ঘড়িয়ালের ডিম ফোটানোতে ব্যর্থতা অব্যাহত : কী বলছেন গবেষকরা?



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা ২৪.কম, রাজশাহী।
ঘড়িয়ালের ডিম / ছবি: বার্তা২৪

ঘড়িয়ালের ডিম / ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

৬ বছর আগে ২০১৭ সালে দুটি ঘড়িয়ালের জুটি বাঁধা হয়। উদ্দেশ্য ছিল এই প্রাণিটির বংশবৃদ্ধি করা। ঘড়িয়ালের প্রজনন উপযোগী পরিবেশও তৈরি করা হয়েছে। রাজশাহীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান বোটানিক্যাল গার্ডেনে নেওয়া হয়েছিল এই পদক্ষেপ। তবে এত প্রচেষ্টার সত্ত্বেও ঘড়িয়ালের বংশবৃদ্ধি এখনো স্বাভাবিকভাবে হচ্ছেনা। আবারও ডিম দিয়েছে এই বিলুপ্তপ্রায় প্রাণি, তবে তা ফোটাতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অব্যাহত ব্যর্থতা নিয়ে গবেষকরা বিভিন্ন কারণ অনুসন্ধান করছেন এবং সমাধানের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই ছয় বছরের মধ্যে ৬ দফায় ডিম দিলেও কোনোবারই তা থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ডিম ফোটাতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে ডিমের সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা, আর্দ্রতার মাত্রা, ডিম রাখার স্থান, পুষ্টি ঘাটতি এবং প্রজনন স্বাস্থ্য অন্যতম। গবেষকরা মনে করেন, ঘড়িয়ালের ডিম ফোটানোর জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার মাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব শর্ত পূরণ না হলে, ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হয় না। তাছাড়া, প্রজনন উপযোগী পরিবেশ তৈরি করলেও ডিমের যত্ন ও সঠিক পদ্ধতি অবলম্বনে কিছু ঘাটতি থাকতে পারে।‘

ঘড়িয়ালের ডিম / ছবি: বার্তা২৪

বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে আরও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সফল প্রজননের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখছেন। তাদের মতে, এসব সমস্যার সমাধান পাওয়া গেলে ঘড়িয়ালের বংশবিস্তার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণিটির সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে সেই সমাধান। তারা আরও বলেন, ‘ঘড়িয়ালের প্রজনন না করানো গেলে দেশে এই প্রাণীটি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে আবারও ঘড়িয়ালের বংশ বিস্তারের চেষ্টা করানো হচ্ছে।’

দুই মাস আগে সরীসৃপ গবেষক বোরহান বিশ্বাস রুমন স্বেচ্ছায় ঘড়িয়ালের প্রজনন বিষয়ক কাজ শুরু করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ডিম ফোটানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অভাব এখানে প্রধান সমস্যা। প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার অন্তত তিন মাস আগেই ঘড়িয়ালরা পলি মিশ্রিত মাটি এবং নরম ঘাস সমৃদ্ধ স্থান নির্বাচন করে। এরকম মাটি দিনে তাপ ধরে রাখে এবং রাতেও উষ্ণতা বজায় রাখে। তবে এখানে সেই পরিবেশ অনুপস্থিত।’

বোরহান বিশ্বাস রুমনের পরামর্শে পুকুরের এক পাশের মাটি পরিবর্তন করা এবং ঘাস লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রজনন মৌসুমে ঘড়িয়ালগুলোকে দর্শনার্থীদের থেকে আড়ালে রাখার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। তার মতে ঘড়িয়ালগুলো যাতে নিরিবিলি পরিবেশে থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

বোরহান বিশ্বাস রুমন আরও জানান, ‘গত ১০ বছরে দেশের বড় নদীগুলো থেকে অন্তত ২৮টি ঘড়িয়াল উদ্ধার করা হয়েছে, যেগুলো সবই ছোট বাচ্চা। ধারণা করা হচ্ছে, বন্যার কারণে এই ঘড়িয়ালগুলো তাদের মূল স্থান থেকে ভেসে এসেছে। মিঠা পানির এই প্রাণীগুলো বয়সের আকার অনেক বড় হয়।’

তিনি আরও বিস্তারিত বলেন, ‘প্রাপ্তবয়স্ক ঘড়িয়ালের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং তাদের প্রজনন সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র পরিবেশ উপযুক্ত হলেই, ডিমগুলো নিরাপদে ফোটানো সম্ভব হবে। এভাবে নতুন ঘড়িয়ালের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, যা এই প্রজাতির সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য।‘

গবেষক আশা করেন, প্রজননে সফল হলে নদীতে এদের ছেড়ে দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। তবে তার আগে নিরাপদ ও দুষণমুক্ত নদী গড়ার ওপর জোর দিয়েছেন বোরহান। তার মতে, এখান থেকে অন্তত ২টি ঘড়িয়ালের বাচ্চা উৎপাদন করা গেলে, আগামী অর্ধশত বছরের জন্য হলেও প্রাণীটি টিকে থাকবে।’

রাজশাহীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান উদ্যানে কর্মরত শরিফুল ইসলাম জানান, ‘১৯৯০ সালে রাজশাহীর পদ্মা নদী থেকে উদ্ধার হওয়া ঘড়িয়াল এই উদ্যানে রাখা হয়। তবে সেই দুটি নারী প্রজাতির হওয়ায় পদ্মা নামের একটি ঘড়িয়ালকে রেখে অন্যটিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয়। তার বিনিময়ে ২০১৭ সালে ঢাকা থেকে আনা হয় গড়াই নামে একটি ছেলে (নর) ঘড়িয়ালকে।’

ঘড়িয়াল / ছবি: বার্তা২৪

শরিফুল বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পর তাদের দাম্পত্য সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। ফলে পদ্মা অন্তত ৬ বার ডিম পেড়েছে। কিন্তু সেগুলো কোনোভাবেই বাচ্চা ফোটানোর জন্য সফল হয়নি। অধিকাংশ ডিম পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে পদ্মা অন্তত ৩২টি ডিম পেড়েছিল। কিন্তু সেগুলোও পানিতে নষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছে। এর আগেও একইভাবে ঘড়িয়ালের ডিমগুলো নষ্ট হয়েছে। গত বছর কিছু ডিম পানির পাশে বালিতে পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু সতর্কতার সাথে বালিতে পুতে রাখলেও তা সফল হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই ঘড়িয়াল নিজেই ডিমগুলো নষ্ট করে ফেলছে। ‘

জানা গেছে, ঘড়িয়ালের গড় আয়ু প্রায় ৬০ বছর। এদের সর্বাধিক দৈর্ঘ্য ২০ ফুট এবং ওজন ১৬০ কেজি পর্যন্ত পৌঁছায়। বয়স্ক ঘড়িয়ালদের রঙ সাধারণত কালচে ধূসর হলেও, বাচ্চাগুলোর রঙ উজ্জ্বল হয়। মার্চ ও এপ্রিল মাস ঘড়িয়ালের প্রজনন ঋতু হিসেবে পরিচিত। এসময় মা ঘড়িয়াল নদীর বালিয়াড়িতে ডিম পেড়ে তা বালি দিয়ে ঢেকে রাখে। একসঙ্গে ২০ থেকে ৯৫টি ডিম পাড়তে সক্ষম। সাধারণত ৭১ থেকে ৯৩ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।

রাজশাহীর পদ্মা ও গড়াই নদীর ঘড়িয়ালের বয়স প্রায় ৪০ বছর। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে মিঠা পানির ঘড়িয়াল দেখা যেত। তবে, বাঁধ নির্মাণের পর নদীতে পরিবর্তন আসায় এই প্রাণীটি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলে যায়।

   

শুভ জন্মতিথি মহীয়সী কবি সুফিয়া কামাল



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
কবি সুফিয়া কামাল

কবি সুফিয়া কামাল

  • Font increase
  • Font Decrease

সুফিয়া কামাল কেবল একটি নাম নয়, এ যেন পরিবর্তনের জোয়ার। বাঙালি নারীর অন্ধকার জীবনে অধিকারের একটি মশাল আলোকিত ব্যক্তি ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। এখনকার নারীবাদী দেখলে অধিকাংশ মানুষ কেমন আতঙ্ক প্রকাশ করে নাক সিটকায়! তবে প্রকৃত নারীবাদী, যারা হাজার হাজার নিপীড়িত নারীকে শোষণ ও অত্যাচার থেকে বাঁচিয়ে স্বাধিকারে সোচ্চার করতে সাহায্য় করেছেন তেমন নারীবাদীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি সুফিয়া। নারী প্রগতি আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তি গড়ে এবং একাধারে আন্দোলনের অংশ ছিলেন তিনি। অনন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই মহীয়সী নারীর জন্মতিথি আজ।

১৯১১ সালের ২০ জুন (১০ আষাঢ় ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। আজ (বৃহস্পতিবার) আমাদের দেশের ই ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ মহীয়সী এই নারীর ১১৩ তম জন্মবার্ষিকী। ‘জননী সাহসিকা’ হিসেবে খ্যাত কবি সুফিয়ার ছোটবেলা কেটেছিল তার মাতুতালয়ে। করি জন্মের পরপরই তার বাবা সাধক অনুসারী হয়ে সংসার ত্যাগ করেন। তারপর থেকে মা সাবেরা খাতুনের সঙ্গে তার নানাবাড়ি শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারে থাকার সময়ই তার হাতেখড়ি হয়। নারীশিক্ষার প্রথা প্রচলিত না থাকায় অন্দরেই অন্য শিশুদের সাথে তিনি উর্দু, আরবি, ফারসি ভাষা শিখতেন। পরবর্তীতে একটু বড় মায়ের কাছেই তিনি বাংলা শিখতে শুরু করেন। কে জানতো,পরবর্তীতে এই বাংলার সাহিত্য তারই হাত ধরে বিশাল এক যাত্রা সম্পন্ন করবে!

রক্ষণশীল পরিবারে বড় হওয়ায় তার ব্যক্তিত্ব ছিল বিশেষ। মাত্র ৭ বছর বয়েসে তিনি বেগম রোকেয়ার সাক্ষাৎ পান কলকাতায়। তবে পারিবারিক কারণেই সুযোগ পেয়েও বেগম রোকেয়ার ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল’ স্কুলে ভর্তি হওয়া হয়নি। তবে স্কুলে কখনো যাওয়া না হলেও ছোটথেকেই তার মেধা সুপ্ত রাখার উপায় ছিল না। যদিও মাত্র ১২ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায় মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে। তবে স্বামীর সহযোগিতায় বাংলা সাহিত্য চর্চার পথ সুগম হয় কবির। স্বামী নেহাল ছিলেন একজন নারীশিক্ষা সমর্থক এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তাচেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েও তিনি স্ত্রী সুফিয়াকে পত্রিকায় লেখা ছাপানোর সুযোগ করে দিয়ে সাহায্য করেন।      

কবি সুফিয়া কামাল

১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা বাসন্তী ছাপা হয় সওগাত পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায়। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সাঁঝের মায়া, কেয়ার কাঁটা, মায়া কাজল, মন ও জীবন, প্রশস্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী, ইতল-বিতল, দিওয়ান, সোভিয়েতে দিনগুলি, অভিযাত্রিক, মৃত্তিকার ঘ্রাণ, একাত্তরের ডায়েরী, নওল কিশোরের দরবারে, একালে আমাদের কাল- সহ আরও অসংখ্য সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেছেন তিনি। কলকাতায় থাকার সময় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র, বেগম রোকেয়া নানান কিংবদন্তী সাহিত্যিকের সান্নিধ্যে আসেন। তার চিন্তা-চেতনা এবং সাহিত্যের অনুপ্রেরণা হিসেবে সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান তিনি।

জীবনের মাঝামাঝি স্বামী নেহাল হোসেনের হঠাৎ মৃত্যুতে (১৯৩২ সাল) বেসামাল হয়ে পড়েছিলেন কবি সুফিয়া। তখন তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা এবং বেগম পত্রিকার সম্পাদনা করতে শুরু করেন একাধারে। এর কিছু বছর পর তিনি ১৯৩৯ সালে কামালউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন কবি এবং এখানে সাহিত্যচর্চা ও নারীস্বার্থে কাজ চালিয়ে যান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এমনকি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধকরণের প্রতিবাদে তিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধেও যান।

কবি সুফিয়া কামাল

তার গঠিত নারী সংগঠন ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে সমাবেশ ও মিছিরে অংশগ্রহণ করে, যার মূলহোতা ছিলেন কবি সুফিয়া নিজেই। মুক্তযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের নজর ফাঁকি দিয়ে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে গেছেন। সুযোগ পেয়েও দেশের বাইরে চলে যাওয়াকে প্রত্যাখ্যান করে, মৃত্যুর সম্ভাবনাকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে অনবরত ষোলআনা দেশপ্রেমের প্রমাণ দিয়ে গেছেন।        

যুদ্ধের পরও তিনি আমৃত্যু বাংলা সাহিত্য এবং নারী অধিকার উন্নতির লক্ষ্যে সংগ্রাম ও সাহায্য করে গেছেন। বাঙালি আজীবন মহীয়সী এই নারীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। যতদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য রয়েছে,  কবি সুফিয়া কামালের কৃতিত্ব অমলিন রয়ে যাবে।

;

চিড়িয়াখানায় বাঘদের খুনসুটি আর ভালোবাসার একান্ত মুহূর্ত



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
একে অপর আদর করে দিচ্ছেন দুই বাঘ/ছবি: নূর এ আলম

একে অপর আদর করে দিচ্ছেন দুই বাঘ/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঈদের ২য় দিন; মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। রাজধানীজুড়ে বিশ্রি রকমের ভ্যাপসা গরম। এর মধ্যেও ঢাকার চিড়িয়াখানা পশু-প্রাণী দেখতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। মা-বাবার হাত ধরে উৎসুক শিশুরা পশু-প্রাণীর খাঁচায় খাঁচায় উঁকি দিচ্ছে।

চিড়িয়াখানাজুড়ে দর্শনার্থীদের পদচারণা দেখে খাঁচাবন্দি বাঘগুলোও যেন উচ্ছ্বসিত। খাঁচার ভেতরে সবুজ ঘাসে একে অন্যের সঙ্গে মেতে উঠেছে খুনসুটি ও খেলাধুলোতে। একের অন্যটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একে অপরকে খেলাচ্ছলে কামড়ে ধরছে। কেউ আবার অদূরে চুপটি করে বসে অন্যদের খুনসুটি দেখছে।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের মতে, বাঘ-বাঘিনীদের এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। তবে ঈদের পরের দিন সেই উচ্ছল বাঘদের খেলার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছেন বার্তা২৪.কম এর ফটো এডিটর নূর এ আলম।

সঙ্গী ছাড়া হতে চাচ্ছে না বাঘটি, তাই তো আঁকড়ে দিচ্ছে পা টেনে ধরে/ছবি: নূর এ আলম


আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে একে অপরকে, আর ভালোবাসার এই খুনসুটি চেয়ে দেখছে আরেকটি বাঘ/ছবি: নূর এ আলম


চিড়িয়াখানায় বাঘদের এমন খেলার দৃশ্য তেমন একটা দেখা যায় না/ছবি: নূর আলম


খুনসুটি আর মায়ার আলিঙ্গন/ছবি: নূর এ আলম


চিড়িয়াখানায় বাঘটি আয়েশি মুডে নিরিবিলি সময় কাটাচ্ছে/ছবি: নূর এ আলম


চিড়িয়াখানা পশুদের মধ্যে বাঘ অন্যতম আকর্ষণ, তাই তাদের উচ্ছল চলাফেরা বেশ উপভোগ্য ছিল/ছবি: নূর এ আলম


;

সরেজমিন কৌশল্যা: বদলে যাচ্ছে গ্রাম



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
সরেজমিন কৌশল্যা: বদলে যাচ্ছে গ্রাম

সরেজমিন কৌশল্যা: বদলে যাচ্ছে গ্রাম

  • Font increase
  • Font Decrease

কৌশল্যা, দাগনভূঁইয়া, ফেনী থেকে: "অবারিত মাঠ গগন ললাট, চুমে তব পদধূলি; ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলি", রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার গ্রাম এখন বইয়ের পাতায় আছে, বাস্তবে নেই। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামগুলো এখন পরিবর্তমান। আধুনিক জীবনের ছোঁয়ায় বদলে গেছে চিরায়ত গ্রামের চিরচেনা দৃশ্যপট।

"গ্রামের ফসলের মাঠ কমছে। টিনের বাড়িঘর হারিয়ে যাচ্ছে। সর্বত্র পাকা সড়ক। যান্ত্রিক যান চলে আসে ঘরের দুয়ারে। বিদ্যুৎ সহজলভ্য। জোনাকির আলোজ্বলা নিঝুম গ্রাম খুঁজে পাই না আমরা", বললেন জামাল স্যার। তার সাথে কথা হচ্ছিল কৌশল্যা গ্রামের কাজী বাড়ির দহলিজে।

কৌশল্যা গ্রামটি বেশ চমৎকার। ভৌগোলিক দিক থেকেও কৌশলপূর্ণ। ফেনী জেলা সর্বউত্তরের গ্রাম এটি। তার পশ্চিমে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও নাঙলকোট উপজেলার সীমান্ত। দক্ষিণে লাগোয়া নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি ও সেনবাগ উপজেলা।


বুধবার (১৯ জুলাই) ভোরে চট্টগ্রাম থেকে গাড়ি অতিদ্রুতই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী-মহিপাল পয়েন্টে চলে এসেছে। মহিপাল থেকে ডানের রাস্তা গিয়েছে ফেনী শহরে। বামে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর। এ পথে কিছুদূর এগিয়ে দাগনভূঁইয়া। তারপর উপসড়ক ধরে কৌশল্যা গ্রাম। পথেঘাটে ঈদের আমেজ থাকায় যানজটের বালাই নেই। আমরা খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছেছি ছুটির ঢিলেঢালা ট্রাফিক পেরিয়ে।

গ্রামে এসেও অবাক হতে হলো। গ্রাম কোথায়? পাকা সড়ক, পাকা বাড়ি, মাঝেমাঝে কিছু সবুজ ধানখেত। কিছুক্ষণ পর পর দামী গাড়ি ছুটে যাচ্ছে গ্রামে ভেতর দিয়ে।

"এই গ্রামের প্রতিটি ঘরে প্রবাসী আছেন। চাকরিজীবীও কম নন। ঈদের ছুটিতে তারা সপরিবারে বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। সবারই নিজের কিংবা রেন্টাল কার আছে। সোজা হাজির হচ্ছেন বাড়ির উঠানে", বললেন 'ফেনী রিডার্স ফোরাম'-এর এক সদস্য।

Caption

'ফেনী রিডার্স ফোরাম' নিয়মিত স্টাডি সার্কেল করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে। সদস্যরা সকলেই স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর। চাকরি ও ব্যবসায় জড়িত। অবসরে পড়াশোনার অভ্যাস চালিয়ে রেখেছেন।

গ্রামে আরো কয়েকজন শিক্ষিত যুবকের সঙ্গে কথা হলো। অধিকাংশই চাকরিজীবী। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনীতে চাকরি করেন না। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাড়ি আসেন। তাীা জানালেন, "মানুষের আয়-রোজগার বেড়েছে। জমিজমার দামও বাড়ছে। অনেকেই পাকা বাড়ি করায় ফসলী জমি কমছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না বাড়ায় শিক্ষার হার বাড়ছে না"।

কৌশল্যা গ্রামের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো সবুজায়ন। নানা পরিবর্তনের পরেও পুরো গ্রাম সবুজে ছাওয়া। প্রায়-প্রতিটি বাড়ির আঙিনা ও খোলা জায়গা শাকসবজি চাষ করা হচ্ছে। হাঁস-মুরগী পালিত হচ্ছে প্রত্যেক বাড়িতে।


গ্রামের সাংস্কৃতিক জীবন পুরোপুরিভাবে গ্রাস করেছে টিভি চ্যানেলগুলো। পথে বের হলেও টিভির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। "খেলার মাঠ নেই গ্রামে। ফসল কাটা হলে ক্ষেতগুলোতে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে। বাকি সময় টিভি বা মোবাইলে ব্যস্ত থাকে তার", বললেন জামাল স্যার।

মেঘলা আকাশে টিপটিপ বৃষ্টিতে গ্রাম ঘুরে ফিরে আসার সময় একটি ট্রানজিশনাল পিকচার নিয়ে এলাম। গতানুগতিক গ্রাম ক্রমশ আধুনিকায়নের পথে পাড়ি দিচ্ছে এক তুমুল সন্ধিক্ষণ। সমাজ বদলের ধারায় হয়ত অচিরেই আদি গ্রামের জায়গা দখল করবে আধুনিক নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা। যুক্ত হবে নতুন অনেক কিছু। আবার হারিয়েও যাবে ঐতিহ্যবাহী অনেক বিষয়ও। এই বদলের সবটাই ভালো হবে, এমন নয়। ভালোগুলোকে ধরে রাখার মাধ্যমে পালাবদলকে গ্রহণ করতে পারলেই হবে প্রকৃত উন্নয়ন। নইলে বদল হবে, উন্নয়ন হবে না।

;

দিল্লি: মৃত্যুহীন এক মহানগরী



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
দিল্লি: মৃত্যুহীন এক মহানগরী

দিল্লি: মৃত্যুহীন এক মহানগরী

  • Font increase
  • Font Decrease

দিল্লির অস্তিত্ব ও আত্মা বেঁচে আছে পুরনো শহরে। নতুন দিল্লি, গুরগাঁও, নয়ডা মিলিয়ে ভারতের জাতীয় রাজধানী দিল্লির বিশাল চৌহদ্দীর মধ্যে নতুনত্ব থাকলেও ঐতিহ্য সামান্যই। ইতিহাস ও ঐতিহ্য মিশে আছে পুরনো দিল্লির ইমারতে, হর্ম্যে, অট্টালিকায়. দুর্গে, পথেঘাটে, ধ্বংসস্তূপে, বাতাসে।

পুরনো দিল্লির ইতিহাস লিখতে গিয়ে আশির দশকের গোড়ার দিকে নারায়ণী গুপ্ত মন্তব্য করেছিলেন, ‘দিল্লির যে কত বার মৃত্যু হয়েছে!’ বিশিষ্ট ইতিহাসবিদের এই উক্তি স্মরণ করে কল্যাণী দেবকী মেনন মেকিং প্লেস ফর মুসলিমস ইন কন্টেম্পোরারি ইন্ডিয়া গ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্রতিটি মৃত্যু এক একটি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক রূপান্তর সাধন করেছে। মুঘল শাহজাহানাবাদ হয়েছে ব্রিটিশ-শাসিত দিল্লি। ব্রিটিশরা তাদের রাজধানী নয়াদিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে গেলে আদি শহর হয়ে গেছে পুরানা দিল্লি। ঔপনিবেশিক জমানার সংঘাতময় অবসানের পরেও দিল্লি বার বার ভেতর থেকে আক্রান্ত হয়েছে। মরেছে। এবং পুনর্জন্ম লাভ করেছে।’

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পরবর্তীতে নানা কারণে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক হিংসা, বিশেষত আশির দশকে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলে শিখ নিধন আর করোনার আগে আগে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকালে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দিল্লির অস্তিত্বে রক্ত ও কলঙ্কের ছাপ রেখেছে। কর্পোরেট আগ্রাসনের প্রতিবাদে দীর্ঘমেয়াদী কৃষক আন্দোলন অনতি-অতীতে দিল্লির প্রতিবাদী চেহারা সামনে নিয়ে আসে। দিল্লি হালআমলে আলোচিত বায়ু দুষণের কারণে শীর্ষস্থান লাভকারী শহর হিসাবে। এমনকি, দিল্লির ইতিহাসে সর্বোচ্চ উষ্ণতার রেকর্ডও হয়েছে ২০২৪ সালে। চরম উত্থান ও পতনে, সঙ্কটে ও সন্ধিক্ষণে দিল্লি যেন মৃত্যুহীন এক মহানগরী: স্ফিনিক্স পাখির মতো ছাইভষ্মের ভেতর থেকে বার বার পুনর্জন্ম পেয়েছে দিলওয়ালাদের এই শহর দিল্লি। সংখ্যাতীত রাজা-বাদশাহের পাশাপাশি যে শহরের দ্যুতিময় চরিত্র হয়ে আছেন আমীর খসরু, তানসেন, মীর্জা গালিব থেকে শুরু করে দিল্লিওয়ালা শাহরুখ খান। দিল্লির বাসিন্দাদের বলা হয় দেহলভি, যে টাইটেল গ্রহণ করে বহু খ্যাতনামা দিল্লিবাসী স্থান পেয়েছেন ইতিহাসের অলিন্দে।       

অক্টাভিও পাজ (লোজানো) নোবেল বিজয়ী (১৯৯০) লাতিন কবি ও কূটনীতিবিদ দিল্লিতে বাস করেন মেক্সিকান রাষ্ট্রদূত হিসাবে। তার কাছে দিল্লির স্থাপত্য ছিল শব্দ ও কবিতার একটি সংমিশ্রণ। পুরনো দিল্লিতে তিনি দেখেছিলেন ‘প্রাচীন স্থাপনার চিত্ররূপ‘সমাবেশ an assemblage of images more than buildings. তিনি নতুন দিল্লিকে চিহ্নিত করেন অবাস্তব (unreal)। আর পুরনো দিল্লিতে খুঁজে পান উনিশ শতকের গথিক স্থাপত্যের লন্ডন ও প্রাচীন ব্যাবিলন শহরের ছাপ। যে শহরের নন্দনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সুরম্য দালানের ছায়া পেরিয়ে শত শত গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস বইয়ের পাতায় মিশে আছে অক্টোভিও পাস ছাড়াও ভিক্টর হুগো, ওয়াল্টার স্কট, আলেকজান্ডার দ্যুমা প্রমুখের লেখনির মাধ্যমে। ভারতের অভিজ্ঞতায় ওক্টাভিও পাজ আস্ত একটি গ্রন্থ রচনা করেন In Light of India শিরোনামে।

দিল্লি জনপদের প্রথম উল্লেখ করে প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারত, যেখানে যুদ্ধরত চাচাত ভাইদের দুটি দল, পা-ব এবং কৌরবদের সম্পর্কে রোমাঞ্চকর-মহাকাব্যিক বর্ণনা রয়েছে। পা-ব এবং কৌরব, উভয়েই ভরতের বংশধর ছিলেন। আখ্যান অনুসারে, পা-বদের রাজধানী ছিল দেবতা ইন্দ্রের শহর ইন্দ্রপ্রস্থ। যদিও ইন্দ্রপ্রস্থ নামে কিছুই অবশিষ্ট নেই তথাপি কিংবদন্তি অনুসারে এটি ছিল একটি সমৃদ্ধ শহর, যা দিল্লির পূর্বনাম। তবে দিল্লি নামক স্থানের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে, যখন রাজা ধিলু দক্ষিণ-পশ্চিম দিল্লিতে বর্তমান কুতুব মিনার টাওয়ারের স্থানে একটি শহর তৈরি করেছিলেন এবং নিজের নাম ধিলু থেকে দিল্লি নামকরণ করেছিলেন।

পরবর্তীতে বর্তমান দিল্লি টায়াঙ্গেল নামে পরিচিত এলাকার অনঙ্গপুর বা আনন্দপুরে নামক স্থানে তোমারা রাজবংশের কথা জানা যায়, যারা আরো পশ্চিম দিকে ‘লালকোট’ নামের প্রাচীর ঘেরা দুর্গে চলে আসেন। ১১৬৪ সালে পৃথ্বীরাজ সেখানে আরো বিশাল প্রাচীর নির্মাণ করে জায়গাটির ‘কিলা রাই পিথোরা‘ নাম দেন। ১২ শতকের শেষের দিকে মুসলিম বিজয়ী মুহাম্মদ ঘোরী রাজা পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে দিল্লিসহ সমগ্র উত্তর ভারত অধিকার করেন। তিনিই প্রথম দিল্লির পরিকল্পিত বিকাশের সূচনা করেন। দিল্লিকে রাজধানী করে তিনি তার সেনাপতি কুতুবুদ্দীন আইবেককে শাসনকার্যের দায়িত্ব দিয়ে নিজ স্বদেশ আফগানিস্তান-ইরান সংলগ্ন ঘোর প্রদেশে ফিরে যান। ইতিহাসকারগণ মুহাম্মদ ঘোরীকে রাজধানী দিল্লির প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন।

১৩ শতকের শেষের দিকে খিলজি বংশ দিল্লির ক্ষমতায় আসে। খিলজিদের রাজত্বকালে মোঙ্গল লুণ্ঠনকারীরা দিল্লি শহরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। মোঙ্গলদের পরবর্তী আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা হিসাবে দিল্লির শাসক আলাউদ্দিন খিলজি কুতুব মিনার থেকে অল্প দূরে উত্তর-পূর্ব দিকে ‘সিরি’ নামক স্থানে একটি নতুন বৃত্তাকার সুরক্ষিত শহর তৈরি করেছিলেন, যাকে খিলজি রাজধানী রূপে মনোনীত করা হয়। দিল্লির ভেতরে ‘সিরি‘ছিল প্রথম নতুন ও পরিকল্পিত শহর। আর আলাউদ্দির খিলজি ছিলেন বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে দিল্লিকে রক্ষাকারী প্রথম সফল শাসক।

খিলজিদের পর দিল্লি ১৩২১ সালে তুঘলক রাজবংশের অধীনস্থ হয়। গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ‘তুঘলকাবাদ‘ নামে একটি নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন। কিন্তু কুতুব মিনারের কাছাকাছি স্থানটিকে পানির অভাবের কারণে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করতে হয়। আরেক শাসক মুহাম্মদ ইবনে তুঘলক শহরটিকে আরো উত্তর-পূর্ব দিকে প্রসারিত করেন। তিনি চারপাশে শক্ত প্রাচীর বেষ্টিত একটি দুর্গও নির্মাণ করেন। তিনিই আবার রাজধানীকে দক্ষিণ দিকে প্রসারিত করে দেওগিরি মালভূমির প্রান্তে দৌলতাবাদ নামের আবাস গড়েন। পরবর্তী শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলক দৌলতাবাদ পরিত্যাগ করে ১৩৫৪ সালে উত্তর দিকের ইন্দ্রপ্রস্থের প্রাচীন স্থানের পাশে ফিরোজাবাদ নামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন, বর্তমানে যা ‘ফিরোজ শাহ কোটলা‘ নামে প্রসিদ্ধ।  

দিল্লির শান-শওকত বাড়াতে মুহাম্মদ ঘোরির পদাঙ্ক অনুসরণ করে খিলজি, তুঘলক, তৈমুর, সাইয়িদ, লোদি রাজবংশ পুরনো রাজধানী ফিরোজাবাদের আশেপাশে নানা নির্মাণ ও স্থাপনায় ভরিয়ে দেন, যা আরো সমৃদ্ধি লাভ করে মুঘল শাসনামলে। মুঘল শাসনের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ১৫২৬ সালে দিল্লির সন্নিকটের পানিপথ প্রান্তরের যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আগ্রায় তার ঘাঁটি স্থাপন করেন। বাবরের পুত্র নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন দিল্লির যমুনা তীরে একটি নতুন আবাসস্থল গড়েন। শেরশাহের কাছে হুমায়ুন পরাজিত হলে তার আবাসও গুরুত্ব হারায়। শেরশাহ দিল্লির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে শেরশাহী কিল্লাহ স্থাপন করেন, যা বর্তমানে পুরনো কিল্লাহ দুর্গ নামে পরিচিত।

শেরশাহের মৃত্যুর পর দিল্লি তথা ভারতের শাসন পুনরায় মুঘলদের হস্তগত হয়। হুমায়ুন-পুত্র আকবর এবং পরবর্তী শাসকগণ দিল্লির উন্নতিতে কাজ করেন। যদিও তাদের রাজধানী ছিল আগ্রা, ফতেহপুর সিক্রি, লাহোর তথাপি সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অক্ষুন্ন থাকে। মুঘল স¤্রাট শাহজাহানের নাম দিল্লির ইতিহাসে একজন অন্যতম প্রধান নির্মাতা রূপে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তিনি তার প্রকৌশলী, স্থপতি ও জ্যোতিষীদের রাজধানী আগ্রা ও লাহোরের মধ্যবর্তী কোথাও হালকা জলবাযু ও কৌশলগত অবস্থানের একটি জায়গায় নতুন রাজধানী স্থাপনের নির্দেশ দেন। সর্বসম্মতভাবে শেরশাহ নির্মিত দিল্লির পুরনো কিল্লাহর ঠিক উত্তরে যমুনা নদীর পশ্চিম তীরে স্থান নির্বাচিত হয়। স¤্রাট শাহজাহান তার দুর্গ ‘উর্দু-ই-মুয়াল্লা‘কে কেন্দ্র করে নতুন রাজধানী ‘শাহজহাানাবাদ‘ নির্মাণ শুরু করেন, যা বর্তমানে লাল কিল্লাহ নামে পরিচিত। লাল কিল্লাহ নির্মাণে সময় লাগে আট বছর। সঙ্গে জামা মসজিদসহ আরো অনেক নান্দনিক স্থাপনা তৈরি করেন শাহজাহান। যেগুলোর অধিকাংশই ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত ওয়াল্ড হেরিটেজ বা বিশ^ঐতিহ্যের অংশ। শাহজাহান তার নতুন রাজধানীকে অনেকগুলো প্রাচীর ও গেট দিয়ে সুশোভিত করেন। যার মধ্যে কাশ্মীরি গেট, দিল্লি গেট, আজমেরি গেট, তুর্কমান গেট বর্তমানেও দাঁড়িয়ে আছে। বস্তুতপক্ষে, পুরনো দিল্লির বৃহত্তর অংশ শাহজাহান কর্তৃক নিমিত। এ কারণে, পুরনো দিল্লির আরেক নাম শাহজাহানাবাদ।

১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকালে দিল্লি নানা শক্তির দ্বারা লুণ্ঠিত ও আক্রান্ত হয়। যেহেতু শেষ দিকের দিল্লির শাসকগণ যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন না, ছিলেন দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু, সেহেতু শিখ, মারাঠা, পারসিক সেনাদল দিল্লি আক্রমণ ও লুটপাট করে। সবচেয়ে জঘন্য হামলা চালিয়ে দিল্লি দখল করে ইংরেজরা। সিপাহী বিদ্রোহের সময় দিল্লির শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়ে ইংরেজদের হাতে পরাজিত হওয়ায় চরম লাঞ্ছনা, প্রতিহিংসা ও বর্বরতার সম্মুখীন হন। মুঘল রাজপুরুষ ও নারীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়। নগরে চালানো হয় গণহত্যা। মুঘল ঐতিহ্যের নানা নিদর্শন তথা বই, পুস্তক, অলঙ্কার, চিত্রশিল্প লুট করা হয়। অনেক কিছুই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। হাজার বছরের দিল্লি ইংরেজের আগমনে মÍব্ধ কবরগাহের চেহারা লাভ করে।

১৯১১ সালে কলকাতা থেকে ব্রিটিশ শাসনের রাজধানী দিল্লি স্থানান্তরিত হলে ঐতিহ্যবাহী নগরের মর্যাদা ও সমৃদ্ধি আবার ফিরে আসে। নতুন ব্রিটিশ প্রশাসনিক কেন্দ্র রূপে দিল্লিকে গড়ে তুলতে স্যার এডউইন লুটিয়েন্স-এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। তিনি যে শহরের রূপ দেন তা বর্তমানের নতুন দিল্লি। ১৯৩১ সালে পরিকল্পিত নতুন দিল্লির নির্মাণ সমাপ্ত হয়, যাকে বলা হয় ‘লুটিয়েন্সের দিল্লি‘।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হলে দিল্লিকে রাজধানী করা হয়। ক্রমেই শাহজাহানাবাদ ও লুটিয়েন্সের দিল্লি একটি আধুনিক মেট্রোপলিটনের অবয়ব লাভ করে যমুনা নদী বরাবর উত্তর ও দক্ষিণ দিক ছাড়িয়ে পূর্ব ও পশ্চিমেও প্রসারিত হয়। জাতীয় রাজধানীর মর্যাদা পেয়ে বৃহত্তর দিল্লির পাশের উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানা রাজ্যের কিছু অংশকেও নিজের অন্তর্ভূক্ত করে। প্রাথমিকভাবে দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শিখ শরণার্থীদের চাপ বৃদ্ধি পায় দিল্লিতে। পরে সিন্ধিসহ আরো অনেক জনগোষ্ঠী নতুন দিল্লির নানা স্থানে বসতি স্থাপন করে। দিল্লিতে উর্দুভাষী মুসলিমরা প্রাচীনকাল থেকেই বসবাস করছেন। তদুপরি ভারতের নানা প্রান্তের মানুষের আগমনে দিল্লি একটি বৈচিত্র্যময় ম্যাগাসিটিতে পরিণত হয়েছে, যা এখন বাযু দূষণ ও তাপবৃদ্ধির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষতম বিপদজনক শহর। রাজনৈতিক কারণেও দিল্লি সর্বদা উতপ্ত থাকে। নানামুখী আন্দোলন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা দিল্লির ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। যাবতীয় সমস্যা ও অসঙ্গতি নিয়েও দিল্লি এক মৃত্যুহীন এক মহানগরী হয়ে বেঁচে  থেকে ইতিহাসের স্পন্দন জাগাচ্ছে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; চেয়ারম্যান ও প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;