার-সরোদের যুগলবন্দী বাজিয়েছেন। গুরুগৃহে রবিশঙ্কর দীর্ঘ সাত বছর সেতারে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই শিক্ষাকাল পরিব্যাপ্ত ছিল ১৯৩৮ হতে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত।

রবিশঙ্কর ও আলি আকবর খান

১৯৩৯ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়সে ভারতের আহমেদাবাদ শহরে রবিশঙ্কর সর্বপ্রথম সাধারণের জন্য উন্মুক্ত একক সেতার পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন। তারপর ক্রমশ নিজেকে তুলে ধরেছেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীত স্রষ্টা, পারফর্মার এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মেধাবী দূত হিসেবে।

বিজ্ঞাপন

১৯৪৫ সালের মধ্যে রবিশঙ্কর সেতার বাদক হিসেবে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকারের স্বীকৃতি পেয়ে যান। এই সময়ে রবিশঙ্কর সাঙ্গীতিক সৃজনশীলতার অন্যান্য শাখায় পদচারণা শুরু করে সুর সৃষ্টি, ব্যালের জন্য সঙ্গীত রচনা এবং চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনার কাজে ব্যাপ্ত থাকেন। সেই সময়ের বিখ্যাত ‘ধরত্রী কি লাল’ এবং ‘নীচা নগর’ চলচ্চিত্র দুটির সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপ করেন তিনি।

১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত রবিশঙ্কর অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সঙ্গীত সৃষ্টিতে ব্যাপৃত ছিলেন। এ সময়ে তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি সত্যজিৎ রায়ের বিশ্বখ্যাত অপু ত্রয়ী অর্থাৎ ‘পথের পাঁচালি’ (১৯৫৫), ‘অপরাজিত’ (১৯৫৭) এবং ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯) চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা। পরবর্তীতে ‘চাপাকোয়া’ (১৯৬৬), ‘চার্লি’ (১৯৬৮) ও ‘গান্ধী’ (১৯৮২)-সহ আরও বহু চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি।

বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন রবিশঙ্কর। কনসার্টে সুরের ইন্দ্রজালে অবগাহন করিয়েছেন হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতাদের। পাশ্চাত্যের জনপ্রিয় ও উচ্চনাদ সমৃদ্ধ সঙ্গীতের আসরে প্রাচ্যের ধ্রুপদী সুরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি এক অদ্ভুত সুরের তন্ময়তায়।

পথের পাঁচালি ও অপুর সংসার ছবি দুটির পোস্টার

রবিশঙ্কর সমকালীন বিশ্বের প্রায়-সকল শ্রেষ্ঠ ও বিশিষ্ট শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন। একত্রে বহু অনুষ্ঠান করেছেন তাদের নিয়ে। তার অমর কীর্তির মধ্যে রয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের মিলন সাধন। বিশ্ব বিখ্যাত বেহালা বাদক ইয়াহুদি মেনুহিনের সঙ্গে সেতার ও বেহালার কম্পোজিশন তার স্মরণীয় অবদান, যাতে পূর্ব ও পশ্চিম জগতের সুর ও সঙ্গীতধারা অবিরলভাবে সমান্তরালে বয়ে চলেছে।

রবিশঙ্করের সঙ্গীত জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও ঐতিহাসিক কীর্তি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে প্রচার, জনমত গঠন ও মানবিক সহায়তা সংগ্রহের বিষয়টি। বিশ্ব বরেণ্য সঙ্গীত শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজিত 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' অনুষ্ঠানে সেতার বাজিয়েছিলেন তিনি, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে অবিস্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

সঙ্গীত জীবনে শিখরস্পর্শী সাফল্য অর্জন করলেও রবিশঙ্করের পারিবারিক জীবন ছিল মিলন ও বিচ্ছেদে ভরপুর। একুশ বছর বয়সে রবিশঙ্কর তার গুরু, যাকে তিনি বাবা বলে ডাকতেন, সেই আচার্য আলাউদ্দীন খানের মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবীকে বিয়ে করেন। এই দাম্পত্য জীবনে তাদের শুভেন্দ্র শঙ্কর নামে একটি পুত্র সন্তান জন্মায়। যদিও এই বিয়ে বিচ্ছেদে শেষ হয়।

পরে মার্কিন কনসার্ট উদ্যোক্তা স্যু জোন্স-এর সাথে স্বল্প সময়ের জন্য সম্পৃক্ত হন তিনি। নোরা জোন্স নামে তাদের একজন কন্যা সন্তান জন্ম নেয়, যে কন্যা জ্যাজ, পপ, আধ্যাত্মিক সঙ্গীত, লোকগানের বিশিষ্ট শিল্পী ও সুরকার রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

অবশেষে রবিশঙ্কর তার গুণগ্রাহী ও অনুরক্তা সুকন্যা খৈতানকে বিয়ে করেন। এই বিয়েতে তার আরেক কন্যা আনুশকা শঙ্করের জন্ম হয়। পিতার সংস্পর্শে ও শিক্ষায় তিনি সেতার বাজিয়ে হিসেবে সুনাম অর্জন করেন।

জীবন ও যাপনের অম্ল-মধুর দিনলিপিতে কত শত স্মৃতি-বিস্মৃতিতে ভেসে ভেসে পণ্ডিত রবিশঙ্করের শততম জন্মদিন সেতারের সুরেলা রাগ-অনুরাগের আবহে ঝঙ্কার জাগায় সঙ্গীত মনস্ক প্রতিটি মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে। তার আত্মজীবনী 'মাই মিউজিক মাই লাইফ'-এর পাতায় পাতায় যে বহতা জীবন ও সঙ্গীতচর্চার যুগল স্মৃতি মূর্ত হয়ে রয়েছে।