ঘড়িয়ালের ডিম ফোটানোতে ব্যর্থতা অব্যাহত : কী বলছেন গবেষকরা?
৬ বছর আগে ২০১৭ সালে দুটি ঘড়িয়ালের জুটি বাঁধা হয়। উদ্দেশ্য ছিল এই প্রাণিটির বংশবৃদ্ধি করা। ঘড়িয়ালের প্রজনন উপযোগী পরিবেশও তৈরি করা হয়েছে। রাজশাহীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান বোটানিক্যাল গার্ডেনে নেওয়া হয়েছিল এই পদক্ষেপ। তবে এত প্রচেষ্টার সত্ত্বেও ঘড়িয়ালের বংশবৃদ্ধি এখনো স্বাভাবিকভাবে হচ্ছেনা। আবারও ডিম দিয়েছে এই বিলুপ্তপ্রায় প্রাণি, তবে তা ফোটাতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অব্যাহত ব্যর্থতা নিয়ে গবেষকরা বিভিন্ন কারণ অনুসন্ধান করছেন এবং সমাধানের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই ছয় বছরের মধ্যে ৬ দফায় ডিম দিলেও কোনোবারই তা থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ডিম ফোটাতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে ডিমের সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা, আর্দ্রতার মাত্রা, ডিম রাখার স্থান, পুষ্টি ঘাটতি এবং প্রজনন স্বাস্থ্য অন্যতম। গবেষকরা মনে করেন, ঘড়িয়ালের ডিম ফোটানোর জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার মাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব শর্ত পূরণ না হলে, ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হয় না। তাছাড়া, প্রজনন উপযোগী পরিবেশ তৈরি করলেও ডিমের যত্ন ও সঠিক পদ্ধতি অবলম্বনে কিছু ঘাটতি থাকতে পারে।‘
বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে আরও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সফল প্রজননের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখছেন। তাদের মতে, এসব সমস্যার সমাধান পাওয়া গেলে ঘড়িয়ালের বংশবিস্তার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণিটির সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে সেই সমাধান। তারা আরও বলেন, ‘ঘড়িয়ালের প্রজনন না করানো গেলে দেশে এই প্রাণীটি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে আবারও ঘড়িয়ালের বংশ বিস্তারের চেষ্টা করানো হচ্ছে।’
দুই মাস আগে সরীসৃপ গবেষক বোরহান বিশ্বাস রুমন স্বেচ্ছায় ঘড়িয়ালের প্রজনন বিষয়ক কাজ শুরু করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ডিম ফোটানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অভাব এখানে প্রধান সমস্যা। প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার অন্তত তিন মাস আগেই ঘড়িয়ালরা পলি মিশ্রিত মাটি এবং নরম ঘাস সমৃদ্ধ স্থান নির্বাচন করে। এরকম মাটি দিনে তাপ ধরে রাখে এবং রাতেও উষ্ণতা বজায় রাখে। তবে এখানে সেই পরিবেশ অনুপস্থিত।’
বোরহান বিশ্বাস রুমনের পরামর্শে পুকুরের এক পাশের মাটি পরিবর্তন করা এবং ঘাস লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রজনন মৌসুমে ঘড়িয়ালগুলোকে দর্শনার্থীদের থেকে আড়ালে রাখার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। তার মতে ঘড়িয়ালগুলো যাতে নিরিবিলি পরিবেশে থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বোরহান বিশ্বাস রুমন আরও জানান, ‘গত ১০ বছরে দেশের বড় নদীগুলো থেকে অন্তত ২৮টি ঘড়িয়াল উদ্ধার করা হয়েছে, যেগুলো সবই ছোট বাচ্চা। ধারণা করা হচ্ছে, বন্যার কারণে এই ঘড়িয়ালগুলো তাদের মূল স্থান থেকে ভেসে এসেছে। মিঠা পানির এই প্রাণীগুলো বয়সের আকার অনেক বড় হয়।’
তিনি আরও বিস্তারিত বলেন, ‘প্রাপ্তবয়স্ক ঘড়িয়ালের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং তাদের প্রজনন সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র পরিবেশ উপযুক্ত হলেই, ডিমগুলো নিরাপদে ফোটানো সম্ভব হবে। এভাবে নতুন ঘড়িয়ালের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, যা এই প্রজাতির সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য।‘
গবেষক আশা করেন, প্রজননে সফল হলে নদীতে এদের ছেড়ে দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। তবে তার আগে নিরাপদ ও দুষণমুক্ত নদী গড়ার ওপর জোর দিয়েছেন বোরহান। তার মতে, এখান থেকে অন্তত ২টি ঘড়িয়ালের বাচ্চা উৎপাদন করা গেলে, আগামী অর্ধশত বছরের জন্য হলেও প্রাণীটি টিকে থাকবে।’
রাজশাহীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান উদ্যানে কর্মরত শরিফুল ইসলাম জানান, ‘১৯৯০ সালে রাজশাহীর পদ্মা নদী থেকে উদ্ধার হওয়া ঘড়িয়াল এই উদ্যানে রাখা হয়। তবে সেই দুটি নারী প্রজাতির হওয়ায় পদ্মা নামের একটি ঘড়িয়ালকে রেখে অন্যটিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয়। তার বিনিময়ে ২০১৭ সালে ঢাকা থেকে আনা হয় গড়াই নামে একটি ছেলে (নর) ঘড়িয়ালকে।’
শরিফুল বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পর তাদের দাম্পত্য সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। ফলে পদ্মা অন্তত ৬ বার ডিম পেড়েছে। কিন্তু সেগুলো কোনোভাবেই বাচ্চা ফোটানোর জন্য সফল হয়নি। অধিকাংশ ডিম পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে পদ্মা অন্তত ৩২টি ডিম পেড়েছিল। কিন্তু সেগুলোও পানিতে নষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছে। এর আগেও একইভাবে ঘড়িয়ালের ডিমগুলো নষ্ট হয়েছে। গত বছর কিছু ডিম পানির পাশে বালিতে পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু সতর্কতার সাথে বালিতে পুতে রাখলেও তা সফল হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই ঘড়িয়াল নিজেই ডিমগুলো নষ্ট করে ফেলছে। ‘
জানা গেছে, ঘড়িয়ালের গড় আয়ু প্রায় ৬০ বছর। এদের সর্বাধিক দৈর্ঘ্য ২০ ফুট এবং ওজন ১৬০ কেজি পর্যন্ত পৌঁছায়। বয়স্ক ঘড়িয়ালদের রঙ সাধারণত কালচে ধূসর হলেও, বাচ্চাগুলোর রঙ উজ্জ্বল হয়। মার্চ ও এপ্রিল মাস ঘড়িয়ালের প্রজনন ঋতু হিসেবে পরিচিত। এসময় মা ঘড়িয়াল নদীর বালিয়াড়িতে ডিম পেড়ে তা বালি দিয়ে ঢেকে রাখে। একসঙ্গে ২০ থেকে ৯৫টি ডিম পাড়তে সক্ষম। সাধারণত ৭১ থেকে ৯৩ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
রাজশাহীর পদ্মা ও গড়াই নদীর ঘড়িয়ালের বয়স প্রায় ৪০ বছর। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে মিঠা পানির ঘড়িয়াল দেখা যেত। তবে, বাঁধ নির্মাণের পর নদীতে পরিবর্তন আসায় এই প্রাণীটি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলে যায়।