‘কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ শাহনাজ কবীর



ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
নিজ কার্যালয়ে 'কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ শাহনাজ কবীর/ ছবি: সংগৃহীত

নিজ কার্যালয়ে 'কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ শাহনাজ কবীর/ ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

একই সঙ্গে তিনি লড়ছেন শরীরের ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার এবং সমাজের অন্ধকার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। জীবনের প্রদীপ হাতে আলোর শিখা নিয়ে ছুটে চলেছেন প্রতিনিয়ত। তিনি যুদ্ধ করছেন নারীর স্বাস্থ্য, স্বীকৃতি, শিক্ষা, প্রগতি ও আত্মোন্নয়নের জন্য।

কিশোরগঞ্জের শিক্ষা ও উন্নয়নের ইতিহাসে নারী জাগরণের উজ্জ্বল মুখচ্ছবি তিনি। লড়াকু শিক্ষয়েত্রী, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট শাহনাজ কবীর হার-না-মানা সংগ্রামশীলতার পথে চলে স্থাপন করেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত। তাকে সবাই শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় সম্বোধন করেন ‘কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ নামে।

আদর্শবান পুলিশ অফিসার পিতার কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন লড়াকু মনোবৃত্তি, নীতি-নৈতিকতা, অধ্যবসায়, নিয়ম ও নিষ্ঠা। বৃহত্তর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোণার সীমানায় বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জের জলমগ্ন হাওরের জন্মভূমি থেকে পেয়েছেন মানবিক উদারতা।

পিতার কর্মসূত্রে নৈসর্গিক বাংলাদেশের বহু স্থানে বসবাসের অভিজ্ঞতায় অর্জন করেছেন মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অসীম ভালোবাসা। গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন উচ্চশিক্ষা। দেশ-বিদেশ থেকে নিয়েছেন শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ। দিনে দিনে নিজেকে তৈরি করেছেন আদর্শ শিক্ষকের অবয়বে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/18/1552906112571.jpg

সুগভীর মমতা নিয়ে শাহনাজ কবীর শিক্ষকতার মহৎ পেশা গ্রহণ করে কঠোর শ্রম ও কর্মনিষ্ঠায় আরোহণ করেছেন উচ্চতম সম্মানের আসনে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে শতবর্ষস্পর্শী কিশোরগঞ্জ এস.ভি. সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষয়েত্রী হয়ে তিনি যখন এলেন, তখন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টি অবক্ষয়ের মুখে।

কিন্তু অতি অল্প সময়ে ঐতিহ্য ও সুনামের দিক থেকে অস্তগামী একটি স্কুলকে অলৌকিক জাদুবলে হৃত-মর্যাদার আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন শাহনাজ। স্কুলের সাফল্যের সূত্রে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ‘কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ শাহনাজ কবীরের সুখ্যাতি।

নিজের পেশাগত সুনাম ও প্রতিষ্ঠানের সুখ্যাতি সমুন্নত রাখতে শাহনাজ কবীর পালন করেন চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা। ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের নিয়ে পরিবারের মতো গড়ে তুলেন স্কুলকে। ফলও পান হাতেনাতে। শুধু জেলা বা বিভাগের মধ্যেই নয়, দেশের সেরা স্কুলের কাতারে চলে আসে এস.ভি. স্কুল। তার নিজের নামও চলে আসে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের তালিকায়।

শুধু পড়াশোনা নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজেও তিনি নিজে ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। গান, বাজনা, আবৃত্তি, নৃত্য, বিতর্ক, বিজ্ঞানমেলার মাধ্যমে বিকশিত করেছেন বহু শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা। বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ প্রীতির ফলিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে সবুজে শোভিত করার মাধ্যমে। তপোবন-সদৃশ এস.ভি. স্কুলের ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণে কোণে ও শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের গোপন অলিন্দে তিনি কর্ম ও কীর্তির মাধ্যমে জীবন্ত করে রেখেছেন নিজেকে। কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে হয়েছেন আদর্শ শিক্ষকের আলোকিত মডেল। 

সমাজের আলোকিত গুণিজনদের বিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়মিত আলাপচারিতা ও সভার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করেছেন শিক্ষার্থীদের। শ্রেণী কক্ষের সীমিত পরিসর ডিঙিয়ে শিক্ষার্থীরা যেন সফল মানুষের কথা শুনে জীবন সংগ্রামের কঠিন পথ পাড়ি দিতে পারেন, শাহনাজ কবীর সেই চেষ্টাই অব্যাহত রেখেছেন। 

জীবনমুখী ও সজীব শিক্ষয়েত্রী শাহনাজ কবীর কর্মকে মনে করেন ধর্মের মতো পবিত্র। কাজের ব্যস্ততায় টের পান না নিজের ভেতরের অসুস্থতা। অবস্থা খারাপের দিকে চলে গেলে চিকিৎসার মাধ্যমে জানতে পারেন, তার ক্যান্সার হয়েছে, রোগটির নাম ‘মাল্টিপল মাইলোমা’। 

মোটেও ভেঙে পড়েননি তিনি। সৃষ্টিকর্তা ও নিজের সুকর্মের প্রতি ভরসা রেখে লড়াই শুরু করেন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে। কেমোথেরাপি আর কঠিন চিকিৎসা, নিয়মানুবর্তিতা ও লড়াকু-সাহসী মনোবৃত্তির মাধ্যমে নিজেকে সচল ও কর্মমুখর রাখতে সচেষ্ট হন তিনি। প্রিয় শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষার্থীদের মাঝে কর্মনিষ্ঠ থেকে উপভোগ করেন জীবনকে এবং জীবনের প্রতিটি মূল্যবান সময়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/18/1552906133135.jpg

শাহনাজ কবীর ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, কষ্ট ও পরিশ্রমকে হাসিমুখে বরণ করে শিক্ষা ও নারী উন্নয়নের পথে চলতে চলতে এক সময় কলম হাতে তুলে নেন। রচনা করেন ‘ক্যান্সার ও ভালোবাসা’ নামের জীবনঘনিষ্ঠ গ্রন্থ। যে সাহস ও লড়াইয়ের চেতনা তিনি সারা জীবন লালন করেছেন, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়তে লড়তে সেই অকুতোভয় কথাগুলোই মানুষকে জানিয়ে যান তিনি বেদনার্ত অক্ষরে। 

ব্রহ্মপুত্র আর মেঘনার দুহিতা নরসুন্দা নদী তীরের প্রাচীন জনপদ কিশোরগঞ্জের মাটি ও মানুষকে অবলম্বন করে পুরো দেশবাসীকে শাহনাজ জানিয়ে যান তার সংগ্রাম ও লড়াইয়ের কথা, নারীর শিক্ষা ও অগ্রগতির সংগ্রামের কথা। ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতাকে জয় করে সমাজের জন্য নিবেদিত হওয়ার কথা। 

একদা তিনি যখন থাকবেন না, তখন তার কর্ম ও লেখনি অনাগতকালের মানুষকে মনে করিয়ে দেবে ‘কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া’ নামে পরিচিত লড়াকু শিক্ষয়েত্রী শাহনাজ কবীরকে। সবাই জানবে, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার মতো শাহনাজ কবীর নামে একজন লড়াকু শিক্ষয়েত্রী এসেছিলেন এই জনপদে, ভাটিবাংলার জলছলছল শ্যামলিমাময় ভূগোল কিশোরগঞ্জে।

এই লেখাটি লেখার সময়ও শাহনাজ কবীর বিদেশে একটি হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেখান থেকে এই কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি প্রতিদিন তার প্রিয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেন বলে জানা গেছে।

   

উপকূলে ঝড়ের বিপদ সংকেত, ঢাকায় চিত্রকরের নীল মেঘ!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

উপকূলে চলছে ৩ নম্বর বিপদ সংকেত। দমকা বাতাসের তোড়ে সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ। আকাশে হৈ হৈ রব তুলে দখল করেছে কালো মেঘ। ছড়িয়ে দিচ্ছে গুড়ুম গুড়ুম ডাক! কয়েক ঘণ্টা বাদেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আসার সম্ভাবনা। তবে কথায় বলে, বাজ পড়ার আগে আকাশ শান্ত হয়ে যায়!

ঠিক যেন প্রকৃতি তার সেই রূপটিই মেলে ধরলো। উপকূল অঞ্চলগুলোতে মানুষজনকে সতর্ক করা হচ্ছে। ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ অথচ রাজধানীর আকাশ স্নিগ্ধ-কোমল!

শুধু কী তাই! ছবি আঁকার পর শিল্পী তার রঙ মাখা তুলিগুলো এলোমেলো করে ফেলে রাখে যেমন, সেই ছবি যেন আকাশে সেঁটে দিয়েছে কেউ। লাল, গোলাপি, কমলা, নীল, বেগুনি রঙের মিশ্রণে অপূর্ব সুন্দর এক এলোমেলো চিত্র উঁকি দিচ্ছে আকাশে। তার মাঝে ধূসর মেঘ ঘোলা জলে মাছের মতো দুরন্তপনায় ছুটে যাচ্ছে বহুদূর।

শনিবার (২৫ মে) গোধুলি লগ্নে ঢাকার আকাশ ঠিক এভাবেই রঙিন হয়ে ওঠে। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ রংধনুর ছোঁয়া ছাড়াই রঙিন পটচিত্রের রূপ মেলে ধরে গগন, যেন আকাশ নয়, কোনো চঞ্চলা কিশোরীর উৎফুল্ল মন! প্রকৃতি এখন স্তব্ধ হয়ে আছে। গাছের একটি পাতাও যেন নড়ছে না। অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরের অথৈ উম্মাদনা। স্থানীয়দের ভয়, জলোচ্ছ্বাসে যেন তাদের জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এমনি করেই প্রকৃতির বহুরূপী লীলাখেলা চলতে থাকে অবলীলায়।

;

বিখ্যাত মিমের ভাইরাল কুকুর কাবোসু আর বেঁচে নেই



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ভাইরাল কুকুর কাবোসু / ছবি: সংগৃহীত

ভাইরাল কুকুর কাবোসু / ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন মানুষ জুড়তে শুরু করলো ইন্টারনেটে নতুন অনেক নতুন উদ্ভাবনার দেখা মিললো। এমন এক ব্যাপার হলো মিম। বর্তমান সময়ে সেন্স অব হিউমারের (রসবোধ) এক অন্যতম মাধ্যম এই মিম। বিশেষত কোনো ছবি ব্যবহার করে তাতে হাস্যরসাত্মক কিছু জুড়ে দিয়ে এইসব মিমগুলো বানানো হয়।

২০১৩ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনই একটি ছবি ভাইরাল হয়। পরবর্তী সময়ে যা একটি বিখ্যাত ‘মিম ম্যাটেরিয়াল’-এ পরিণত হয়। কমলা-সোনালী এবং সাদা রঙের সম্বনয়ে বাহারি লোমের এই কুকুরটির নাম কাবোসু। কাবোসুর বয়স ১৯ বছর।

দুর্ভাগ্যবশত কুকুরটি আর বেঁচে নেই। ২৪ মে (শুক্রবার) দীর্ঘদিন ধরে রোগাক্রান্ত থাকার পর অবশেষে দেহ ত্যাগ করে কুকুরটি। কুকুরটির মালিক আতসুকো সাতো (৬২) জাপানের চিবা প্রিফেকচারের সাকুরা শহরের একটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক।শুক্রবার তার প্রকাশিত ব্লগে একটি দুঃখের কবিতা আবৃত্তির পর তিনি এই খবরটি নিশ্চিত করেছেন।

ভাইরাল কুকুর কাবোসু / ছবি: সংগৃহীত

১৯ বছর বয়সেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ২৬ মে রবিবার কাবোসুর স্মরণে একটি স্মরণ সভার আয়োজনও করা হবে। কুকুরটির মারা যাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকলে দুঃখ প্রকাশ করছে।

২০২২ সালে ক্রোানক লিম্ফোমা লিউকুমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। সেই থেকেই কাবোসুর চিকিৎসা চলছিল। তবে দুঃখের বিষয়, সে আর সুস্থ হয়ে ফিরতে পারলো না।

কাবোসুর ত্যাড়া চোখে দৃষ্টির একটি ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। এটি ইন্টারনেটে সবচেয়ে আইকনিক এবং স্বীকৃত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এমনকি ক্রিপ্টো কারেন্সির দুনিয়াতেও তার নাম ছিল।

;

বুদ্ধ পূর্ণিমার তাৎপর্য



অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা। বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এক মহান দিন এটি। এই দিনে গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। একই দিনে মহাজ্ঞানী বুদ্ধত্ব এবং বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। এই তিথিকে বলা হয় বৈশাখী পূর্ণিমা, যা আজ বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক ভেসাক ডে হিসেবে পালন করা হয়। বৈশাখ মাসের এই তিথিতে মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল। ত্রি-স্মৃতিবিজড়িত এ তিথির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যন্ত বিশাল।

খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে এই দিনে আড়াই হাজার বছর আগে মহামতি গৌতম বুদ্ধ ভারতবর্ষের তৎকালীন কপিলাবস্তু দেবদহ নগরের মধ্যবর্তী লুম্বিনী কাননে মাতা রানী মায়াদেবীর পিতৃগৃহে যাবার পথে শালবৃক্ষের নিচে জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে ৩৫ বছর বয়সে বোধিবৃক্ষমূলে কঠোর সাধনা বলে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে ৮০ বছর বয়সে একই দিনে ৪৫ বছর দুঃখ মুক্তির ধর্ম প্রচার করে কুশীনগরে যুগ্মশাল তরুণমূলে চিরনির্বাসিত হয়ে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন অর্থাৎ তিনি দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। পৃথিবীতে আর জন্মলাভ করবেন না। গৌতম বুদ্ধের পিতার নাম ছিল রাজা শুদ্ধধন ও গৃহী নাম ছিল সিদ্ধার্থ। ২৫২৭ বছর আগে ভারতবর্ষে যখন ধর্মহীনতা মিথ্যা দৃষ্টি সম্পন্ন বিশ্বাস্বে ধর্মে সমাজের শ্রেণি বৈষম্যের চরম দুরবস্থা ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত, প্রাণী হত্যায় চরম তুষ্টি ,তখন শান্তি মৈত্রী অহিংস সাম্য ও মানবতার বার্তা নিয়ে মহামতি বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে।

গৌতম বুদ্ধ অহিংস ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছেন। এই জীবজগৎ অনিত্য দুঃখ অনাত্মাময় প্রাণমাত্রই প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। অস্থায়ী বা অনিত্য কার্যতকারণের অধীন। তিনি জীবনের প্রগাঢ় খাটি চার আর্যসত্য আবিষ্কার করলেন। জগতে দুঃখ আছে, দুঃখের অবশ্যই কারণ আছে, দুঃখের নিবৃত্তি আছে, দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আছে। দুঃখ নিবৃত্তির উপায় হলো নির্বান লাভ। এই নির্বান লাভের ৮টি মার্গ আছে। যেমন সম্যক বা সঠিক দৃষ্টি , সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি। এই পথ পরিক্রমায় শীল সমাধি প্রত্তোয় নির্বাণ লাভের একমাত্র উপায়। সব প্রাণী সুখী হোক, পৃথিবীর সবচেয়ে পরম, মহৎ বাণী তিনি প্রচার করেছেন। শুধু মানুষের নয়, সব প্রাণ ও প্রাণীর প্রতি, প্রেম, ভালোবাসা, অহিংসা, ক্ষমা, মৈত্রী, দয়া, সহনশীলতা, সহমোর্মিতা, সহানুভূতি, মমত্ববোধ, প্রীতি, সাম্য, সম্প্রীতির কথা তিনি বলেছেন।

১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৫৪/১১৫ রেজুলেশন এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক ভেসাক ডে হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সেই থেকে এই দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ “ভেসাক ডে” হিসেবে পালন করে আসছে। বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র এই দিনকে বিভিন্ন নামে পালন করা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, নেপালে বুদ্ধ পূর্ণিমা, লাওসে বিশাখ পূজা, ইন্দোনেশিয়া হারি ওয়াইসাক ডে, মালয়শিয়ায় ওয়েসাক ডে, মায়ানমারে ফুল ডে অব কাসন, সিঙ্গাপুরে হারি ভেসাক ডে নামে পালন করে থাকে আবার কেউ বুদ্ধ জয়ন্তী দিবস হিসেবেও পালন করে থাকে।

জাতিসংঘের মহাসচিব এস্তেনিও গুতেরেজ ভেসাক ডে উপলক্ষে বলেছেন, “On the day of Vesak, Let us celebrate Lord Buddha’s wisdom by taking action for others with compassion and solidarity and by renewing our commitment to build a peaceful world.”

ফিলিস্তিনে আজ চরমভাবে মানবতা বিপন্ন হচ্ছে। অশান্তিময় এই পৃথিবীতে বুদ্ধের মৈত্রী, সংহতি, সাম্য, মানবতা ও শান্তির বাণী বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আজও প্রাসঙ্গিক এবং খুব প্রয়োজন। বিশ্ব আজ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। পরিবেশ দূষণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, জলাবদ্ধতা, বৃক্ষ নিধন, বন উজাড়, জীব বৈচিত্র্য হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন এই সবুজ গ্রহের ইতিহাসে নজিরবিহীন। গৌতম বুদ্ধই প্রথম বৃক্ষকে এক ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট জীবরূপে আখ্যায়িত করেছেন। বুদ্ধ ছিলেন বিশুদ্ধ পরিবেশবাদী দার্শনিক। পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। তাই বুদ্ধের জন্ম বুদ্ধত্ব লাভ ও মহা পরিনির্বাণ বৃক্ষের পদমূলের বিশুদ্ধ পরিবেশ মন্ডিত পরিবেশে সংগঠিত হয়েছিল।

এই পবিত্র দিনে বৌদ্ধরা বিভিন্ন দেশে দেশে সব প্রাণীর সুখ শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা করেন। অশান্ত পৃথিবীতে পরিবেশ সংরক্ষণে বুদ্ধের বাণী নীতি ও আদর্শ বিশ্ব মানবতার শিক্ষা, দর্শন, চিন্তা চেতনা ,ভাবনা সুন্দর, শান্ত, সাম্যময় পৃথিবী গড়ার বিকল্প নাই। সব প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করুক।

অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া
চিকিৎসক, লেখক, সংগঠক ও গবেষক

;

মহামতি সিদ্ধার্থ গৌতম



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।
ধর্মং শরণং গচ্ছামি।

সিদ্ধার্থ গৌতম খৃষ্টপূর্ব ৫৬৪সালে(এই সাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে) কপিলাবস্তুর লুম্বিনীতে (বর্তমানে নেপালের অন্তর্গত) শাক্য রাজা শুদ্ধোধন এর প্রাসাদে তাঁর মহিষী মায়া দেবীর ঔরষে জন্মগ্রহণ করেন। দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি।

তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। রাজকার্য তাঁকে আকর্ষণ করতো না। জীবনের গূঢ় রহস্য নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন। তিনি লক্ষ্য করলেন সংসারে কর্মই প্রধান। বাকি সবই অনিত্য। তিনি ভাবতেন জরা, ব্যাধি, মৃত্যু থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে। যৌবনের এক পর্যায়ে প্রাসাদে মাতা, পিতা, স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে রেখে এক রাতে তিনি বেরিয়ে পড়েন পথে। গ্রহণ করলেন শ্রমণের জীবন।

একসময় তিনি গয়ার নিকট উরুবিল্ব (বর্তমানে ভারতের বিহারের বৌদ্ধগয়া) গ্রামে এক বৃক্ষতলে মোক্ষলাভের উপায় ভাবতে জাগতিক সমস্ত আকর্ষণ ত্যাগ করে ধ্যান করতে বসেন। ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত অবস্থায় এক বৈশাখী পূর্ণিমায় তিনি আলোকপ্রাপ্ত হন। তিনি লাভ করলেন দিব্যজ্ঞান। এই জ্ঞানই হলো অজ্ঞানতা ও অশিক্ষা, লোভ এবং আকাঙ্খা, রোগ ও দুঃখভোগ এবং পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি। সেই মুক্তিলাভের উপায় হলো জীবন যাপনে শুদ্ধাচার।

তাঁর আশি বছরের জীবনের বাকি অংশ তিনি কাটালেন তাঁর মোক্ষলাভের সূত্র এবং লোভ, হিংসা-দ্বেষহীন পরোপকারের জীবন ধারণের জন্য শিষ্য এবং শিষ্যদের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করে। বারানসীর অদূরে সারনাথে প্রথম পাঁচজনকে তিনি শিষ্যত্বে বরণ করেন। এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বর্ধিত হতে থাকে এবং প্রচার ছড়িয়ে পড়তে থাকে দিকে দিকে। বৃহৎ এক জনগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় তাঁর এই প্রচার।প্রথমে গাঙ্গেয় অববাহিকাতে চলে এই প্রচারাভিযান। পরে তা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

এইভাবে শান্তির অমোঘ বাণী প্রচারে বাকি জীবন কাটিয়ে তিনি যখন বুঝলেন তাঁর ধরাধাম ত্যাগের সময় হয়েছে, তখন তিনি তাঁর প্রচার সাথী শিষ্যদের উদ্দেশ্যে শেষ দেশনা প্রদান করেন। সেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেন যে তিনি তাঁদের পথের দিশা দেখিয়ে গেলেন মাত্র। মানুষ মরণশীল।মানব জীবনে দুঃখ,কষ্ট জরা,ব্যাধি অবশ্যম্ভাবী।তাই জীবদ্দশায় উচিৎ সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে সৃষ্টির সকল জীবের কল্যাণসাধন করা।তাঁদেরকে নিজের আত্মাকে আলোকিত করে নিজেকেই আলোকপ্রাপ্ত হতে হবে।

মল্ল রাজত্বভুক্ত কুশিনগরে তিনি মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন। কি আশ্চর্য! সেই দিনটিও ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই তিন বিশেষ দিনের সমষ্টিকে ভেসাক ডে হিসাবে পালন করা হয়। ভারত থেকে তিব্বত হয়ে চীন, জাপান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর সহ পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম একসময় ছড়িয়ে পড়ে। যার বিপুল প্রভাব এখনো বিদ্যমান।

শাক্যমুণি গৌতমবুদ্ধর প্রধানতম শিক্ষা ও প্রার্থনা হলো জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক। সিদ্ধার্থ গৌতমের ধর্ম গ্রহণ করে সম্রাট অশোক তা তাঁর রাজত্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে দেন। সম্রাট অশোক লুম্বিনীতে তীর্থভ্রমণ করাকালীন একটি স্তম্ভ স্থাপন করেন। সেই স্তম্ভে ব্রাহ্মী লিপিতে শাক্যমুনি বুদ্ধ কথাটি পাওয়া যায়। এর অর্থ করা যায় শাক্যদের মধ্যে তপস্বী ও আলোকপ্রাপ্ত।

মহামতি বুদ্ধের বাণী প্রথম দিকে ছিল শ্রুতি নির্ভর। পরবর্তীতে তা ভিনায়া বা প্রচারকদের (বর্তমানকালের শ্রমন বা ভান্তে) জন্য প্রতিপালনীয় বিধান ও সুত্ত পিতাকা বা বুদ্ধদেবের উপদেশসমূহ তাঁর শিক্ষা হিসাবে লিপিবদ্ধকরণ করা হয়। আরও পরে তাঁর অনুসারীরা অভিধর্ম, জাতক কাহিনী, মহাযান সূত্র ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার মধ্যে জাতক কাহিনীতে সিদ্ধার্থ গৌতমের পূর্ববর্তী জন্মসমূহের কথা লিপিবদ্ধ আছে। আলোকপ্রাপ্ত হয়ে পুনর্জন্ম থেকে মহামুক্তির আগে তিনি পূর্ব জন্মসমূহের কথা স্মরণ করতে পেরেছিলেন।বেশিরভাগ বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ আদিকালে পালি ভাষায় লিখিত হয়েছিল।

জ্ঞান অন্বেষণকে বৌদ্ধ ধর্ম সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়। বৌদ্ধ যুগেই পৃথিবীর বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় রূপে পরিচিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। আমরা গর্ব বোধ করতে পারি যে আমাদের মাটির সন্তান অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বৌদ্ধ ধর্মকে তিব্বতে প্রচারে প্রধানতম ভূমিকা রাখেন।তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম রাজধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ও সেখান থেকে চীন,কোরিয়া,জাপান সহ এশিয়ার দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ইতিহাসের এক পর্যায়ে ভারতবর্ষের বিশাল এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রাবল্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা এই ধর্মকে সিংহল দ্বীপে(বর্তমান শ্রীলঙ্কা) প্রসারিত করেন।আজও পৃথিবীতে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা বিভিন্ন ধারায় তাঁদের মহান শান্তির ধর্মকে পালন ও সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;