সংগ্রামী নারী শেফালী রানী

  • গনেশ দাস, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বগুড়া, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সংগ্রামী নারী শেফালী রানী / ছবি: বার্তা২৪

সংগ্রামী নারী শেফালী রানী / ছবি: বার্তা২৪

জীবন সংগ্রামী এক নারী শেফালী রানী সাহা। দশ গ্রামের মানুষ তাকে চিনে লক্ষ্মীর মা বলে। ষাটোর্ধ্ব এই নারী ভ্যান চালিয়ে গ্রামে গ্রামে বাদাম-চানাচুর আর মসলা বিক্রি করে সংসার চালান গত এক যুগ ধরে। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে সন্তান না থাকায় সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে।

সংসার চালানোর পাশাপাশি দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন এবং এক মেয়েকে কলেজে পড়াচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এক জামাইয়ের মৃত্যুর পর মেয়ে নাতনীকে তার কাছে রেখে চলে গেছেন ঢাকায়। সেই নাতনী ছাড়াও শেফালী রানীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তার মা অশতিপর বৃদ্ধা কুসুম বালা। নাতনী এবং মা কুসুম বালার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব হাসি মুখে নিয়েছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

জীবন সংগ্রামী নারী শেফালী রানীর বাড়ি বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শেষ প্রান্তে দেউলী ইউনিয়নের রহবল পুর্বপাড়া (গেন্দার দহ) গ্রামে।

বৃহস্পতিবার (০৭ মার্চ) বিকেলে বাড়িতে গেলে সংগ্রামী জীবনের কাহিনী বর্ণনা করেন শেফালী রানী। তিনি বার্তা২৪.কমকে জানান, স্বামী গবেশ্বর চন্দ্র সাহা পেশায় ছিলেন ভ্যান চালক। পাঁচ মেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী নিয়ে ছিল তাদের সংসার। বড় মেয়ে লক্ষী রানী ও ছোট মেয়ে স্বরসতী রানীকে বিয়ে দেওয়ার পর ২০০৭ সালে হঠাৎ হৃদ রোগে মারা যান স্বামী গবেশ্বর চন্দ্র সাহা। নাবালিকা তিন মেয়েকে নিয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে শেফালী রানীর। দুশ্চিন্তায় পড়েন তিন।

বিজ্ঞাপন

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/08/1552041938966.jpg

তিনি আরও জানান, এক সময় নিজের বুদ্ধিতে শুরু করেন বাদাম-চানাচুর বিক্রির ব্যবসা। শুরুতে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি মাথায় নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করতেন বাদাম-চানাচুর। দুবছর কেটে যায় এভাবেই। তিন সন্তান বড় হওয়ায় ব্যয় বাড়তে থাকে সংসারে। পায়ে হেঁটে বেশি দূর যাওয়া যেত না। তাই বেচা বিক্রিও হত কম। আর তখনই বেচা বিক্রি বাড়াতে স্বামীর রেখে যাওয়া ভ্যান গাড়ি তুলে নেন হাতে। ভ্যান গাড়িতেই প্লাস্টিকের অসংখ্য বয়াম সাজিয়ে ঘুরতে থাকেন গ্রামে গ্রামে। বিক্রি শুরু করেন বাদাম-চানাচুর ছাড়াও বুট, মটর, কাবলী, সিমের বিচি ভাজা। ঝুড়ি মাথায় নিয়ে আগে এক গ্রাম ঘুরতেই দিন শেষ হতো। আর এখন ভ্যানগাড়ি হওয়ায় দিনে তিন গ্রাম ঘুরতে পারেন। ফলে বেচা বিক্রিও বেড়ে যায় আগের তুলানায় অনেক বেশি। একপর্যায় মানুষের চাহিদা অনুযায়ী তার ভ্যান গাড়িতে স্থান পায় বিভিন্ন প্রকারের মসলা, তেল সাবান ছাড়াও সংসারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি।

তিনি শেফালী রানী জানান, ভ্যান গাড়ি নিয়ে প্রতিদিন তিনটি গ্রাম ঘুরে বিক্রি হয় ১ থেকে ১২০০ টাকা। সপ্তাহে একদিন ব্যবসা বন্ধ থাকে। ওই দিন হাট থেকে মালামাল কেনা ছাড়াও বাড়িতে বাদাম-বুট ভাজার কাজ করেন। এই ব্যবসায় তার সংসারে অভাব না থাকলেও বয়সের ভারে পারেন না ভ্যান চালাতে। তাই ভ্যানগাড়ি ঠেলে হেঁটে হেঁটে আবার কখনো ভ্যান চালিয়ে গ্রাম ঘোরেন।

তিনি বলেন, ‘এই ১২ বছরে দুই মেয়ে অতশী এবং তাপসীকে বিয়ে দিয়েছি। ছোট মেয়ে মনিকা রানী মহাস্থান ডিগ্রি কলেজ থেকে এবছর এইচএসসি পরিক্ষা দিবে। তার লেখাপড়ার খরচ চালানো ছাড়াও সংসারের যাবতীয় ব্যয় করা হয় আমার ব্যবসা থেকে।’

দুঃখের শেষ নেই উল্লেখ করে শেফালী রানী বলেন, ‘মেয়ে অতশী রানীকে বিয়ে দেওয়ার পর তার স্বামী মারা যায়। এক বছর পর অতশী রানী তার মেয়ে জুইকে আমার কাছে রেখে কর্মের সন্ধানে চলে যায় ঢাকায়। সেই থেকে নাতনী জুইয়ের ভরণ পোষণ করতে হয় আমাকেই। কয়েক মাস আগে একমাত্র বড়ভাই মারা যাওয়ায় মা কুসুম বালা চলে আসে আমার কাছে।’

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/08/1552041981992.jpg

তার মা কুসুম বালা বার্তা২৪.কমকে জানান, তার বয়স ১০০ এর কাছাকাছি। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে ছেলেই ভাত কাপড় দিত। বছর খানেক আগে ছেলেও মারা যায়। এরপর ছেলের বউয়ের অত্যাচারে চলে আসতে বাধ্য হন মেয়ে শেফালীর কাছে। সেখানে ঘর কম থাকায় আশ্রয় হয়েছে খোলা বারান্দায়। বারান্দায় রাত কাটলেও তিন বেলা খাবার পেয়ে খুশি কুসুম বালা।

শেফালী রানী বলেন, ‘চেয়ারম্যান-মেম্বার থেকে শুরু করে এমপি পর্যন্ত আমাকে চেনেন লক্ষীর মা হিসেবে। কিন্তু সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় না আমাকে। সরকারি সুবিধা পেলে তার পরিশ্রম অনেকটা কমে যেত।’

রহবল পুর্বপাড়া গ্রামের পল্লী চিকিৎসক বজলুর রশিদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘শেফালী রানীকে অত্র এলাকার সবাই চেনেন লক্ষীর মা বলে। আর্ন্তজাতিক নারী দিবসে কত নারীকে সম্মাননা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করা সংগ্রামী নারী লক্ষীর মা’র খবর কেউ রাখে না।’