আনারকলির সেলিম, নূরজাহানের জাহাঙ্গীর

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, ছবি: সংগৃহীত

সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, ছবি: সংগৃহীত

১৬২৭ সালে চতুর্থ মুঘল সম্রাট নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর অস্থায়ী রাজধানী লাহোরে রাজদরবারে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত গরম আবহাওয়ায় তিনি দিনে দিনে ক্লান্ত ও অসুস্থ বোধ করায় অপেক্ষাকৃত শীতল এলাকা কাশ্মীরে যেতে মনস্থ করেন। কাশ্মীরের পথে তার শরীরের অবস্থা আরো অবনতি হয় এবং ২৮ অক্টোবর তিনি রাজৌরি নামক স্থানে পরলোক গমন করেন। ৫৮ বছর বয়সে মৃত সম্রাটকে পার্শ্ববর্তী ভিমবার নামক স্থানে একটি মসজিদের পাশে দ্রুত সমাহিত করা হয়, জায়গাটি বর্তমানে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অংশ।

মুঘল সম্রাটের মতো প্রতাপশালী ব্যক্তির সমাধি অচেনা জায়গায় অনাদরে থাকার বিষয়টি ছিল মধ্যযুগের পটভূমিতে অকল্পনীয়। অচীরেই তার মরদেহ লাহোরে এনে পুনঃসমাধিস্থ করা হয় এবং সম্রাজ্ঞি নূরজাহানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেখানে সুরম্য সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়। দশ বছরে মার্বেল পাথরে নির্মিত সৌধটি এখনো লাহোরের অন্যতম ল্যান্ডমার্ক।

বিজ্ঞাপন

১৫৬৯ সালে জন্ম নেওয়া এই সম্রাটের জনপ্রিয় নাম ছিল শাহজাদা সেলিম, যিনি আনারকলির সঙ্গে ট্র্যাজিক প্রেমের জন্য সমধিক পরিচিত। আনারকলি একজন নৃত্যশিল্পী বা সাধারণ রমণী ছিলেন বলে উল্লেখিত হলেও তার সম্পর্কে মুঘল ইতিহাসকারগণ রহস্যজনকভাবে নীরব। ১৯৬০ সালে নির্মিত বলিউডের স্মরণকালের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘মুঘল-ই-আজম’-এ সে কাহিনী করুণরসে চিত্রিত হয়েছে।

পিতা সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর ১৬০৫ সালে জাহাঙ্গীর মুঘল সিংহাসনে বসেন এবং ২২ বছর শাসন করেন। আনারকলি ছাড়াও প্রেমের জন্য তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। মেহেরুননেছা নামক আকবরের বাংলাবাসী বিদ্রোহী সেনাপতি শের আফগানের বিধবা স্ত্রীর প্রতি তিনি প্রেমাসক্ত হন। বাংলা থেকে মেহেরুননেছা ও তার কন্যাকে আগ্রার হেরেমে নিয়ে আসেন এবং তাকে ২০তম স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন। মেহেরুননেছার নাম হয় নূরজাহান বা ‘জগতের আলো’ এবং তিনি সকল স্ত্রীর মধ্যে সমাজ্ঞীর আসন লাভ করেন।

বিজ্ঞাপন

সম্রাট জাহাঙ্গীর নানা কারণে স্মরণীয়। তিনিই প্রথম মুদ্রায় নিজের মুখচ্ছবি উৎকীর্ণ করেন। উপমহাদেশে প্রথম মোটর গাড়ি এনে ব্যবহার করেন। ইউরোপীয় নানা শক্তির সঙ্গে সখ্যতা গড়েন এবং মিনিয়েচার শিল্পের মাধ্যমে ভারতের জীববৈচিত্র, প্রকৃতি ও পরিবেশের ছবি অঙ্কন করিয়ে রাখেন, যার মাধ্যমে সারা বিশ্ব বৈচিত্র্যময় ভারতের সন্ধান পায়।

সমাজ্ঞী নূরজাহান, যার ঐতিহ্যে মিশে ছিল পারস্যের সাংস্কৃতিক দ্যোতনা, সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় মসলিন কাপড় ও বিভিন্ন ধরনের রন্ধনের ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। বিরিয়ানি, রেজালা, আতর, পোষাকের ক্ষেত্রে বাহারী ডিজাইন ও নান্দনিক নকশার উদ্ভাবক তিনি। এমনকি, সম্রাটের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে শিকারে যেতেন তিনি। যেজন্য বিদেশ থেকে হান্টিং স্যুটও এনেছিলেন।

সম্রাট জাহাঙ্গীর অন্যান্য মুঘল সম্রাটের মতো যুদ্ধে বেশি সময় ব্যয় করেন নি। তিনি শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা ও আমোদ-প্রমোদে অধিক সময় ব্যয় করেন। তার মধ্যে শেষ বয়সে নেশাসক্তির প্রবণতা দেখা দিলে সম্রাটের নামে নূরজাহানই বাস্তবে শাসন পরিচালনা করতেন বলে কথিত আছে।

উপমহাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে মুঘলদের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ছাপ এখনো নানাভাবে স্পষ্ট । শুধু দিল্লি, আগ্রা বা উত্তর ভারত নয়, তা ছড়িয়ে আছে সমগ্র উপমহাদেশব্যাপী। লাহোরে অবস্থিত জাহাঙ্গীরের আইকনিক সমাধিসৌধও ইউনেস্কো’র বিশ্ব ঐতিহ্য রূপে স্বীকৃতি পেয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের স্মৃতি ছড়াচ্ছে।