মেডেলিনে তাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ‘গ্রিন করিডোর’
কলম্বিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ নগরী মেডেলিনে ‘গ্রিন করিডোর’ প্রকল্প শহরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশগত সুবিধার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হচ্ছে। এ প্রকল্পের অধীনে পুরো শহর জুড়ে গাছের শীতল ছায়ার ব্যবস্থা করেছে দেশটি।
মেডেলিনকে ‘বসন্তের শহর’ বলা হয়। মেডিলিনের নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু সারা বছরই পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। নতুন নির্মিত ভবন ও রাস্তাগুলো তাপ শোষণ করে ধরে রাখে। তবে স্থানীয় সরকারী তথ্য অনুসারে, নতুন গ্রিন করিডোরগুলো শহর জুড়ে ২ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হ্রাস করেছে।
কলম্বিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মেডেলিনে বায়ু দূষণ ও ক্রমবর্ধমান তাপ নিয়ে উদ্বেগের কারণে ২০১৬ সালে "গ্রিন করিডোর" প্রোগ্রাম শুরু হয়। ৩০ টিরও বেশি সবুজ করিডোর রয়েছে এ শহরে। করিডোরগুলো নতুন রাস্তার প্রান্ত, উদ্যান, পার্ক এবং নিকটবর্তী পাহাড়গুলোকে সংযুক্ত করেছে। প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পে শহর জুড়ে প্রায় ১ লক্ষ ২০হাজার গাছ লাগানো হয়। ১২ হাজার ৫০০ টি গাছ রাস্তা ও পার্কে রোপন করা হয়। এছাড়া আরো ২৫ লক্ষ ছোট গাছের চারা রোপন করা হয়। ২০২১ সালের মধ্যে শহর জুড়ে ৮ লক্ষাধিক বড় গাছ রোপন করা হয়।
স্থানীয় সরকারের মতে, প্রকল্পটি জন্য প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় ১৬.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২ সালে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৬ লক্ষ২৫ হাজার মার্কিন ডলার।
ওইসিস কাস্ত্রো যিনি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে শহরের ওরিয়েন্টাল অ্যাভিনিউয়ের একটি স্ট্যান্ডে ফল বিক্রি করেন। কয়েক দশক আগের কথা মনে করে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার একটি ট্রাফিক প্রকল্পের কাজের সময় রাস্তার সারিবদ্ধ গাছগুলো উপড়ে ফেলেছিল।
কাস্ত্রো বলেন, বর্তমানেও ওরিয়েন্টাল অ্যাভিনিউ রাস্তাটি ট্রাফিক ও বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখন রাস্তার দুপাশে বড় বড় ফল গাছ, ফুল গাছ ও ঝোপঝাড়ে সবুজ এলাকায় পরিণত হয়েছে।
এখানকার তাপমাত্রা সারা বছরই উপভোগ্য মনে হয়। শহরের যেসব অঞ্চলে বেশি গাছপালা নেই সেসব জায়গার তুলনায় অনেক সতেজ থাকে এই এলাকা। সাইকেল লেনের দুপাশে সারিবদ্ধ গাছের পাশে বেঞ্চগুলোতে পথচারীরা বিশ্রাম নিতে পারেন।
শহরের তাপমাত্রা কমিয়ে শীতল করার জন্য প্রকল্পটি এখন বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বায়ুর গুণগত মান উন্নয়নে ভালো কাজ করছে। এটি শহরে বন্যপ্রাণী ফিরিয়ে এনেছে।
একটা সময় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উচ্চ তাপপ্রবাহ নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে শহরগুলোতে।
সবুজ করিডোরের প্রতি মেডেলিনের দৃষ্টিভঙ্গি একটি কম খরচে, জনপ্রিয় সমাধান দেয় যা অন্যান্য শহরগুলি ক্রমবর্ধমানভাবে প্রতিলিপি করতে চাইছে। এটি কি ভবিষ্যতের একটি জলবায়ু-স্থিতিশীল শহরের জন্য একটি মডেল হতে পারে?
মেডেলিন কম খরচে ‘গ্রিন করিডোর’ প্রকল্পের মাধ্যমে তাপ প্রবাহ কমানোর একটা জনপ্রিয় সমাধান দেয়। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের তাপপ্রবাহ কমাতে মেডেলিনকে অনুসরণ করছে। মেডেলিনকে ভবিষ্যতের জলবায়ু-স্থিতিশীল শহরের জন্য একটি মডেল ভাবা হয়।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার মতে, মেডেলিনের বায়ুদূষণের মাত্রা পিএম ২.৫। বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা ডব্লিউএইচও জানায়, পিএম২.৫ নামে পরিচিত ছোট ও বিপজ্জনক বায়ুবাহিত কণার গড় বার্ষিক ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়।
যাইহোক, শুষ্ক মৌসুমে যখন শহরটিতে বৃষ্টিপাত হ্রাসের কারণে বায়ুর অবস্থার সবচেয়ে খারাপ সময়ের মুখোমুখি হয় তখন মেডেলিন বায়ুর গুণমান সূচক (একিউআই) পিএম২.৫ এর ৫৫ µg/m3-এ পৌঁছাতে পারে। যখন দূষণ ৩৮ µg/m3-এর বেশি হয়ে যায়, তখন উপত্যকার প্রারম্ভিক সতর্কতা ব্যবস্থা স্বরুপ গাড়ি ব্যবহারে বিধিনিষেধ দিতে পারে।
২০১৫-১৬ সালে আমরা বায়ু দূষণের শীর্ষে পৌঁছেছিলাম বলে জানিয়েছেন সে সময়কার মেডেলিনের স্থানীয় অবকাঠামো সচিব পাওলা প্যালাসিও। তিনি বলেন, পরিবেশগত সমস্যায় এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল।
২০২০ সালে মেডেলিনের অ্যান্টিওকিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালে আবুরা উপত্যকা অঞ্চলে দূষণের কারণে ১হাজার ৯৭১ জনের অকালমৃত্যু ঘটেছে। যানবাহন থেকে ধোয়া নির্গমনের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে দূষণের কারণে মৃত্যু উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
গবেষকরা বলছেন, গ্রিন করিডোরে ব্যবহৃত গাছগুলো এই বিপজ্জনক কণার বিরুদ্ধে বাধা হিসাবে কাজ করে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দূষণ শোষণ করে নেয়।
মেডেলিন প্রকল্পে ব্যবহৃত কিছু প্রজাতির গাছ দূষণ শোষণে বিশেষভাবে দক্ষ বলে পরিচিত।
গ্রিন করিডর প্রকল্প বায়ু দূষণ কতটা কমিয়েছে তা নিয়ে কোনো সামগ্রিক সমীক্ষা বা পর্যালোচনা এখনও দেখা যায়নি। তবে গবেষকরা বলছেন, এর প্রভাব অধ্যয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, গবেষণা ফলাফল ২০২৪ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত হবে।
৩০টি গ্রিন করিডোরের পাশাপাশি, প্রায় ১২৪ টি পার্কও প্রকল্পের অংশ হিসেবে করিডোর দ্বারা সংযুক্ত হয়েছে। শহর জুড়ে সবুজের এই বৃদ্ধি জলবায়ুর ওপর একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অ্যান্টিওকিয়ার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়, এই পার্কগুলোর মধ্যে মাত্র দুটি, নুটিবারা এবং ভোলাডোর পাহাড় বায়ুমণ্ডল থেকে প্রতি বছর ৪০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) অপসারণ করে থাকে।