আহিল-ওয়াকিল এখনো জানে না মা বেঁচে নেই

  • তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আহিল-ওয়াকিল

আহিল-ওয়াকিল

নানু বাড়ির উঠানে আপন মনে খেলছে দুই ভাই। কখনো আবার এক দৌড়ে ঢুকে যাচ্ছে ঘরের ভেতরে। বাড়িতে যেই আসছেন ‘ফুলের মতো’ দুই ভাইকে কোলে তুলে নিয়ে করছেন আদর। ব্যক্তিগত শোক লুকিয়ে দুই ভাগ্নেকে হাসিখুশি রাখার সব চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন মামা-খালারাও। আব্রারুল আমিন আহিল আর আঝফারুল আমিন ওয়াকিল নামের দুই ভাইকে ঘিরে সবার এতটা ব্যাকুলতা তার একটাই কারণ। আচমকা এক ঝড় যে দুই শিশুর জীবন থেকে মাকে আলাদা করে দিয়েছে। এখন চাইলেও আর কখনো মায়ের বুকে ঘুমাতে পারবে না তারা।

দুই ছেলে আর স্ত্রী তাহমিনা আক্তারকে নিয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার খাগরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মোহাম্মাদ হুমায়ুন আমিন রিংকুর ছিল সুখের সংসার। সেই সংসারে আজ অজস্র দুঃখের আনাগোনা। ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে রিংকুর প্রিয়তমা স্ত্রী তাহমিনা যে চলে গেছেন পরপারে। স্ত্রীকে বাঁচাতে কম চেষ্টা করেননি রিংকু। নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের মুম্বাই শহরে। ভর্তি করিয়েছিলেন সুশ্রুত হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্রে। সেখানেই রোববার (২২ জানুয়ারি) রাত ৮টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তাহমিনা। জীবনের শেষ মুহূর্তে প্রিয় সন্তানদের সঙ্গেও দেখা হলো না মায়ের, হবে না আর কোনোদিন।

বিজ্ঞাপন

মাঝে মাঝে অসুস্থ হলেও কখনো তাহমিনা আক্তারের স্বাস্থ্য তেমন একটা খারাপের দিকে যায়নি। আপাত দৃষ্টিতে ‘সুস্থ’ সেই শরীরের ভেতরেই যে কবে গোপনে বাসা বেঁধে ফেলেছে মরণঘাতী ব্ল্যাড ক্যানসার কেউ বুঝে উঠতে পারেননি, আঁচ করেননি তাহমিনাও। যখন জানতে পারলেন ততদিনে বহু দেরি হয়ে গেছে। গত ২৩ নভেম্বর হঠাৎ অতিরিক্ত রক্তপাত হলে তাহমিনাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। একগাদা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল ব্ল্যাড ক্যানসারে আক্রান্ত তাহমিনা। প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিন-চারদিন চিকিৎসা নিয়ে মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেন তাহমিনা। পরে আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে ১০ দিন ধরে চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। এরই মধ্যে পাসপোর্ট-ভারতীয় ভিসা প্রস্তুত করা হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে ১৩ জানুয়ারি তাহমিনাকে নিয়ে মুম্বাই যান স্বামী আর স্বজনেরা। সুশ্রুত হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়ে মোটামুটি সুস্থতার দিকে ফিরছিলেন তাহমিনা। চিকিৎসকেরাও দিচ্ছিলেন ভরসা। কিন্তু গত বুধবার অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। রোববার দ্রুতই সেটি আরও খারাপের দিকে চলে যায়। যেখান থেকে আর ফিরতে পারেননি তাহমিনা।

মা, যে আর নেই সেটি বলা হয়নি দুই শিশু সন্তানকে। অবশ্য ৮ বছরের আহিল আর চার বছরের ওয়াকিলের সেটি বোঝারও বয়স এখনো হয়নি। তারা এখনো জানে, ‘মায়ের অসুখ হয়েছে, অসুখ ভালো হলে ফিরে আসবে।’

বিজ্ঞাপন
বাবার সঙ্গে আহিল-ওয়াকিল

হঠাৎ বোন হারিয়ে পাগলপ্রায় মুবিনুল হক। অন্য দশটা পিঠাপিঠি বয়সের ভাই-বোনের মতো তাহমিনা আর মুবিনুলের মাঝেও ছোটকালে ছিল দুষ্টুমির মারামারি, একে অপরকে খোঁচানো আবার দ্রুতই সব ভুলে গলায় গলায় ভাবের কত শত গল্প। বোনকে হারানোর পর বোনের সঙ্গে কাটানো সেই সব মুর্হূতগুলো এখন যেন চোখের পাতায় ছায়াছবির মতো ভেসে ভেসে আসছে মুবিনুলের।

শোকের সব শব্দ জড়ো করে মুবিনুল বললেন, ‘জীবনে বোন জিনিসটা কি, সেটা যাদের নেই তারাই শুধু বুঝতে পারে। যখন বোনটার বিয়ের কথা হচ্ছিল, তার আগে মক (মজা) করে বলছিলাম তোর জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাচ্ছি। কিন্তু বিয়ের দিন বুঝতে পারি কি হারাচ্ছি। সে যখন শ্বশুরবাড়িতে যেতে গাড়িতে উঠছিল, তখন আমি কান্না আর আটকাতে পারিনি। এরপর থেকে সবসময় না দেখার কারণে ওর জন্য কষ্ট হতো। আমার সেই বড় আদরের বোনটা এতদূরে চলে গেল, একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কীভাবে সহ্য করব? কষ্ট পাচ্ছি অনেক, বুকের মধ্যে মনে হয় কেউ হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে। বোনের দুইটা দুনিয়া সমান বাচ্চাকে কি বলব? কীভাবে বলব তুমি নেই আর?’ বলতে বলতে মুবিনুলের কথা বুজে যায় কান্নায়।

তাহমিনার সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছেন হুমাইরা সুলতানা। প্রিয় বন্ধুর অন্তিম পরিণতির কথা শোনার পর থেকে মন একটু ভালো নেই এই তরুণীর। বললেন, ‘ভেজা দৃষ্টিতে যেন দেখতে পাচ্ছি সেই সব দিনগুলো। একসঙ্গে শ্রেণিকক্ষ শেয়ার করা। পাশাপাশি বসে কত আড্ডা-খুনসুঁটি। বিয়ের পর শারীরিক দূরত্ব বাড়লেও অনলাইনে সবসময় কথা বলা। এই তো কদিন আগেও কথা হলো। ওকে সাহস দিলাম, সেও দুশ্চিন্তা না করতে বলল। আমার সেই বন্ধুটা আর নেই ভাবতেই যেন একদলা কান্না বুক ঠেলে উঠতে চাচ্ছে।’

সময় যে ফুরিয়ে আসছে হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন তাহমিনাও। গত ১৮ নভেম্বর নিজের ফেসবুকে শেষবারের মতো একটা লাইন লিখেছিলেন এই নারী। সেটি ছিল-‘মৃত্যু আমাদের অনেক কাছে।’ শেষ পর্যন্ত সেটিই নির্মমভাবে সত্যি হয়ে গেল।

স্ত্রীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন মোহাম্মাদ হুমায়ুন আমিন রিংকু। কথা বলার সব শক্তিই যেন হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শোনে সুশ্রুত হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্রের সামনের সড়কের পাশে বসে কাঁদছেন এমন একটি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। স্ত্রী উন্নত চিকিৎসার সুযোগটুকুও দিলেন না, কীভাবে মানবেন রিংকু। এই তরুণ ফেসবুকে স্ত্রীকে নিয়ে দিয়েছেন আবেগঘন স্ট্যাটাস, ‘তোমার সঙ্গে পথচলা প্রায় ৮টি বছর। তোমার মতো নারী যেন প্রত্যেক ঘরে ঘরে জন্ম নেয়। আল্লাহ আমার কলিজাকে তুমি জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নাও।’

তাহমিনাকে হারানোর পর এখন স্বজনদের সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তার দুই শিশুপুত্রকে ঘিরে। মা হারা দুই শিশুকে কীভাবে বড় করে তুলবেন, কি বলে সান্ত্বনা দেবেন সেটি ভেবে কুল পাচ্ছেন না তারা।

সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের সবার একটাই যেন প্রার্থনা-‘মা হারানোর যন্ত্রণা যখন দিয়েছো, তখন কষ্ট সইবার শক্তিও দিও।’