হাওড়া ব্রিজ যেন ইতিহাসের বাতায়ন!
কলকাতা থেকে ফিরে: বড়বাজারের শেষ প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে পায়ে হেঁটে হাওড়া ব্রিজে (সেতু) উঠছি। রাস্তাটির নাম মহাত্মা গান্ধি রোড। আগে নাম ছিল হ্যারিসন রোড। শিয়ালদা থেকে কলেজ স্ট্রিট, বড়বাজার হয়ে চলে গেছে কলকাতার টুইন শহর, নদীর ওপারের হাওড়ায়।
মুখে মুখে হাওড়া ব্রিজ বলা হলেও ওপরে মোটা হরফের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে পরিবর্তিত নাম 'রবীন্দ্র সেতু'। বাসের কন্ডাকটর, টেক্সির ড্রাইভার, পথের লোকজন কিন্তু পুরনো নাম হাওড়া বলেই ডাকাডাকি করছেন।
সেতু থেকে কলকাতার পুরনো অংশের ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে চলে গেলাম যেন ইতিহাসের গর্ভে, আঠারো-উনিশ শতকে। মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে আছি ইতিহাসের প্রাচীন বারান্দায়। সামনে হাওড়া ব্রিজ, নিচে ঔপনিবেশিক শহর কলকাতাকে ছুঁয়ে চিরপ্রবাহমান গঙ্গা।
বিদেশি শাসনে কলকাতা তখন ক্রমে তিলোত্তমা হয়ে উঠছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পসার জমেছে ভালোই। ফলে যাতায়াত, মালপত্তর, কাঁচামাল- সবকিছুর জন্যই বারবার পেরোতে হচ্ছে গঙ্গা। জলপথে যাতায়াতে অসুবিধে, সময়ও লাগে। তাই প্রয়োজন পড়ল সেতুর।
১৮৩৮ সালের নভেম্বরে ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’ পত্রিকা থেকে তৎকালীন সাধু বাংলা ভাষায় পরিবেশিত সংবাদে জানা গেছে, ‘হুগলি নদীর উপরি পুল করণে গবর্ণমেন্ট মনস্থ করিয়াছেন, ঐ পুল নির্ম্মাণ করণার্থ ব্যয় ১২০০০০০ টাকা নির্দ্ধার্য্য হইয়াছে।’ (পুরাতন বানান অপরিবর্তিত)।
সেতুর খরচ ও আয়োজন বিরাট। সেই যুগের হিসাবেও বড় অঙ্ক। ১৮৫২ সালে হাওড়া রেলস্টেশন চালু হয়ে যাওয়ায় সেতুর প্রয়োজন আরও বাড়ল। জরিপ হল। প্রাথমিকভাবে জর্জ টার্নবুলের দেওয়া পলতার কাছে সেতু তৈরির প্রস্তাব নাকচও হল।
ইতোমধ্যে, ১৮৭০-এ তৈরি হল পোর্ট ট্রাস্ট। ১৮৭১-এ শুরু হল পুরোদমে সেতু গড়ার কাজ। সেতুর কাঠামো ও যন্ত্রাংশ তৈরি হয়েছিল ইংল্যান্ডে।
আদিতে হাওড়া সেতু ছিল পন্টুন সেতু, যা আজকের হাওড়া সেতুর পূর্বপুরুষ। আজকে যে সেতুটির কাঠামো দেখতে পাওয়া যায়, তা চালু হয় ১৯৪৩ সালে। পুরোনো সেতুটির কথা মাথায় রেখে তখন এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নিউ হাওড়া ব্রিজ’। অবশ্য, লোকমুখে সেটি কেবলই হাওড়া ব্রিজ।
কলকাতার আইকন নামে খ্যাত এই সেতু একটা বিস্ময়। ‘হাওড়া ব্রিজ’ নামে সিনেমাও তৈরি হয় বলিউডে। কবিতার বই রচনা করেন ভিনদেশি কবি। সেতুটি নিয়ে কম মুগ্ধতা ছিল না শহরবাসীরও।
সব বড় স্থাপনায় যেমন হয়, হাওড়া ব্রিজের ক্ষেত্রেও তেমন হয়েছে। সেতু ঘিরে অস্থায়ী বাজার। রেলিং মার্কেট। হকারের জমাট ভিড়।
সেতুর নিচেও আধা-বস্তি ধাঁচের মার্কেট। পাশের বিখ্যাত বড়বাজারের পাইকারি দোকানের মালামাল খুচরা বিক্রি হচ্ছে। মনে হলো, আরশোলা থেকে হাতি পর্যন্ত যাবতীয় জিনিস কিনতে পাওয়া যাবে। কেবলমাত্র শিয়ালদা স্টেশনের পাশের বিশালাকার 'কোলো মার্কেটের সঙ্গে বড়বাজার-হাওড়া ব্রিজ মার্কেটের তুলনা করা চলে।
হাওড়া ব্রিজের মাঝ দিয়ে গাড়ি চলছে। আছে ট্রাম লাইন আর পায়ে হাঁটার পথ। স্টিলের কাঠামোতে পুরো সেতু অদ্ভুত দেখতে। রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে সেতুর অবয়ব।
সেতু থেকে নদী দেখা যায় নান্দনিক বিভায়। কলকাতা শহরকে মনে হয় ঔপনিবেশিক চাদরে জড়ানো স্মৃতির জনপদ। কলকাতার চলমান ইতিহাসে ঐতিহাসিক হাওড়া ব্রিজ উন্মুক্ত বাতায়নের মতো খুলে দেয় অতীতের অবারিত দিগন্ত।