বিপ্লবের মহানায়ক



প্রদীপ কুমার দত্ত
বিপ্লবের মহানায়ক

বিপ্লবের মহানায়ক

  • Font increase
  • Font Decrease

মহানায়ক শব্দটি বাঙালি মানসে ছবির জগতে অবিসংবাদিত শীর্ষস্থানীয় উত্তমকুমারকে মনে করিয়ে দেয়। তিনি ছিলেন রূপালী পর্দায় তুলনাহীন। আজও তা-ই আছেন। তবে আমরা আজ স্মরণ করছি দেশমাতৃকার সেবায় আত্মোৎসর্গ করা এক জনগণমন অধিনায়ককে। তিনি বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অত্যাচার ও নাগপাশ থেকে মুক্তির দিশারী, পরাধীনতার জিঞ্জির ছিন্ন করার উদাহরণ সৃষ্টিকারী, লাখো কোটি ভারত উপমহাদেশের তরুণ-তরুণীর জীবনে আদর্শের আলোকবর্তিকা, আমাদের চট্টগ্রামের বীর সন্তান মাস্টরদা সূর্য সেন।

আজ তার ফাঁসি দিবস। ১৯৩৪ এর ১২ জানুয়ারি ইংরেজ শাসকরা চট্টগ্রাম জেলখানার ফাঁসির মঞ্চে তার অত্মাচারে জর্জরিত মৃতপ্রায় নশ্বর দেহকে ঝুলিয়ে জীবনাবসান ঘটায়। একই সঙ্গে তার অন্যতম প্রধান সহযোগী বিপ্লবী নেতা তারকেশ্বর দস্তিদারকেও একইভাবে সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে প্রাণবিয়োগ ঘটায়। নিজের জীবন দিয়ে সূর্য সেন মৃত্যুঞ্জয় হয়ে গেলেন। সারা ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায় মুক্তিকামী জনতার তিনি হয়ে উঠলেন চোখের মণি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকালে এবং যুদ্ধকালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মন মানসে যেসকল বীর বিপ্লবী গভীর প্রভাব ফেলে তাদের অনুপ্রাণিত করতেন তাদের মধ্যে মাস্টারদা ছিলেন অন্যতম।

বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত করে ছলে বলে কৌশলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শ’খানেক বছর ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের ঔপনিবেশিক ও ব্যবসায়িক নির্মম শোষণ চালায়। একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হয়েও তারা ব্রিটিশ রাজ সরকারের সনদ বলে বাণিজ্য করা, নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠন করে বাণিজ্য সুরক্ষার স্বার্থে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া এবং দখলকৃত এলাকায় নিজ শাসন ও কর ব্যবস্থা চালু করে যেকোনও উপায় অবলম্বন করে সেই কর আদায় করাই ঔপনিবেশিক শাসনমূলক কাজে ব্যাপৃত হয়। শ’খানেক বছরের মধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ ভারত উপমহাদেশে নিজ কর্তৃত্ব কায়েম করে তারা এদেশের অঢেল সম্পদ লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হয়। ফলশ্রুতিতে তাদের বিরুদ্ধে জন অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে এবং ১৮৫৭ তে সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে সেই অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

কোম্পানির সেনা এবং তাদের মিত্র কোনও কোনও দেশীয় করদ রাজ্যের তৎপরতারয় সেই বিদ্রোহ কায়ক্লেশে দমন করলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারল না। ব্রিটিশ রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত করা হলো ভারতবর্ষকে। তাতে আমাদের পিতৃপুরুষেরা সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের সৃষ্ট স্থানীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসন শোষণের বেড়াজালে দৃঢ়তর ভাবে আবদ্ধ হলেন। উচ্চশিক্ষিত, অর্থবান ও দেশপ্রেমিক ভারতীয়রা স্বদেশবাসীর অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। কিছু ব্রিটিশ সচেতন ব্যক্তিবর্গও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠনে সাথে থাকলেন। কংগ্রেস ব্রিটিশ ভারতের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দাবিদাওয়া পেশ, দেন-দরবার এবং সময়ে সময়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন চালাতে লাগলো।

কংগ্রেস সৃষ্টির ২০ বছর পর প্রতিষ্ঠিত হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম দল মুসলিম লীগ। ইতোমধ্যে দেশের তরুণ সমাজের এইসকল রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটল। তারা মনে করলেন শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে অত্যাচারী বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান অসম্ভব। শুরু হলো দেশমুক্তির নতুন অধ্যায় অগ্নিযুগ। এই ধারায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল বাংলা এবং পাঞ্জাবের যুবসমাজ। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র, উধম সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, আসসফাকুল্লা, রামপ্রসাদ বিসমিল, বীর সাভারকার প্রমুখের নেতৃত্বে দুঃসাহসিক সশস্ত্র আঘাত হানতে থাকেন এই বিপ্লবী দেশমাতৃকার সেবকরা। একটু একটু করে ভিত কেঁপে উঠতে থাকে ব্রিটিশ শাসকদের। সাথে সাথে বৃহত্তর পরিসরে রাজনৈতিক আন্দোলনও চলতে থাকে ঔপনিবেশিক শোষণমুক্ত স্বায়ত্তশাসনের জন্য। এর মাঝেই শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।

এক পর্যায়ে ব্রিটিশ ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের আহ্বান জানান মহাযুদ্ধে তাদের মিত্র শক্তিকে সমর্থন জানানোর। বিনিময়ে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যুদ্ধ জয় শেষে তারা ভারতীয় উপমহাদেশকে স্বশাসনের দিকে নিয়ে যাবেন। ভারতীয়রা নিজেদের মুক্তির সংগ্রাম স্থগিত রেখে দলে দলে যুদ্ধে গেলো। যুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে থাকল। হতাশাগ্রস্ত ভারতীয় নেতারা নতুন করে আন্দোলন সংগঠিত করতে শুরু করলেন। গান্ধীজীর নেতৃত্বে দেশ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে ফুঁসে উঠল। মওলানা ভ্রাতৃদ্বয় মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী চালু করলেন খেলাফত আন্দোলন। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে এই দুই আন্দোলন পাশাপাশি চলে বৃটিশদের ঘুম হারাম করে দিল। কিন্তু চতুর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নানা উপায়ে বিপথে চালিত করে আন্দোলন দুটিকে দুর্বল করে আনতে লাগল। আবারও মোহমুক্তি ঘটল দেশের যুবসমাজের। তারা পুনরুজ্জীবিত করলেন পূর্বেকার সশস্ত্র সংগ্রামের ধারা।

এই সময়েই দেশের অন্যান্য জায়গার মত বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল চট্টগ্রামেও। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ গোবেচারা স্কুলশিক্ষক যিনি চট্টগ্রামবাসীর কাছে মাস্টারদা নামে পরিচিত, সেই সূর্য কুমার সেন নেতৃত্বভার নিলেন অগ্নিযুগের একটি অধ্যায়ের বিপ্লবীদের। আসলে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মাস্টারদা নিজেই তিল তিল করে গড়ে তুললেন এই কিশোর -যুবা মুক্তিকামী বাহিনী। নাম দিলেন তার ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি (চট্টগ্রাম শাখা)। মাস্টারদার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গতানুগতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসনের মূল উৎপাটন করা যাবে না।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থেকে মুক্তির উপায় সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। এই ব্যাপারে মহানায়ক অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ১৯১৬ সালে সংঘটিত আইরিশ বিদ্রোহের ইতিহাস পড়ে।এই বিদ্রোহের আরেক নাম ইস্টার বিদ্রোহ। ১৯১৬ সালের ইস্টার সপ্তাহ চলাকালীন আইরিশ মুক্তিকামীরা জনগণকে সংগঠিত করে রাজধানী ডাবলিন ও আয়ারল্যান্ডের অন্যান্য শহরে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্র কায়েম করা। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে জন্ম নেওয়া প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রজাতান্ত্রিক দল সিন ফেইন (যেটি এখনও আয়ারল্যান্ডের অন্যতম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল) ও অন্য সকল ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি চাওয়া আইরিশ দল এই বিদ্রোহে অংশ নেয়। তারা সেইবার সফল না হলেও আয়ারল্যান্ড, ব্রিটিশ শাসনাধীন অন্য সব দেশ ও পৃথিবীর মুক্তিকামী সকল জাতির মধ্যে অনুপ্রেরণা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।

মাস্টারদা সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের মুক্তির জন্য জীবনপণ সংগ্রামের পথে এগোতে উদগ্রীব তার বাহিনীকে প্রস্তুত করলেন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের জন্য। তিনি নিজে এই বিপ্লবী সংগ্রামকে চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহ নামেও অভিহিত করেছেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ছিল ইস্টার সপ্তাহের গুড ফ্রাইডে। ঐ দিনকেই তিনি ধার্য করেন অভ্যুত্থানের তারিখ হিসেবে।

বিপ্লবী নেতার দলভুক্ত দেশমাতৃকার জন্য প্রাণপাতের শপথ নেওয়া তরুণদের মধ্য থেকে ৬৪ জনকে তিনি বেছে নিলেন সেই দিনের মহান কর্মকাণ্ডের জন্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি দল ধুম স্টেশনের কাছে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অপর একটি দল টেলিগ্রাফ অফিস দখলে নিয়ে চট্টগ্রামের সাথে বহির্বিশ্বের টেলিযোগাযোগ ছিন্ন করে। আরেক দল দখলে নেয় অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্রাগার। ইস্টার উপলক্ষে ক্লাব বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম ক্লাব আক্রমণ শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়। মূল দল দখলে নেয় চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন এবং এর অস্ত্রাগার। চট্টগ্রাম হয়ে গেল বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত।

যদিও সেটা সাময়িক। সর্বাধিনায়ক মাস্টারদাকে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি (চট্টগ্রাম শাখা) মুক্ত এলাকার প্রধান হিসেবে গার্ড অব অনার প্রদান করে। ব্রিটিশ শাসনের প্রতিভু সকল ইংরেজরা প্রাণ বাঁচাতে কর্ণফুলী নদী ও নিকটবর্তী বঙ্গোপসাগরে নোঙর করা জাহাজে আশ্রয় নেয়। চট্টগ্রাম হয়ে যায় বৃটিশ শাসনের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন এলাকা। মাস্টারদা জানতেন অচিরেই শক্তিশালী ব্রিটিশরা প্রবল আক্রমণ হানবে যা তার অতি ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে মোকাবিলা সম্ভব হবে না। তিনি চেয়েছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের জনগণকে দেখাতে যে ইংরেজরা অপরাজেয় নয়। তারা যেন জেগে ওঠেন এবং সর্বশক্তি দিয়ে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটান। মুক্তির সূর্য ছিনিয়ে আনেন।

পুলিশ লাইন দখলের পর যখন তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফল হলো তখন মাস্টারদা তার ক্ষুদ্র কিন্তু নৈতিকভাবে বলীয়ান ও সদ্য বিজয়ী বাহিনীকে নিয়ে শহরের অদূরবর্তী জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান নিলেন। তখন ১৯ এপ্রিল ভোর। তারা তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি নিতে লাগলেন আসন্ন ভয়ংকর যুদ্ধের। জালালাবাদ পাহাড়ের গা ঘেঁসে চলে গেছে রেললাইন। ২১ তারিখে একটি ট্রেন এসে থামলো পাহাড়ের নিচে। সারি ধরে ট্রেন থেকে নামলো ইংরেজদের সেনাদল। যুদ্ধ আসন্ন। মাস্টারদা লোকনাথ বলকে নিয়োগ করলেন সেদিনের সেনাপ্রধান। নেতার পরামর্শ নিয়ে লোকনাথ নামলেন অসম যুদ্ধে। শত্রুদের সংখ্যা ও অস্ত্র অনেকগুণ বেশি ও উন্নততর। অপরদিকে বিপ্লবীদের ছিল পাহাড়ের ওপরে থাকার অবস্থানগত সুবিধা। হাতেগোনা কয়েকজন বিপ্লবী মরণপণ লড়ে গেলেন কয়েকশ' প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনার বিরুদ্ধে। তাদের মন্ত্র লড়েঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। জালালাবাদ পাহাড় দখল করতে পারলো না ইংরেজ সেনাদল। বিফল মনোরথ হয়ে পশ্চাদপসরণ করে ট্রেনে উঠে ফিরে গেল তারা। সেদিনের যুদ্ধে জয়ী কিন্তু শ্রান্ত,ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত মাস্টারদার বাহিনী একত্রিত হয়ে নিজেদের পক্ষে সেই যুদ্ধে বীর শহীদ ১২ জনকে সামরিক কায়দায় দিল শেষ বিদায়।মহানায়ক বুঝলেন যে পরবর্তী দিন আরও বেশি শক্তি নিয়ে পুনঃআক্রমণে আসবে শত্রুসেনারা। তাদের অস্ত্র ও রসদের কোনও সরবরাহ পাওয়ার সুযোগ নেই।

তিনি পরবর্তী নির্দেশনা দিলেন অনুগামীদের। তারা যেন রাতের মধ্যেই সহানুভূতিশীল এলাকাবাসীদের সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যায় এবং গেরিলা পদ্ধতিতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জন যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তারা তাই করলেন। ১৯৩৩ এর ফেব্রুয়ারিতে মাস্টারদা লোভী বিশ্বাসঘাতক এক মীরজাফর নেত্র সেনের কারণে আটক হওয়ার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড দিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইংরেজদের রাতের ঘুম হারাম করে রাখেন বিপ্লবীরা। ১৯৩৩এ তিনি আটক হওয়ার পরও কয়েক বছর তার অনুগামীরা নিজেদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রাখেন।

এদিকে শুরু হয় মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের প্রহসনমূলক বিচার। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মাত্র দশ মাসের মধ্যেই বিচার, আপিল ও হাইকোর্টের কার্যক্রম শেষ করে তাদের উভয়কেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুর আগে প্রচন্ড অত্যাচারে তাদের মৃতপ্রায় করে আক্রোশ মেটায় বর্বর ব্রিটিশরা। ১২ জানুয়ারি তাদের মৃতপ্রায় দেহকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে রায় বলবৎ করা হয়। জীবিত সূর্য সেনের চাইতে মৃত সূর্য সেনও ইংরেজদের কাছে কম ভয়ের পাত্র ছিলেন না। তাই সভ্য জগতের রীতিনীতির বরখেলাপ করে মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের মরদেহ তাদের আত্মীয় ও নিকটজনদের কাছে হস্তান্তর না করে জাহাজে তুলে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে ভারী ওজন মৃতদেহের সাথে বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

১১ জানুয়ারি তার বিদায়ী বার্তায় মহানায়ক অনুগামীদের নির্দেশ দেন তারা যেন দেশমাতৃকার মুক্তির সেবায় আত্মোৎসর্গ করা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি যেমন মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে তার অসমাপ্ত কাজ অনুগামীদের কাছে হস্তান্তর করে যাচ্ছেন, তেমনি তারাও যেন সফল না হওয়া পর্যন্ত এই ধারা অনুসরণ করেন।

তার দেশমাতৃকার মুক্তির সোপানতলে আত্মবলিদানের এই দিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। মাস্টারদা এবং চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ নিয়ে বহু নিবন্ধ ও বইপত্র লেখা হয়েছে। তার ও তার দলের কীর্তি গাঁথা সম্পর্কে তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ। অনেক প্রকাশনায় এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ বা ইস্টার বিদ্রোহ না বলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন বলে উল্লেখ করা হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক ভুল। লুণ্ঠন তস্করের কাজ। ইংরেজরা ঐ নামেই মহানায়ক সূর্য সেন ও তার সহযোগীদের নামে মামলা করেছিল। ইংরেজরাই আমাদের শোষণ ও লুণ্ঠন করে সম্পদের পাহাড় নিজেদের দেশে পাচার করেছে। আমাদের সম্পদে কেনা অস্ত্র দিয়ে আমাদের মেরেছে। তার কিয়দংশ বিপ্লবীরা দখলে নিয়েছেন। আমরা সেই কাজকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন না বলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল বলবো না কেন?

মাস্টারদার সম্মানে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এবং কিছু ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান নামকরণ করা হয়েছে। তার একটি আবক্ষমূর্তি চট্টগ্রাম জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয়েছে। সেটি অবশ্য করেছিলেন ১৯৭৪ এ তার কয়েকজন সহযোদ্ধা কলকাতা থেকে এসে। ভারতে বিভিন্ন জায়গায় তার নামে ভবন, স্ট্যাচু, মেট্রোরেল স্টেশন, রাস্তা, স্কোয়ার ইত্যাদির নামকরণ করা হয়েছে। আমাদের দেশেও এই মহানায়কের স্মরণে উল্লেখযোগ্য রাস্তা এবং প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি। এতে আমাদের এই গর্ব করার মত পূর্বসূরির প্রতি সম্মান জানানো যেমন হবে, তেমনি নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা যাবে। তাদের করা যাবে ইতিহাস সচেতন। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানোর সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া সিংহপুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেন... লও লও লও সালাম।

   

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর। প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পগেছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;