অন্ধ হয়েও জীবনযুদ্ধে হার না মানা মৃত্যুঞ্জয়

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম সুনামগঞ্জ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের পুরাতন কর্ণগাঁও গ্রামের গাউ মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস (৩০)। ১২ বছর বয়সেই বাম চোখ অন্ধ হয়ে যায় তার। হতদরিদ্র মৃত্যুঞ্জয় চোখের চিকিৎসা করাতে না পারায় এক পর্যায়ে অন্ধত্ব বরণ করতে হয় তাকে।

তবে জীবনযুদ্ধে হার মানেননি তিনি। চোখে দেখতে না পেলেও নিপুণ হাতের মননশীলতার ছোঁয়ায় করে চলেছেন বাঁশ ও বেতের কাজ। তৈরি করছেন কুলা, চাটাই, চাঙারি, টুকরি, উড়া, ডালা, চালুনি, মাছ শিকারের খলই, ঝুঁড়ি ও হাঁস মুরগির খাঁচাসহ বাঁশ ও বেতের নানান জিনিস। তার পরিবারের কোনো সদস্যকে এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না। 

বিজ্ঞাপন

জীবন সংগ্রামে অদম্য লড়াকু মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে অনেকেই হতচকিত হয়ে পড়েন। প্রবল ইচ্ছা শক্তি আর কঠোর পরিশ্রমে মৃত্যুঞ্জয় হাল ধরেছেন সংসারের। হস্ত ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেন পিতা বীরেন্দ্র বিশ্বাস ও মা সুচিত্রা বিশ্বাস। 

বছরখানেক আগে বিয়ে করেছেন মৃত্যুঞ্জয়। বর্তমানে স্ত্রী, ছোট ভাই আর বৃদ্ধ বাবা মাকে নিয়েই তার সংসার।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, ১২ বছর বয়স মৃত্যুঞ্জয়ের দুই চোখে ব্যাথা হতো। চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র পরিবারের পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় নি। ১৫ বছর আগে সম্পূর্ণভাবে চোখের আলো হারিয়ে ফেলেন তিনি। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধিতা তাকে জীবন যুদ্ধে হার মানাতে পারে নি।

তিনি মনের শক্তি হারাননি কখনো। বললেন, আমি চোখে না দেখলেও বাঁশ ও বেতের কাজ আয়ত্ব করতে পেরেছি। আমার এলাকায় আমার চেয়ে ভালভাবে এই কাজ করতে পারে না, শুনেছি। নিজে দেখতে না পারলে মানুষের এবং ক্রেতাদের প্রশংসা শুনে ভালো লাগে আমার।


মৃত্যুঞ্জয় বলেন, ‘ছোটবেলায় মাথা গোজারই ঠাই ছিল না, টাকার অভাবে চোখের চিকিৎসাও করাতে পারি নি। এখন চোখের রগ শুকিয়ে গেছে। ডাক্তার বলছেন, এখন আর চোখ ভালো হবে না।’

তিনি বলেন, ‘আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী, চোখে দেখি না। তবে সৃষ্টিকর্তা আমাকে কাজ করার শক্তি দিয়েছেন। ছোট করে হলেও কাজ করে খেতে পারি। কারও কাছে হাত পাততে হয় না। তাই ভালোই আছি। একটি ঘরও হয়েছে, শরীরে অসুখ বিসুখ না হলে কাজ করে হাজার খানেক টাকা রোজগার করতে পারি।’


মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের কর্ণগাঁও গ্রামে পৈত্রিক বাড়িতে বাস করছেন। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই সঞ্জয় বিশ্বাস দিরাই শহরের একটি মিষ্টির দোকানে কাজ করেন। দারিদ্রতার কারণে স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি মৃত্যুঞ্জয়ের। অভাবের তাড়নায় ছোট থেকেই কর্মজীবনে জড়িয়ে পড়েন।

মৃত্যুঞ্জয় বলেন, ভিক্ষা করা, মানুষের কাছে হাত পেতে কিছু নেওয়া আমি পছন্দ করি না। চোখের আলো হারিয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম। তবে হাল ছাড়ি নি। কিছু করার অদম্য ইচ্ছা থেকে এ পর্যন্ত এসেছি। কাজ করে খাওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। সমাজে সবার সঙ্গে আনন্দ নিয়ে থাকা যায়।


তিনি বলেন, বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসগুলো বাজারে নিয়ে যেতে পারি না, পাইকাররা বাড়ি থেকে এসে নেওয়ায় ন্যায্য দাম পাই না। শহরে নিজের একটি দোকান থাকলে এসব জিনিসের চাহিদাও বেশি হতো, উপযুক্ত মূল্যও পেতাম। কিন্তু শহরে নিজের দোকান দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই।

জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুচিত্রা রায়  বললেন, প্রতিবন্ধিতা যে প্রতিবন্ধকতা নয় সেটি মৃত্যুঞ্জয় বুঝিয়ে দিয়েছেন, নিজের জীবনটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন তিনি। আমরা অবশ্যই তার জন্য সরকারি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেব। উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে এই সংগ্রামী মানুষকে ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় নিয়ে আসা যায়। যেহেতু সে বাঁশ বেতের কাজ করে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন মানোন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণ দিয়ে অনুদান দেবার ব্যবস্থা করা যায়। আমরা অবশ্যই সরকারি সহায়তা দেবার চেষ্টা করবো তাকে।