করোনার তাণ্ডব ও ‘হনুজ, দিল্লি দূর অস্ত’



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
করোনায় মৃত্যুপুরী দিল্লি। ছবি- সংগৃহীত

করোনায় মৃত্যুপুরী দিল্লি। ছবি- সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

১৩২৪ সালের শীতকাল। বাংলা অভিযান শেষ করে দিল্লি অভিমুখে রওনা দিয়েছেন তৎকালের ভারতের অধিপতি, দিল্লি ও গৌড়-বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক। ফরমানও জারি করেছেন, সেখানে পৌঁছে যেন তিনি নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে আর দেখতে না পান। শুনে মুচকি হেসে সুফি দরবেশ বলেছিলেন, 'হনুজ, দিল্লি দূর অস্ত'। মানে, দিল্লি এখনো দূরে।

কেন দিল্লির দুর্বিনীত ও উদ্ধত শাসক গিয়াস উদ্দিন তুঘলক শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন সুফি সাধক নিজামউদ্দিন আওলিয়াকে? যুদ্ধরত দিল্লির সুলতান তাকে হত্যা করতে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছেন আর অন্যদিকে, শান্ত ও দৃঢ় নিজামউদ্দিন আউলিয়া কেবল এতটুকু বলেছিলেন, ‘হনুজ, দিল্লি দূর অস্ত’। দিল্লি এখনো দূরে।

ইতিহাসের পাতায় ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ আছে। মূলকথা হলো, সুলতান তুঘলক এরপর আর তার সাধের দিল্লি নগরীতে আসতে পারেননি। পথেই তার মৃত্যু হয়। আউলিয়া সাহেবের উচ্চারিত  'হনুজ, দিল্লি দূর অস্ত’ তথা দিল্লি এখনো দূরে, কথাটিই বাস্তবে সত্যে পরিণত হয় দাম্ভিক সুলতানের ভাগ্যে।

একটু পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, দিল্লির সিংহাসনে বসেছেন নতুন এক রাজা। নাম তার গাজি মালিক। সদ্যই বসেছেন তিনি দিল্লির মসনদে। মনমেজাজ তার ফুরফুরে। নিত্যনতুন ফরমান জারি করছেন। যেহেতু নতুন রাজা হয়েছেন, নামটাও তার নতুন হওয়া চাই। তাই তিনি হুকুম দিলেন, উপাধিসহ তার নতুন নাম হবে সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক। রাজার ইচ্ছে বলে কথা। চালু হয়ে গেল নতুন নাম। সেটা প্রায় ৭০০ বছর আগের কথা।

শুধু নামকরণ নয়, সেকালের রাজাদের মাথায় চাপত নানান রকমের খেয়ালখুশি। খেয়ালের বশেই অনেক রাজা করতেন যা খুশি তা-ই। এতে কার কী অসুবিধা হলো, তাতে তাদের ছিল থোড়াই পরোয়া। 

দিল্লির নতুন রাজারও শখ জাগল নতুন রাজধানী বানানোর। এ তো অন্য কারও নয়, রাজার শখ। তাই সভাসদ, পারিষদ, উজির-নাজির সবার এক ধ্যান। নতুন রাজধানী বানাতে হবে। হলোও তৈরি নতুন নতুন প্রাসাদ, কেল্লা এই সব। রাজার নামের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন রাজধানীর নাম দেয়া হলো তুঘলকাবাদ।

যে চারটি শহর নিয়ে আদি দিল্লি নগরী গড়ে উঠেছিল, তার একটি ছিল এটি। বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতাও এ কথা লিখেছেন তার ভ্রমণকাহিনিতে। যদিও জাঁকজমকের কোনোই অভাব ছিল না, কিন্তু রাজার মৃত্যুর বছর দুয়েকের মধ্যেই শহরটা পরিত্যক্ত হলো।

কেন টিকল না শহরটা, তা নিয়ে একটা কাহিনি এই ৭০০ বছর ধরে চালু আছে। তা হলো, নিজামউদ্দিন আউলিয়ার অভিশাপে শহরটা টেকেনি। তুঘলকাবাদ দুর্গ তৈরির সময় দিল্লির সব মজুরকে জোর করে কাজে লাগিয়েছিলেন রাজা। এই জবরদস্তি পছন্দ করেননি নিজামউদ্দিন আউলিয়া। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, 'ওই শহর টিকবে না'।

তুঘলক রাজার আমলে বাংলাদেশ ছিল ধনসম্পদে ভরা এক দেশ। সেকালে বাংলাদেশের সিলেট, সোনারগাঁ প্রভৃতি এলাকা ভ্রমণ করেছিলেন ইবনে বতুতা। যন্ত্রযান আবিষ্কৃত হওয়ার আগেকার পৃথিবীতে তার চেয়ে বেশি দেশ আর কেউই সফর করেননি। বাংলাদেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন: ‘সারা পৃথিবীতে আমি এমন কোনো দেশ দেখিনি, যেখানে জিনিসপত্রের মূল্য বাংলার চেয়ে কম।’

হাজার হাজার বছর আগে থেকেই বাংলার কাপড়, চিনি, মুক্তা প্রভৃতি রপ্তানি হতো সারা দুনিয়ায়। তাই বাংলার ওপর নজর পড়ল দিল্লির সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের। তিনি ঠিক করলেন, বাংলা দখল করবেন। রাজার কথা খণ্ডাবে কে? তলোয়ারের ঝনঝনানিতে কেঁপে উঠল দিল্লি-তুঘলকাবাদ। হাতি, ঘোড়া, সৈন্যসামন্তের মস্ত বাহিনী নিয়ে স্বয়ং রাজা রওনা দিলেন বাংলার দিকে। চারদিকে সাজ সাজ রব উঠল। শেষ পর্যন্ত রাজা পৌঁছালেন বাংলায়। সোনারগাঁ-লক্ষণাবতী-গৌড়ের শাসকদের বশে আনলেন। এভাবেই কবজা করলেন তিনি বাংলাকে।

অবশ্য খুব বেশিদিন দখলে রাখা যায়নি। বাংলায় কিছুকাল পরেই শুরু হয়েছিল স্বাধীন সুলতানদের রাজত্ব। তো, এই তুঘলক বংশের এক রাজার বাংলায় আগমন নিয়ে একটা গল্প চালু আছে। তা হলো, বাংলায় এসে ইলিশ খেয়ে সেই রাজা এমন মজাই পেলেন যে ইলিশ ছাড়া অন্য কিছু খেতেই চাইলেন না এবং শেষ পর্যন্ত ইলিশ খেতে খেতে মরেই গেলেন।

যা-ই হোক, বাংলা দখল করে সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের দিল্লি ফেরার সংবাদে আমোদ-উল্লাস আর তোরণ বানানোর ধুম পড়ে গেল। রাজধানীতে তখন অবস্থান করছিলেন রাজকুমার মুহম্মদ অর্থাৎ পরবর্তীকালের দিল্লির সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক। তো তুঘলক রাজারা যখন দিল্লির সুলতান অর্থাৎ রাজা হয়েছিলেন তখন খামখেয়ালির বশে যেসব কাণ্ডকারখানা করেছিলেন, তাতে আজও কোনো খামখেয়ালিপূর্ণ কাজকারবার দেখলে লোকে বলে তুঘলকি কারবার।

সেই তুঘলকি আমেজে বাংলা জয় করে সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক দিল্লি ফেরার পথে, তাকে বরণে প্রস্তুত যুবরাজ এবং পুরো দরবার। দিল্লির নিকটবর্তী আফগানপুরে রাজার সম্মানে নতুন বানানো মহলে এসে রাজা দুপুরের খাবারের জন্য বসলেন। আর যেইনা অন্যরা বাইরে গেছেন, অমনি হুড়মুড় করে মহলের ছাদ ভেঙে পড়ল চার পাঁচজন সঙ্গীসহ রাজার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গেই সঙ্গীদের নিয়ে মারা গেলেন রাজা। এই ঘটনা এমন হঠাৎ করে ঘটেছিল, কেউ ভাবতেও পারেনি যে এমন ঘটনাও ঘটতে পারে।

কিন্তু রাজার দিল্লি পৌঁছানো  যখন ছিল নিশ্চিত, তখনই নাকি নিজামউদ্দিন আউলিয়া প্রথমে বলেছিলেন, ‘দিল্লি দূর আস্ত’ অর্থাৎ দিল্লি অনেক দূরে এবং পরে বলেছিলেন, ‘হুনুজ দিল্লি দূর আস্ত’—মানে দিল্লি এখনো অনেক দূরে। এর অর্থ হলো, সবাই যখন ভেবেছিল দিল্লিতে তো তিনি পৌঁছাবেনই, কিন্তু নিজামউদ্দিন বুঝিয়েছিলেন, দিল্লি পৌঁছানো মোটেই সহজ নয়। এই কাহিনি থেকেই বাংলা ভাষায় ‘দিল্লি বহুদূর’ প্রবাদের প্রচলন হয়েছে। তবে যে কারণেই হোক বাংলা দখল করে ওই রাজার আর দিল্লি যাওয়া হয়নি। তার নিজের ও প্রিয় শহর তার কাছে দূরের অধরা শহর হয়েই রইলো।

মধ্যযুগের গতির তুলনায় সেই দিল্লি আর দূরের শহর নয়। দুই-আড়াই ঘণ্টার উড়ানে দিব্যি পৌঁছে যাওয়া যায় এই প্রাচীন শহরে। ফলে, বিশ্বায়নের নিকটবর্তী পৃথিবীতে 'হনুজ, দিল্লি দূর অস্ত'। মানে, দিল্লি এখনো দূরে, কথাটি অচল। শুধু কাছেই নয়, নানাভাবে দিল্লি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারেও সক্ষম, যার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ভালো-মন্দের প্রভাব বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও আলোচনার বিষয়।

যেমন কিছুদিন আগে প্রবলভাবে আলোচনায় এসেছিল দিল্লির পরিবেশ তথা বায়ু দূষণের বিষয়টি, যা দিল্লিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল শহরে পরিণত করেছে। সেই দিল্লি এখন করোনার তাণ্ডবে মৃত্যুপুরী। করোনায় বিশ্বের চরম বিপর্যস্ত দেশ ভারতের বিপন্নতম রাজধানী এখন দিল্লি।

গত কয়েক দিন ধরেই দিল্লিতে কোভিড রোগীদের মৃত্যুমিছিল অব্যাহত। ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহে দিল্লিতে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১২ জনেরও বেশি রোগির মৃত্যু হয়েছে। দিল্লির করোনা পরিস্থিতি যে কতটা সঙ্গীন, তা বোঝা যাচ্ছে আরও একটি তথ্যে। গত সপ্তাহে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৫ জন করে আক্রান্তের মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল। তবে চলতি সপ্তাহে সে সংখ্যাটা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। অক্সিজেনের জন্য চলছে হাহাকার। হাসপাতাল উপচে পড়ছে রোগি।

রোববার (২৫ এপ্রিল) দিল্লির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিগত ১৯ থেকে ২৪ এপ্রিল শহরে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৭৭৭ জন আক্রান্ত রোগি। অর্থাৎ, ঘণ্টাপ্রতি গড়ে ১২ জনেরও বেশি রোগি মারা গিয়েছেন। অন্য দিকে, গত সপ্তাহে ১২ থেকে ১৭ এপ্রিলের মধ্যে দিল্লিতে ৬৭৭ জনের মৃত্যু নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। প্রতি ঘণ্টার হিসাবে গড়ে যা ১০ জনের বেশি।

শুধু দিল্লি নয়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় ভারতের মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত-সহ একাধিক রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে। রাজধানী দিল্লিতেও নতুন সংক্রমণ দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে। কোভিড রোগিদের ভিড়ে দিল্লির হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের জায়গা নেই। করোনার চিকিৎসায় শুরু হয়েছে অক্সিজেনের হাহাকার। এই আবহে গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীতে ৩৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে কত দ্রুত গতিতে মৃত্যুমিছিল চলেছে, তা একটি পরিসংখ্যানে চোখ রাখলেই স্পষ্ট হয়। স্বাস্থ্য বুলেটিন অনুযায়ী, দিল্লিতে গড়ে ঘণ্টাপ্রতি মৃত্যুর হার হু হু করে বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে। দিল্লিতে মৃ্ত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি দৈনিক সংক্রমণের গতিকে বশে আনা যাচ্ছে না। চলতি সপ্তাহে তা ২৬.১২ থেকে ৩২.২৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে।

করোনা মানুষে মানুষে, এমনকি বাতাসেও ছড়ায় বলে বিশেষজ্ঞরা যে দাবি করছেন, তা ভয়ের কারণ। ইউরোপে একদেশের কঠিন করোনা পরিস্থিতি পার্শ্ববর্তী দেশেও বিপদ ডেকে এনেছিল। ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন পড়েছিল চরম বিপদে, করোনার যে বিপদ এখনো কেটে যায় নি। বরং ঘুরেফিরে আসছে।

ভারতের করোনার ভয়াল থাবাও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য অশনিসংকেত স্বরূপ। ফলে কঠিন ও এগ্রেসিভভাবে যদি সেফটি প্রটোকল না মানা হয়, তাহলে, বাংলাদেশে এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ভারতের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। এজন্য মাত্র সপ্তাখানেক লাগবে।

বিশেষত ভারতের সঙ্গে লোক চলাচল অব্যাহত থাকলে এবং সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মান্য না করা হলে মারাত্মক বিপদ নেমে আসতে পারে। এরই মাঝে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা শতকের ঘরে রয়েছে এবং আক্রান্তের হারও ঊর্ধমুখী। সামনেই ঈদ। ফলে উৎসবের আবহে মেলামেশা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কাও বেশি।

চূড়ান্ত সতর্ক না হলে অনিবার্য এক ট্রাজেডি বন্যার মত ধেয়ে আসতে পারে। কারণ,  ভারতে যে দুটো ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে- ডাবল বা ট্রিপল মিউটেশন ভাইরাস, তা সারাবিশ্বে বিস্ময় হিসেবে দেখা দিয়েছে। ভারতের এই ডাবল কিংবা ট্রিপল মিউটেশন ভাইরাস যেন কোনোভাবেই দেশে আসতে না পারে সেজন্য সবাইকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

কিন্তু মানুষ কতটুকু সতর্ক ও সচেতন? সমাজ ও মার্কেটের দিকে তাকালো এ প্রশ্ন আসতেই পারে। কারণ, দেখা যাচ্ছে সবাই মনের আনন্দে ও কেয়ারলেস ভঙ্গিতে সবকিছু করছে। যেন কোথাও কিছুই হয়নি!

এ কথা বলার কারণ হলো, রোববার (২৫ এপ্রিল) শপিংমল খুলবার আগেই যে ড্রেস রিহার্সাল ঢাকায় দেখা গেল, তাতে আতঙ্কিত হওয়ার মতো চিত্র দেখা গেছে। করোনার তাণ্ডবে দিল্লির নিদারুণ অভিজ্ঞতাটি কেউ গ্রাহ্য করছে বলেও মনে হয় না। বরং সবাই যেন ৭০০ বছর আগের মতোই ভাবছে, 'হনুজ, দিল্লি দূর অস্ত', দিল্লি এখনো দূরে।

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাস্তব পরিস্থিতি দিল্লির থেকে খুব দূরে নয়! তুঘলক বাদশাহর মাথায় ছাদ ভেঙে পড়ার মতো করোনার বিপদ যেকোনো সময় এসে আপতিত হতে পারে সবার মস্তকে। ফলে সকল স্তরে এবং সকলের কাছে সর্বাধিক সতর্কতা ও সাবধানতাই কাম্য।

   

'রিমাল'-এর ধ্বংসযজ্ঞ সয়ে কেমন আছে সুন্দরবন!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
সুন্দরবনে মৃত হরিণ / ছবি: বার্তা২৪

সুন্দরবনে মৃত হরিণ / ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ঘণ্টাপ্রতি ৮০ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি বেগে ধেয়ে আসছিল ঘূর্ণিঝড় রিমাল। সাগরে ঢেউয়ের উত্তাল রূপ এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী বাতাসের ধাক্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েই উপকূলীয় এলাকার মানুষজন। শনিবার (২৫ মে) থেকেই পাওয়া পূর্বাভাসে মানুষ বেশ বুঝতে পারছিল, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি বয়ে আনবে 'রিমাল'।

সৌভাগ্যবশত, বাংলাদেশকে বেষ্টিত করেছে আমাদের সুন্দরবন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নোনাপানি উপকূলের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন অতিক্রম করে যাওয়ার সময় রিমালের বেগ অনেকটাই শিথিল হয়ে আসে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপের দণ্ড নিজ মাথায় পেতে নিয়েছে সুন্দরবন। এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বনের অভ্যন্তরীণ চিত্র। পানিরে আধিক্যে ছেয়ে রয়েছে পুরো বন। ভাঙা-আধভাঙা গাছ লুটিয়ে পড়ে আছে। মিঠাপানির পুকুরে সমুদ্রের নোনাজল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন অফিসের অধিকাংশ টহল ফাঁড়ি ও বোট এবং সেইসঙ্গে যাতায়োতের পোল। ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে রয়েছে চালাঘরের টিন, দরজা, জানালা, সোলার প্যানেলসহ অবকাঠামোর বিভিন্ন অংশ।

এমনকী রিমালের ক্ষতির মূল্য দিতে হয়েছে বনে বসবাসকারী প্রাণীদেরও। ঘূর্ণিঝড়ের প্রবল তাণ্ডবে কেবল মানুষ নয়, প্রাণ হারিয়েছে অনেক অবলা প্রাণী।সর্বশেষে তথ্যমতে, সুন্দরবন থেকে ২৮টি মৃত হরিণ এবং ১ টি বন্য শুকরের দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। 

রবি-সোমবার (২৬ ও ২৭মে) রিমাল-এর তাণ্ডব চলে টানা ২০ ঘণ্টা। ঝড় শান্ত হওয়ার পর বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ পশুদের আহত এবং নিহতের এই সর্বশেষ খবর মঙ্গলবার নিশ্চিত করেছে। বনে বসবাসকারী অন্যান্য বহু পশু-পাখিরও মৃত্যু হয়েছে এই দুর্যোগে। এখনো অনেক আহত প্রাণী উদ্ধার কার্যে ব্যস্ত রয়েছেন বনরক্ষা কর্মীরা। এ পর্যন্ত ১৭ টি আহত হরিণ উদ্ধার করে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে বনরক্ষীরা। এরপর তাদের নিরাপদে বনে ফেরত পৌঁছে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও পশু আহত হয়েছে কিনা খোঁজ করা অব্যাহত রয়েছে। 

ঝড়ে অনবরত ভারী বর্ষণে তলিয়ে যায় সুন্দরবনের ভূমি। তাছাড়া, ঝড়ো হাওয়ার দাপটে উপড়ে গেছে বহু গাছ। প্রকৃতির এরকম পরিবেশের কারণেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অবলা প্রাণীগুলো!

;

উপকূলে ঝড়ের বিপদ সংকেত, ঢাকায় চিত্রকরের নীল মেঘ!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

উপকূলে চলছে ৩ নম্বর বিপদ সংকেত। দমকা বাতাসের তোড়ে সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ। আকাশে হৈ হৈ রব তুলে দখল করেছে কালো মেঘ। ছড়িয়ে দিচ্ছে গুড়ুম গুড়ুম ডাক! কয়েক ঘণ্টা বাদেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আসার সম্ভাবনা। তবে কথায় বলে, বাজ পড়ার আগে আকাশ শান্ত হয়ে যায়!

ঠিক যেন প্রকৃতি তার সেই রূপটিই মেলে ধরলো। উপকূল অঞ্চলগুলোতে মানুষজনকে সতর্ক করা হচ্ছে। ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ অথচ রাজধানীর আকাশ স্নিগ্ধ-কোমল!

শুধু কী তাই! ছবি আঁকার পর শিল্পী তার রঙ মাখা তুলিগুলো এলোমেলো করে ফেলে রাখে যেমন, সেই ছবি যেন আকাশে সেঁটে দিয়েছে কেউ। লাল, গোলাপি, কমলা, নীল, বেগুনি রঙের মিশ্রণে অপূর্ব সুন্দর এক এলোমেলো চিত্র উঁকি দিচ্ছে আকাশে। তার মাঝে ধূসর মেঘ ঘোলা জলে মাছের মতো দুরন্তপনায় ছুটে যাচ্ছে বহুদূর।

শনিবার (২৫ মে) গোধুলি লগ্নে ঢাকার আকাশ ঠিক এভাবেই রঙিন হয়ে ওঠে। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ রংধনুর ছোঁয়া ছাড়াই রঙিন পটচিত্রের রূপ মেলে ধরে গগন, যেন আকাশ নয়, কোনো চঞ্চলা কিশোরীর উৎফুল্ল মন! প্রকৃতি এখন স্তব্ধ হয়ে আছে। গাছের একটি পাতাও যেন নড়ছে না। অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরের অথৈ উম্মাদনা। স্থানীয়দের ভয়, জলোচ্ছ্বাসে যেন তাদের জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এমনি করেই প্রকৃতির বহুরূপী লীলাখেলা চলতে থাকে অবলীলায়।

;

বিখ্যাত মিমের ভাইরাল কুকুর কাবোসু আর বেঁচে নেই



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ভাইরাল কুকুর কাবোসু / ছবি: সংগৃহীত

ভাইরাল কুকুর কাবোসু / ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন মানুষ জুড়তে শুরু করলো ইন্টারনেটে নতুন অনেক নতুন উদ্ভাবনার দেখা মিললো। এমন এক ব্যাপার হলো মিম। বর্তমান সময়ে সেন্স অব হিউমারের (রসবোধ) এক অন্যতম মাধ্যম এই মিম। বিশেষত কোনো ছবি ব্যবহার করে তাতে হাস্যরসাত্মক কিছু জুড়ে দিয়ে এইসব মিমগুলো বানানো হয়।

২০১৩ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনই একটি ছবি ভাইরাল হয়। পরবর্তী সময়ে যা একটি বিখ্যাত ‘মিম ম্যাটেরিয়াল’-এ পরিণত হয়। কমলা-সোনালী এবং সাদা রঙের সম্বনয়ে বাহারি লোমের এই কুকুরটির নাম কাবোসু। কাবোসুর বয়স ১৯ বছর।

দুর্ভাগ্যবশত কুকুরটি আর বেঁচে নেই। ২৪ মে (শুক্রবার) দীর্ঘদিন ধরে রোগাক্রান্ত থাকার পর অবশেষে দেহ ত্যাগ করে কুকুরটি। কুকুরটির মালিক আতসুকো সাতো (৬২) জাপানের চিবা প্রিফেকচারের সাকুরা শহরের একটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক।শুক্রবার তার প্রকাশিত ব্লগে একটি দুঃখের কবিতা আবৃত্তির পর তিনি এই খবরটি নিশ্চিত করেছেন।

ভাইরাল কুকুর কাবোসু / ছবি: সংগৃহীত

১৯ বছর বয়সেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ২৬ মে রবিবার কাবোসুর স্মরণে একটি স্মরণ সভার আয়োজনও করা হবে। কুকুরটির মারা যাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকলে দুঃখ প্রকাশ করছে।

২০২২ সালে ক্রোানক লিম্ফোমা লিউকুমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। সেই থেকেই কাবোসুর চিকিৎসা চলছিল। তবে দুঃখের বিষয়, সে আর সুস্থ হয়ে ফিরতে পারলো না।

কাবোসুর ত্যাড়া চোখে দৃষ্টির একটি ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। এটি ইন্টারনেটে সবচেয়ে আইকনিক এবং স্বীকৃত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এমনকি ক্রিপ্টো কারেন্সির দুনিয়াতেও তার নাম ছিল।

;

বুদ্ধ পূর্ণিমার তাৎপর্য



অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা। বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এক মহান দিন এটি। এই দিনে গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। একই দিনে মহাজ্ঞানী বুদ্ধত্ব এবং বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। এই তিথিকে বলা হয় বৈশাখী পূর্ণিমা, যা আজ বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক ভেসাক ডে হিসেবে পালন করা হয়। বৈশাখ মাসের এই তিথিতে মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল। ত্রি-স্মৃতিবিজড়িত এ তিথির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যন্ত বিশাল।

খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে এই দিনে আড়াই হাজার বছর আগে মহামতি গৌতম বুদ্ধ ভারতবর্ষের তৎকালীন কপিলাবস্তু দেবদহ নগরের মধ্যবর্তী লুম্বিনী কাননে মাতা রানী মায়াদেবীর পিতৃগৃহে যাবার পথে শালবৃক্ষের নিচে জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে ৩৫ বছর বয়সে বোধিবৃক্ষমূলে কঠোর সাধনা বলে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে ৮০ বছর বয়সে একই দিনে ৪৫ বছর দুঃখ মুক্তির ধর্ম প্রচার করে কুশীনগরে যুগ্মশাল তরুণমূলে চিরনির্বাসিত হয়ে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন অর্থাৎ তিনি দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। পৃথিবীতে আর জন্মলাভ করবেন না। গৌতম বুদ্ধের পিতার নাম ছিল রাজা শুদ্ধধন ও গৃহী নাম ছিল সিদ্ধার্থ। ২৫২৭ বছর আগে ভারতবর্ষে যখন ধর্মহীনতা মিথ্যা দৃষ্টি সম্পন্ন বিশ্বাস্বে ধর্মে সমাজের শ্রেণি বৈষম্যের চরম দুরবস্থা ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত, প্রাণী হত্যায় চরম তুষ্টি ,তখন শান্তি মৈত্রী অহিংস সাম্য ও মানবতার বার্তা নিয়ে মহামতি বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে।

গৌতম বুদ্ধ অহিংস ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছেন। এই জীবজগৎ অনিত্য দুঃখ অনাত্মাময় প্রাণমাত্রই প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। অস্থায়ী বা অনিত্য কার্যতকারণের অধীন। তিনি জীবনের প্রগাঢ় খাটি চার আর্যসত্য আবিষ্কার করলেন। জগতে দুঃখ আছে, দুঃখের অবশ্যই কারণ আছে, দুঃখের নিবৃত্তি আছে, দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আছে। দুঃখ নিবৃত্তির উপায় হলো নির্বান লাভ। এই নির্বান লাভের ৮টি মার্গ আছে। যেমন সম্যক বা সঠিক দৃষ্টি , সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি। এই পথ পরিক্রমায় শীল সমাধি প্রত্তোয় নির্বাণ লাভের একমাত্র উপায়। সব প্রাণী সুখী হোক, পৃথিবীর সবচেয়ে পরম, মহৎ বাণী তিনি প্রচার করেছেন। শুধু মানুষের নয়, সব প্রাণ ও প্রাণীর প্রতি, প্রেম, ভালোবাসা, অহিংসা, ক্ষমা, মৈত্রী, দয়া, সহনশীলতা, সহমোর্মিতা, সহানুভূতি, মমত্ববোধ, প্রীতি, সাম্য, সম্প্রীতির কথা তিনি বলেছেন।

১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৫৪/১১৫ রেজুলেশন এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক ভেসাক ডে হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সেই থেকে এই দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ “ভেসাক ডে” হিসেবে পালন করে আসছে। বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র এই দিনকে বিভিন্ন নামে পালন করা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, নেপালে বুদ্ধ পূর্ণিমা, লাওসে বিশাখ পূজা, ইন্দোনেশিয়া হারি ওয়াইসাক ডে, মালয়শিয়ায় ওয়েসাক ডে, মায়ানমারে ফুল ডে অব কাসন, সিঙ্গাপুরে হারি ভেসাক ডে নামে পালন করে থাকে আবার কেউ বুদ্ধ জয়ন্তী দিবস হিসেবেও পালন করে থাকে।

জাতিসংঘের মহাসচিব এস্তেনিও গুতেরেজ ভেসাক ডে উপলক্ষে বলেছেন, “On the day of Vesak, Let us celebrate Lord Buddha’s wisdom by taking action for others with compassion and solidarity and by renewing our commitment to build a peaceful world.”

ফিলিস্তিনে আজ চরমভাবে মানবতা বিপন্ন হচ্ছে। অশান্তিময় এই পৃথিবীতে বুদ্ধের মৈত্রী, সংহতি, সাম্য, মানবতা ও শান্তির বাণী বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আজও প্রাসঙ্গিক এবং খুব প্রয়োজন। বিশ্ব আজ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। পরিবেশ দূষণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, জলাবদ্ধতা, বৃক্ষ নিধন, বন উজাড়, জীব বৈচিত্র্য হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন এই সবুজ গ্রহের ইতিহাসে নজিরবিহীন। গৌতম বুদ্ধই প্রথম বৃক্ষকে এক ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট জীবরূপে আখ্যায়িত করেছেন। বুদ্ধ ছিলেন বিশুদ্ধ পরিবেশবাদী দার্শনিক। পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। তাই বুদ্ধের জন্ম বুদ্ধত্ব লাভ ও মহা পরিনির্বাণ বৃক্ষের পদমূলের বিশুদ্ধ পরিবেশ মন্ডিত পরিবেশে সংগঠিত হয়েছিল।

এই পবিত্র দিনে বৌদ্ধরা বিভিন্ন দেশে দেশে সব প্রাণীর সুখ শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা করেন। অশান্ত পৃথিবীতে পরিবেশ সংরক্ষণে বুদ্ধের বাণী নীতি ও আদর্শ বিশ্ব মানবতার শিক্ষা, দর্শন, চিন্তা চেতনা ,ভাবনা সুন্দর, শান্ত, সাম্যময় পৃথিবী গড়ার বিকল্প নাই। সব প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করুক।

অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া
চিকিৎসক, লেখক, সংগঠক ও গবেষক

;