বিপ্লবের মহানায়ক
মহানায়ক শব্দটি বাঙালি মানসে ছবির জগতে অবিসংবাদিত শীর্ষস্থানীয় উত্তমকুমারকে মনে করিয়ে দেয়। তিনি ছিলেন রূপালী পর্দায় তুলনাহীন। আজও তা-ই আছেন। তবে আমরা আজ স্মরণ করছি দেশমাতৃকার সেবায় আত্মোৎসর্গ করা এক জনগণমন অধিনায়ককে। তিনি বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অত্যাচার ও নাগপাশ থেকে মুক্তির দিশারী, পরাধীনতার জিঞ্জির ছিন্ন করার উদাহরণ সৃষ্টিকারী, লাখো কোটি ভারত উপমহাদেশের তরুণ-তরুণীর জীবনে আদর্শের আলোকবর্তিকা, আমাদের চট্টগ্রামের বীর সন্তান মাস্টরদা সূর্য সেন।
আজ তার ফাঁসি দিবস। ১৯৩৪ এর ১২ জানুয়ারি ইংরেজ শাসকরা চট্টগ্রাম জেলখানার ফাঁসির মঞ্চে তার অত্মাচারে জর্জরিত মৃতপ্রায় নশ্বর দেহকে ঝুলিয়ে জীবনাবসান ঘটায়। একই সঙ্গে তার অন্যতম প্রধান সহযোগী বিপ্লবী নেতা তারকেশ্বর দস্তিদারকেও একইভাবে সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে প্রাণবিয়োগ ঘটায়। নিজের জীবন দিয়ে সূর্য সেন মৃত্যুঞ্জয় হয়ে গেলেন। সারা ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায় মুক্তিকামী জনতার তিনি হয়ে উঠলেন চোখের মণি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকালে এবং যুদ্ধকালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মন মানসে যেসকল বীর বিপ্লবী গভীর প্রভাব ফেলে তাদের অনুপ্রাণিত করতেন তাদের মধ্যে মাস্টারদা ছিলেন অন্যতম।
বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত করে ছলে বলে কৌশলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শ’খানেক বছর ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের ঔপনিবেশিক ও ব্যবসায়িক নির্মম শোষণ চালায়। একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হয়েও তারা ব্রিটিশ রাজ সরকারের সনদ বলে বাণিজ্য করা, নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠন করে বাণিজ্য সুরক্ষার স্বার্থে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া এবং দখলকৃত এলাকায় নিজ শাসন ও কর ব্যবস্থা চালু করে যেকোনও উপায় অবলম্বন করে সেই কর আদায় করাই ঔপনিবেশিক শাসনমূলক কাজে ব্যাপৃত হয়। শ’খানেক বছরের মধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ ভারত উপমহাদেশে নিজ কর্তৃত্ব কায়েম করে তারা এদেশের অঢেল সম্পদ লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হয়। ফলশ্রুতিতে তাদের বিরুদ্ধে জন অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে এবং ১৮৫৭ তে সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে সেই অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
কোম্পানির সেনা এবং তাদের মিত্র কোনও কোনও দেশীয় করদ রাজ্যের তৎপরতারয় সেই বিদ্রোহ কায়ক্লেশে দমন করলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারল না। ব্রিটিশ রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত করা হলো ভারতবর্ষকে। তাতে আমাদের পিতৃপুরুষেরা সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের সৃষ্ট স্থানীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসন শোষণের বেড়াজালে দৃঢ়তর ভাবে আবদ্ধ হলেন। উচ্চশিক্ষিত, অর্থবান ও দেশপ্রেমিক ভারতীয়রা স্বদেশবাসীর অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। কিছু ব্রিটিশ সচেতন ব্যক্তিবর্গও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠনে সাথে থাকলেন। কংগ্রেস ব্রিটিশ ভারতের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দাবিদাওয়া পেশ, দেন-দরবার এবং সময়ে সময়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন চালাতে লাগলো।
কংগ্রেস সৃষ্টির ২০ বছর পর প্রতিষ্ঠিত হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম দল মুসলিম লীগ। ইতোমধ্যে দেশের তরুণ সমাজের এইসকল রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটল। তারা মনে করলেন শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে অত্যাচারী বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান অসম্ভব। শুরু হলো দেশমুক্তির নতুন অধ্যায় অগ্নিযুগ। এই ধারায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল বাংলা এবং পাঞ্জাবের যুবসমাজ। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র, উধম সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, আসসফাকুল্লা, রামপ্রসাদ বিসমিল, বীর সাভারকার প্রমুখের নেতৃত্বে দুঃসাহসিক সশস্ত্র আঘাত হানতে থাকেন এই বিপ্লবী দেশমাতৃকার সেবকরা। একটু একটু করে ভিত কেঁপে উঠতে থাকে ব্রিটিশ শাসকদের। সাথে সাথে বৃহত্তর পরিসরে রাজনৈতিক আন্দোলনও চলতে থাকে ঔপনিবেশিক শোষণমুক্ত স্বায়ত্তশাসনের জন্য। এর মাঝেই শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
এক পর্যায়ে ব্রিটিশ ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের আহ্বান জানান মহাযুদ্ধে তাদের মিত্র শক্তিকে সমর্থন জানানোর। বিনিময়ে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যুদ্ধ জয় শেষে তারা ভারতীয় উপমহাদেশকে স্বশাসনের দিকে নিয়ে যাবেন। ভারতীয়রা নিজেদের মুক্তির সংগ্রাম স্থগিত রেখে দলে দলে যুদ্ধে গেলো। যুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে থাকল। হতাশাগ্রস্ত ভারতীয় নেতারা নতুন করে আন্দোলন সংগঠিত করতে শুরু করলেন। গান্ধীজীর নেতৃত্বে দেশ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে ফুঁসে উঠল। মওলানা ভ্রাতৃদ্বয় মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী চালু করলেন খেলাফত আন্দোলন। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে এই দুই আন্দোলন পাশাপাশি চলে বৃটিশদের ঘুম হারাম করে দিল। কিন্তু চতুর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নানা উপায়ে বিপথে চালিত করে আন্দোলন দুটিকে দুর্বল করে আনতে লাগল। আবারও মোহমুক্তি ঘটল দেশের যুবসমাজের। তারা পুনরুজ্জীবিত করলেন পূর্বেকার সশস্ত্র সংগ্রামের ধারা।
এই সময়েই দেশের অন্যান্য জায়গার মত বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল চট্টগ্রামেও। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ গোবেচারা স্কুলশিক্ষক যিনি চট্টগ্রামবাসীর কাছে মাস্টারদা নামে পরিচিত, সেই সূর্য কুমার সেন নেতৃত্বভার নিলেন অগ্নিযুগের একটি অধ্যায়ের বিপ্লবীদের। আসলে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মাস্টারদা নিজেই তিল তিল করে গড়ে তুললেন এই কিশোর -যুবা মুক্তিকামী বাহিনী। নাম দিলেন তার ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি (চট্টগ্রাম শাখা)। মাস্টারদার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গতানুগতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসনের মূল উৎপাটন করা যাবে না।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থেকে মুক্তির উপায় সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। এই ব্যাপারে মহানায়ক অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ১৯১৬ সালে সংঘটিত আইরিশ বিদ্রোহের ইতিহাস পড়ে।এই বিদ্রোহের আরেক নাম ইস্টার বিদ্রোহ। ১৯১৬ সালের ইস্টার সপ্তাহ চলাকালীন আইরিশ মুক্তিকামীরা জনগণকে সংগঠিত করে রাজধানী ডাবলিন ও আয়ারল্যান্ডের অন্যান্য শহরে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্র কায়েম করা। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে জন্ম নেওয়া প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রজাতান্ত্রিক দল সিন ফেইন (যেটি এখনও আয়ারল্যান্ডের অন্যতম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল) ও অন্য সকল ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি চাওয়া আইরিশ দল এই বিদ্রোহে অংশ নেয়। তারা সেইবার সফল না হলেও আয়ারল্যান্ড, ব্রিটিশ শাসনাধীন অন্য সব দেশ ও পৃথিবীর মুক্তিকামী সকল জাতির মধ্যে অনুপ্রেরণা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।
মাস্টারদা সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের মুক্তির জন্য জীবনপণ সংগ্রামের পথে এগোতে উদগ্রীব তার বাহিনীকে প্রস্তুত করলেন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের জন্য। তিনি নিজে এই বিপ্লবী সংগ্রামকে চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহ নামেও অভিহিত করেছেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ছিল ইস্টার সপ্তাহের গুড ফ্রাইডে। ঐ দিনকেই তিনি ধার্য করেন অভ্যুত্থানের তারিখ হিসেবে।
বিপ্লবী নেতার দলভুক্ত দেশমাতৃকার জন্য প্রাণপাতের শপথ নেওয়া তরুণদের মধ্য থেকে ৬৪ জনকে তিনি বেছে নিলেন সেই দিনের মহান কর্মকাণ্ডের জন্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি দল ধুম স্টেশনের কাছে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অপর একটি দল টেলিগ্রাফ অফিস দখলে নিয়ে চট্টগ্রামের সাথে বহির্বিশ্বের টেলিযোগাযোগ ছিন্ন করে। আরেক দল দখলে নেয় অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্রাগার। ইস্টার উপলক্ষে ক্লাব বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম ক্লাব আক্রমণ শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়। মূল দল দখলে নেয় চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন এবং এর অস্ত্রাগার। চট্টগ্রাম হয়ে গেল বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত।
যদিও সেটা সাময়িক। সর্বাধিনায়ক মাস্টারদাকে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি (চট্টগ্রাম শাখা) মুক্ত এলাকার প্রধান হিসেবে গার্ড অব অনার প্রদান করে। ব্রিটিশ শাসনের প্রতিভু সকল ইংরেজরা প্রাণ বাঁচাতে কর্ণফুলী নদী ও নিকটবর্তী বঙ্গোপসাগরে নোঙর করা জাহাজে আশ্রয় নেয়। চট্টগ্রাম হয়ে যায় বৃটিশ শাসনের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন এলাকা। মাস্টারদা জানতেন অচিরেই শক্তিশালী ব্রিটিশরা প্রবল আক্রমণ হানবে যা তার অতি ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে মোকাবিলা সম্ভব হবে না। তিনি চেয়েছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের জনগণকে দেখাতে যে ইংরেজরা অপরাজেয় নয়। তারা যেন জেগে ওঠেন এবং সর্বশক্তি দিয়ে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটান। মুক্তির সূর্য ছিনিয়ে আনেন।
পুলিশ লাইন দখলের পর যখন তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফল হলো তখন মাস্টারদা তার ক্ষুদ্র কিন্তু নৈতিকভাবে বলীয়ান ও সদ্য বিজয়ী বাহিনীকে নিয়ে শহরের অদূরবর্তী জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান নিলেন। তখন ১৯ এপ্রিল ভোর। তারা তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি নিতে লাগলেন আসন্ন ভয়ংকর যুদ্ধের। জালালাবাদ পাহাড়ের গা ঘেঁসে চলে গেছে রেললাইন। ২১ তারিখে একটি ট্রেন এসে থামলো পাহাড়ের নিচে। সারি ধরে ট্রেন থেকে নামলো ইংরেজদের সেনাদল। যুদ্ধ আসন্ন। মাস্টারদা লোকনাথ বলকে নিয়োগ করলেন সেদিনের সেনাপ্রধান। নেতার পরামর্শ নিয়ে লোকনাথ নামলেন অসম যুদ্ধে। শত্রুদের সংখ্যা ও অস্ত্র অনেকগুণ বেশি ও উন্নততর। অপরদিকে বিপ্লবীদের ছিল পাহাড়ের ওপরে থাকার অবস্থানগত সুবিধা। হাতেগোনা কয়েকজন বিপ্লবী মরণপণ লড়ে গেলেন কয়েকশ' প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনার বিরুদ্ধে। তাদের মন্ত্র লড়েঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। জালালাবাদ পাহাড় দখল করতে পারলো না ইংরেজ সেনাদল। বিফল মনোরথ হয়ে পশ্চাদপসরণ করে ট্রেনে উঠে ফিরে গেল তারা। সেদিনের যুদ্ধে জয়ী কিন্তু শ্রান্ত,ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত মাস্টারদার বাহিনী একত্রিত হয়ে নিজেদের পক্ষে সেই যুদ্ধে বীর শহীদ ১২ জনকে সামরিক কায়দায় দিল শেষ বিদায়।মহানায়ক বুঝলেন যে পরবর্তী দিন আরও বেশি শক্তি নিয়ে পুনঃআক্রমণে আসবে শত্রুসেনারা। তাদের অস্ত্র ও রসদের কোনও সরবরাহ পাওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি পরবর্তী নির্দেশনা দিলেন অনুগামীদের। তারা যেন রাতের মধ্যেই সহানুভূতিশীল এলাকাবাসীদের সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যায় এবং গেরিলা পদ্ধতিতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জন যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তারা তাই করলেন। ১৯৩৩ এর ফেব্রুয়ারিতে মাস্টারদা লোভী বিশ্বাসঘাতক এক মীরজাফর নেত্র সেনের কারণে আটক হওয়ার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড দিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইংরেজদের রাতের ঘুম হারাম করে রাখেন বিপ্লবীরা। ১৯৩৩এ তিনি আটক হওয়ার পরও কয়েক বছর তার অনুগামীরা নিজেদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রাখেন।
এদিকে শুরু হয় মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের প্রহসনমূলক বিচার। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মাত্র দশ মাসের মধ্যেই বিচার, আপিল ও হাইকোর্টের কার্যক্রম শেষ করে তাদের উভয়কেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুর আগে প্রচন্ড অত্যাচারে তাদের মৃতপ্রায় করে আক্রোশ মেটায় বর্বর ব্রিটিশরা। ১২ জানুয়ারি তাদের মৃতপ্রায় দেহকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে রায় বলবৎ করা হয়। জীবিত সূর্য সেনের চাইতে মৃত সূর্য সেনও ইংরেজদের কাছে কম ভয়ের পাত্র ছিলেন না। তাই সভ্য জগতের রীতিনীতির বরখেলাপ করে মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের মরদেহ তাদের আত্মীয় ও নিকটজনদের কাছে হস্তান্তর না করে জাহাজে তুলে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে ভারী ওজন মৃতদেহের সাথে বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
১১ জানুয়ারি তার বিদায়ী বার্তায় মহানায়ক অনুগামীদের নির্দেশ দেন তারা যেন দেশমাতৃকার মুক্তির সেবায় আত্মোৎসর্গ করা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি যেমন মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে তার অসমাপ্ত কাজ অনুগামীদের কাছে হস্তান্তর করে যাচ্ছেন, তেমনি তারাও যেন সফল না হওয়া পর্যন্ত এই ধারা অনুসরণ করেন।
তার দেশমাতৃকার মুক্তির সোপানতলে আত্মবলিদানের এই দিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। মাস্টারদা এবং চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ নিয়ে বহু নিবন্ধ ও বইপত্র লেখা হয়েছে। তার ও তার দলের কীর্তি গাঁথা সম্পর্কে তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ। অনেক প্রকাশনায় এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ বা ইস্টার বিদ্রোহ না বলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন বলে উল্লেখ করা হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক ভুল। লুণ্ঠন তস্করের কাজ। ইংরেজরা ঐ নামেই মহানায়ক সূর্য সেন ও তার সহযোগীদের নামে মামলা করেছিল। ইংরেজরাই আমাদের শোষণ ও লুণ্ঠন করে সম্পদের পাহাড় নিজেদের দেশে পাচার করেছে। আমাদের সম্পদে কেনা অস্ত্র দিয়ে আমাদের মেরেছে। তার কিয়দংশ বিপ্লবীরা দখলে নিয়েছেন। আমরা সেই কাজকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন না বলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল বলবো না কেন?
মাস্টারদার সম্মানে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এবং কিছু ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান নামকরণ করা হয়েছে। তার একটি আবক্ষমূর্তি চট্টগ্রাম জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয়েছে। সেটি অবশ্য করেছিলেন ১৯৭৪ এ তার কয়েকজন সহযোদ্ধা কলকাতা থেকে এসে। ভারতে বিভিন্ন জায়গায় তার নামে ভবন, স্ট্যাচু, মেট্রোরেল স্টেশন, রাস্তা, স্কোয়ার ইত্যাদির নামকরণ করা হয়েছে। আমাদের দেশেও এই মহানায়কের স্মরণে উল্লেখযোগ্য রাস্তা এবং প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি। এতে আমাদের এই গর্ব করার মত পূর্বসূরির প্রতি সম্মান জানানো যেমন হবে, তেমনি নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা যাবে। তাদের করা যাবে ইতিহাস সচেতন। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানোর সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া সিংহপুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেন... লও লও লও সালাম।