প্রাচীন মিশরের যে আবিষ্কারগুলো ছিল আধুনিক সভ্যতার ভবিষ্যদ্বাণী



আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
মিশরীয় সভ্যতা : মানব ইতিহাসের এক সন্ধিঃক্ষণ

মিশরীয় সভ্যতা : মানব ইতিহাসের এক সন্ধিঃক্ষণ

  • Font increase
  • Font Decrease

নৃতাত্ত্বিক এবং গবেষকদের কাছে প্রাচীন মিশর একটা বিস্ময়। ক্যালেন্ডার থেকে লেখার ধারণা, অপারেশনের যন্ত্রপাতি থেকে আকাশচুম্বি নির্মাণ—মিশরীয় সভ্যতাকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় উন্নীত করেছে। ঠিক কিভাবে পিরামিড কিংবা মমি তৈরি করা হতো, এ নিয়ে এখনো দ্বিধাবিভক্ত গবেষকরা।

প্রাচীনকালে সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। ভারতে সিন্ধু নদ, মেসোপটেমিয়ায় টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর উপকূল এবং চীনে ইয়োলো নদী। মিশরীয় সভ্যতাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। নীল নদের তীরে জন্ম নেওয়া এই সভ্যতা অনেক দিক দিয়েই পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করেছে। সভ্যতার কেন্দ্র বলে যে গ্রিকদের কদর করা হয়, সেই গ্রিকরাও মিশরীয়দের কাছে ঋণী। থেলিস, পিথাগোরাস কিংবা খোদ এরিস্টটলের বহু ধারণাই প্রাচীন মিশরীদের থেকে গৃহীত।

যে সব আবিষ্কার মানবসভ্যতার গতিমুখ বদলে দিয়েছে মিশরীয় সভ্যতার এমন কিছু অবদান নিয়েই আজকের আয়োজন।

ধাতব যন্ত্রপাতি

আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগেই মিশরীয়রা টিন এবং তামাকে মিশ্রিত করে ব্রোঞ্জ তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। ব্রোঞ্জ অন্যান্য ধাতু থেকে অধিক স্থায়ী এবং মজবুত। প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে এই যুগ ব্রোঞ্জ যুগ বলে স্বীকৃত। 

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565255025861.jpg
◤ বিশেষ করে ব্রোঞ্জের ব্যবহারে তাদের দক্ষতা বিস্ময়কর ◢


ব্রোঞ্জের নির্মিত আসবাবপত্র, অস্ত্র, নির্মাণ কিংবা প্রসাধনী সামগ্রীর হদিস পাওয়া গেছে। আনুপাতিক মিশ্রণ এবং নির্মাণের নিখুঁত পরিকল্পনায় তাদের দক্ষতা প্রমাণিত।

লেখালেখি

প্রাচীন মিশরীয়রাই প্রথম সাংগঠনিকভাবে লেখালেখি করেছে। আর সেই সাথে লেখাগুলিকে জমা করে রেখেছে পরবর্তী কোনো পাঠকের জানার জন্য। জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেবার ইতিহাসের পত্তন সেখান থেকেই। মিশরীয়রা লেখার জন্য ব্যবহার করত হায়ারোগ্লিফিক। শব্দগুলো ছবির মতো এই ভাষায়। নৃতাত্ত্বিকেরা ১০০০ পৃথক অক্ষরকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565255161961.jpg
◤ প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক ◢


হায়ারোগ্লিফিক থেকেই উদ্ভুত হয়েছে হায়ারেটিক এবং ডেমোটিক লিপি। পরবর্তী আরমায়িক এবং গ্রিক লিপির জন্মও সেখান থেকে। এ কারণেই মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিককে আধুনিক অনেক ভাষারই পূর্বপুরুষ বলে গণ্য করা যায়।

প্যাপিরাস

প্যাপিরাস গাছের মজ্জা থেকে কাগজ তৈরির কৌশল মিশরীয়রাই প্রথম বের করেছে। পরবর্তীতে তাদের এই অবদান পুরো ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কারণ ভূমধ্যসাগর ছিল উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্বের মধ্যকার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। কাগজে লিখে পেঁচিয়ে স্ক্রল করে সংগ্রহ করা হতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লেখা।

প্যাপিরাসের সবচেয়ে প্রাচীন নজির আবিষ্কৃত হয় ২০১২ সালে। লোহিত সাগরের উপকূলে ওয়াদি আল জারফ নামের প্রাচীন অঞ্চলে। আবিষ্কৃত প্যাপিরাস ২৫৬০-২৫৫০ খ্রিস্টপূর্বব্দের বলে শনাক্ত করা হয়েছে। গিজা পিরামিডে খননকার্য চালানোর সময়েও পাওয়া গেছে এর নিদর্শন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565255521789.jpg

◤ কাগজ, কালি এবং লেখাতে আছে মিশরীদের অবদান ◢


মিশরীয়রা লাইব্রেরির ব্যবহারও সভ্যতাকে উপহার দিয়েছে। সময়ের ব্যবধানে টিকে থাকা একমাত্র লাইব্রেরি টেবটিউনিস মন্দির লাইব্রেরি। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালায়।

কালি

খালি কাগজে তো আর লেখা যায় না। সে কথা চিন্তা করেই প্রাচীন মিশরীয়রা প্রথমবারের মতো প্রস্তুত করেছিল কালি। গাছের আঠা, সবজির রস, কিংবা মোম দিয়ে কালি তৈরি করা হতো। আঠা বা রসের সাথে আবার অন্য এক বা একাধিক উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হতো বিভিন্ন রঙ।

ষাঁড়ে টানা লাঙল

নদী তীরবর্তীতে সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে প্রধানতম কারণ তাদের কৃষি নির্ভরতা। মিশরীরাও ব্যতিক্রম ছিল তাদের থেকে। তবে মিশরীয়দের অগ্রসরতার প্রমাণ, কৃষির জন্য ব্যবহৃত লাঙলের আবিষ্কার। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের দিকে মাটি চাষের জন্য মানুষকে লাঙল টানতে হয়নি; সেই স্থান নিয়েছে ষাঁড়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565255715359.jpg
◤ মিশরীয়দের প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থা ◢


মিশরীয়রা সবজি এবং গম চাষে বেশ সফলতা দেখিয়েছে। ফসল কাটা কিংবা মাড়াইয়ের জন্যও নিজস্ব ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটিয়েছিল।

খাল এবং নালা

সেচব্যবস্থার ক্ষেত্রে মিশরীয়রা পালন করেছে পথিকৃতের ভূমিকা। নীল নদ থেকে সবসময় পানি সবখানে পাবার জন্য খাল এবং নালা খনন করা হয়েছিল। তার ফলে নদ থেকে বহু দূরেও জন্ম নিয়েছিল বিশাল চারণভূমি ও ফসলের মাঠ। পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছিল গেইট। খরার সময় যেন পানির অভাবে বিপর্যয়ে পড়তে না হয়, তার জন্য রাখা হয়েছে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565256241207.jpg
◤ প্রাচীন মিশরীয় সেচ ব্যবস্থায় শাদুফের ব্যবহার ◢


মিশরীয়রা জলচক্র আবিষ্কার করেছিল, যার নাম শাদুফ। জলচক্রের একপাশে থাকত বালতি আর অন্য পাশে একটা ভারী বস্তু। বালতিটি নীল নদে ফেলে পূর্ণ করা হতো আগে। তারপর চাকা ব্যবহার করে উত্তোলন করা এবং ঘুরিয়ে নালার উপরে গিয়ে খালি হতো। এভাবে চলত সেচ।

ক্যালেন্ডার

মানবসভ্যতাকে সৌরপঞ্জিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে মিশরীয়দের অবদান অনন্য। কৃষি সম্পৃক্ততার দরুণই ঋতু সম্পর্কে বেখবর থাকা হয়ে উঠেনি। নির্দিষ্ট দিন পরপর পূর্ব আকাশে লুব্ধক নক্ষত্রের আগমন এবং সেই সাথে নীল নদে জোয়ারের মিলে যাওয়ার ঘটনা তাদের আগ্রহী করে তোলে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565256339937.jpg

◤ মিশরীয়দের ব্যবহৃত ক্যালেন্ডার ◢


এভাবে উদ্ভাবিত হয় ৩৬৫দিনের ক্যালেন্ডারের ধারণা, যা বিভক্ত ১২ মাসে। প্রত্যেক মাসে ছিল আবার ৩০দিন করে। বছর শেষে পাঁচ দিন উৎসবের দিন বলে গণ্য করা হতো। সামান্য কিছু ত্রুটি থাকলেও পঞ্জিকার ইতিহাসে তাদের এই প্রচেষ্টা তাৎপর্যপূর্ণ।

ঘড়ি

সূর্যঘড়ির জন্য মিশরীয়রা বিশেষভাবে বিখ্যাত। সূর্যঘড়ি হলো একটা দণ্ড পুতে রেখে তার ছায়ার হ্রাস-বৃদ্ধি হিসাব করে সময় বের করার প্রক্রিয়া। দিনের বিভিন্ন সময়কেই নির্দিষ্ট করা সম্ভব হলো না শুধু এর মাধ্যমে; সেই সাথে জানা গেল দিনের দৈর্ঘ্যের হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565256516740.jpg
◤ সূর্যঘড়ি ◢


খ্রিস্টপূর্ব ১৬ শতকের দিকের এক শিলালিপি পাওয়া গেছে মিশরীয় সমাধিতে। সেই সাথে মিলেছে ‘আমেনেমহেট’ নামের তৎকালে বহুল প্রচলিত জলঘড়ি। পাথরের পাত্রের তলায় ক্ষুদ্র ফুটো তৈরি করলে একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে পানি এই পাত্র থেকে কমে যেতে। আগে থেকেই পাত্রের গায়ে চিহ্ন আঁকা থাকত। সেই চিহ্ন নির্দেশ করত সময়ের। যাজকেরা রাতে এই ঘড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারণ করত ধর্মীয় আচার পালনের সময়।

খিলান

আধুনিক নির্মাণে খিলানের জনপ্রিয়তা এর প্রয়োজনের জন্যই। দেয়ালের মাঝখানে খালি স্থান রাখার কথা চিন্তা করেই মূলত খিলানের উদ্ভাবন। রোমান সভ্যতায় খিলানের প্রভূত চমৎকারিত্ব আমাদের বিস্মিত করে। তারও আগে খিলানের ব্যবহার করেছে মিশরীয়রা। পাথরের ওপর পাথর রেখে উপরের দিকে কেন্দ্রে মিলিত হতো দুই পাশ।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565257117538.jpg
◤ মিশরীয়দের খিলান ◢


তাদের এই প্রক্রিয়া অতোটা আধুনিক না হলেও প্রভাবশালী। পরবর্তী সভ্যতাগুলো নিজেদের মতো করে গ্রহণ ও উন্নত করেছে একে।

কাচ তৈরি

খ্রিস্টপূর্ব পনের শতকের দিকেই মিশরীয়রা কাচ উৎপাদন এবং ব্যবহার শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। তৈরি হতো বিভিন্ন রঙের কাচের পাত্র এবং আসবাবপত্র। চীনামাটি, বালি কিংবা অনুরূপ পদার্থসমূহকে উত্তপ্ত করে গলিয়ে ফেলা হতো প্রথম দফায়। আকৃতি দেওয়ার জন্য রাখা হতো অনুরূপ মজ্জার চারপাশে। তারপর বেড় এবং হাতল যোগ করার পর সরিয়ে ফেলা হতো ব্যবহৃত মজ্জা।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565257220504.jpg

◤ কাচ উৎপাদনকে তারা নিয়েছিল শিল্পের পর্যায়ে ◢


এই কাচপাত্র চলে যেত ফিনিশীয়, হিব্রু কিংবা গ্রিকদের কাছে। মিশরীয় কাচের সুনাম ছিল গোটা ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল জুড়েই।

আসবাবপত্র

হাওয়ার্ড কার্টার ১৯২৩ সালে তুনেনখামেনের সমাধি আবিষ্কার করেন। মজার ব্যাপার হলো, সেখানে পাওয়া গেছে অনেক ফার্নিচার। প্রাচীন মিশরীয়রা যে টেবিল, বিছানা, বসার টুল প্রভৃতির সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত ছিল; তা প্রমাণিত।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565257492943.jpg
◤ প্রাচীন মিশরীয় আসবাবপত্র ◢


প্রথমদিকের টেবিলগুলো ওপরে কিছু রাখার জন্য ব্যবহৃত হলেও পরের দিকে বেশিরভাগ ছিল সেনেতের জন্য। সেনেত ইতিহাসের সবচেয়ে পুরাতন ঘরোয়া খেলার মধ্যে একটা। খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ সালের লিখিত হায়ারোগ্লাফিকেও এর উল্লেখ আছে।

শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি

খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ সালের চিকিৎসার প্রণালি লেখা প্যাপিরাসের লিপি পাওয়া গেছে। সেখানে ব্যথা, কাটা, হাড়ভাঙা, স্থানচ্যুতি, ফোঁড়ার মতো ৪৮ প্রকার শল্যচিকিৎসার বিশ্লেষণ, রোগীর পথ্য ও কর্তব্য নিয়ে লেখা আছে। ব্যথাগুলো মূলত বেশির ভাগ মাথা, কাঁধ, গলা, বুক এবং পাঁজর সম্পর্কিত।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565257716892.jpg
◤ শল্যচিকিৎসাতেও তাদের অবদান পৃথিবীর বাঁক ঘুরিয়ে দেবার মতো ◢


অপারেশনের সময় কর্তব্য এবং বিভিন্ন যন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কেও ধারণা দেওয়া হয়েছে। বাদ যায়নি ব্যান্ডেজ কিংবা প্লাস্টারের কথাও। কালো আর লাল কালির মিশেলে লেখা লিপিটি কায়রো জাদুঘরে রক্ষিত আছে। তার সাথে আছে ক্ষুর, শল্যছুরি, ফর্সেপস্, হুক, পিতলের নিডল এবং অন্যান্য অনেক চিকিৎসা বিষয়ক যন্ত্রপাতি।

টুথপেস্ট

মিশরীয়রা টুথপেস্ট আবিষ্কার করেছিল ষাঁড়ের খুড়, ছাই, পোড়া ডিমের খোসা থেকে। এছাড়া রক সল্ট, পুদিনা এবং কিছু নির্দিষ্ট ফুলকে শুকনো করে কাজে লাগানো হতো। সেই সময়ে তাদের এই প্রচেষ্টাই বর্তমানে টুথপেস্ট হিসাবে রূপান্তরিত হয়ে পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/08/1565258065483.jpg
◤ এমনকি টুথব্রাশও তাদের আবিষ্কার ◢


মানব সভ্যতার ইতিহাস আবিষ্কারের ইতিহাস। যে সমাজের আবিষ্কারের ঝুলি যত বেশি সমৃদ্ধ, তারা ততো বেশি অগ্রসর। আধুনিক ইউরোপ কিংবা আমেরিকার দিকে তাকালেই সেকথা উপলব্ধি করা সম্ভব। সেই আবিষ্কারের ইতিহাসে মিশরীয়দের অবদান নির্ধারণ করেছে পরবর্তী পৃথিবীর ভাগ্য। আধুনিক মানব তার দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুর জন্যই মিশরীয়দের কাছে ঋণী।

   

ফেনী শহরে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে কৃষ্ণচূড়া



মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফেনী
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

'কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে-আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে' জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই মনোমুগ্ধকর গানে ফুটে উঠেছে কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য। কৃষ্ণচূড়া যেন প্রকৃতিকে দান করেছে লাল আভার অপরূপ সৌন্দর্যের মহিমা। সাথে গ্রীষ্মের উত্তাপে শহরে সৌরভ ছড়াচ্ছে নানা জাতের ফুল। তীব্র তাপদাহের পর কালবৈশাখী, এরপর মাঝারি বৃষ্টির মধ্যে ফুলের আগমন। এতে রঙের উল্লাসে মেতে উঠেছে ফেনী শহরবাসী।

ফেনী শহরের কোর্ট বিল্ডিং, এলজিইডি, পুলিশ লাইন, নবীন চন্দ্র সেন কালচারাল সেন্টার, ফেনী সরকারি কলেজ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া। এটি একদিকে প্রকৃতিকে যেমন সাজিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যে, অন্যদিকে এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করছে তরুণ-তরুণী, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষসহ ফুলপ্রিয় পথচারীদের। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে, সরকারি দফতরসহ স্কুল-কলেজে কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল ও উজ্জ্বল সবুজ পাতার সংমিশ্রণ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে চারপাশ।


কৃষ্ণচূড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ফুলের ঘ্রাণে মুখরিত হয়ে আছে পুরো শহর। শহরের মূল সড়কের ডিভাইডারে পৌরসভার উদ্যোগে লাগানো হাসনাহেনা, রজনিগন্ধা, গন্ধরাজসহ নানা জাতের ফুল গাছে ফুল ফুটেছে। এটি একদিকে বাড়িয়েছে সৌন্দর্য অন্যদিকে হেঁটে কিংবা রিকশায় চলাচল করলে পাওয়া যায় এসব ফুলের সুঘ্রাণ।

ফেনী শহরের কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে ফুলপ্রিয় পথিকরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া ফুল প্রকৃতিকে অনন্য সাজে সাজিয়েছে। এই ফুলের সৌন্দর্যের কারণে পথচারীরা একবার হলেও এই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এর গাছের উপর নজর দিবে। পাশাপাশি তীব্র গরমে অন্যান্য ফুলের সুঘ্রাণে চারপাশ মুখরিত হওয়াতে ক্লান্তিতা কিছুটা হলেও কমছে।


তারা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া ফুলের এই নান্দনিক দৃশ্য দেখতে এর গাছ রোপণ করা জরুরি। রাস্তা প্রশস্তকরণ, ঘর-বাড়ি নির্মাণসহ নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে ফেলা হয়। অন্যান্য গাছ রোপণ করার পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া রোপণ করলে একদিকে যেমন সৌন্দর্য বাড়াবে অন্যদিকে পরিবেশ বান্ধব হবে।

সাজিদ হাসান নামের এক পথচারী বলেন, কৃষ্ণচূড়া একদিকে যেমন প্রকৃতিতে অপরুপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে, আরেকদিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমাবে। সারাদেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে, আমার মতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এই গাছটিও যুক্ত করা উচিত। তীব্র গরমের পর বৃষ্টি হলো, এরপর শহরে নানা রঙের ফুলের দেখা মিলছে, ফুলের ঘ্রাণে চলাচল করতেই ভালো লাগছে।

ফারজানা ইয়াসমিন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ফুলের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। অন্যান্য ফুলের পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া ফুল আমার অনেক ভালো লাগে। আমাদের কলেজে বকুল তলা আছে, ক্যান্টিনের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। সুযোগ পেলেই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করি।

অনিক মোহন নামে একজন বলেন, রিকশায় করে যখন বাসায় ফিরি, শহরের রাস্তার মাঝে ভিডাইভারে লাগানো নানা জাতের ফুলের ঘ্রাণ মনকে আনন্দিত করে। রাতের বেলা শহর যখন নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন এ ফুলের সৌন্দর্য কয়েকশ’ গুণ বেড়ে যায়।

সড়কের পাশে কৃষ্ণচূড়া লাগানো হলে সৌন্দর্য বাড়বে বলে মনে করেন পথচারী মিনহাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে, ওই গাছগুলোর জায়গা কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাগালে রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে।

একই কথা বলেন শহরের ব্যবসায়ী নাদিম আহমেদ। তিনি বলেন, সৌন্দর্য ও পরিবেশের কথা বিবেচনা করে এই গাছ রোপণ করা উচিত আমাদের। তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে অন্যন্যা গাছ রোপণ করার পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেগুলো শহরে আছে তাতেই সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ, আরও যদি লাগানো যায় ফুলে ফুলে ভরে উঠবে আমাদের শহর।

কৃষ্ণচূড়া মাদাগাস্কারের শুষ্ক পত্রঝরা বৃক্ষের জঙ্গলে পাওয়া যায়। যদিও জঙ্গলে এটি বিলুপ্ত প্রায়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি জন্মানো সম্ভব হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধন গুণ ছাড়াও, এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় ছায়া দিতে বিশেষভাবে উপযুক্ত। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদ উচ্চতায় কম (সর্বোচ্চ ১২ মিটার) হলেও শাখা-পল্লবে এটি বেশি অঞ্চল ব্যাপী ছড়ায়।

শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ থাকে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের রং উজ্জ্বল লাল। পত্র ঝরা বৃক্ষ, শীতে গাছের সব পাতা ঝরে যায়। বাংলাদেশে বসন্ত কালে এ ফুল ফোটে। ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়ি যুক্ত। পাপড়িগুলো প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মত লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্র বিশিষ্ট এবং উজ্জ্বল সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২০-৪০ টি উপপত্র বিশিষ্ট। কৃষ্ণচূড়ার জন্মানোর জন্য উষ্ণ বা প্রায়-উষ্ণ আবহাওয়ার দরকার। এই বৃক্ষ শুষ্ক ও লবণাক্ত অবস্থা সহ্য করতে পারে।

জানা যায়, অপরূপ সৌন্দর্য ছড়ানোর পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর পাতা, মূলের বাকল ও ফুল ভেষজ গুণাগুণ সম্পূর্ণ, যা জ্বর ও খুশকি নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ভেষজটি হেমিপ্লেজিয়া, আর্থরাইটিস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। কৃষ্ণচূড়া গাছের শিকড়, বাকল এবং ফুল সবই পরজীবী সংক্রমণ নিরাময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।

;

হলুদ আভায় মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সূর্যমুখী 



শহিদুল ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নওগাঁ
ছবি: প্রাণের উচ্ছ্বাসে সূর্যমুখী

ছবি: প্রাণের উচ্ছ্বাসে সূর্যমুখী

  • Font increase
  • Font Decrease

মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে সূর্যমুখী। বাস্তব জীবনের নিস্তব্ধতা ভাঙছে তার হলুদ আভায়। মৌমাছির আলিঙ্গন পেতে ছড়াচ্ছে উষ্ণ মুগ্ধতা। হলুদের কারুকার্যে বিমোহিত হচ্ছে পথিকের মন। লুকায়িত সৌন্দর্য প্রকৃতির মাঝে তুলে ধরে প্রবল আকর্ষণে টানছে দর্শনার্থীদের। সবুজ পাতা ভেদ করা সেই অনিন্দ্য হাসি যেন কৃষকের মুখেরই প্রতিচ্ছবি। সূর্যমুখী ফুল চাষে জনপ্রিয়তা বাড়ছে কৃষকদের মাঝে।

সূর্যমুখী এক ধরনের একবর্ষী ফুলগাছ। সূর্যমুখী গাছ লম্বায় ৩ মিটার (৯ দশমিক ৮ ফুট) হয়ে থাকে। ফুলের ব্যাস ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়। এই ফুল দেখতে কিছুটা সূর্যের মতো এবং সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে বলে এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। ফুলের বীজ হাঁস-মুরগির খাদ্যরূপে ও তেলের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

জানা যায়, বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের উৎস হিসেবে ১৯৭৫ সাল থেকে এ ফুলের চাষ শুরু হলেও কৃষকের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় নি বহুদিন। পরে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। বর্তমানে রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর জেলা, পাবনা, নওগাঁ, দিনাজপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলাতে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে।

সূর্যমুখীর বাঁধভাঙা হাসি আর প্রাণের উচ্ছ্বাস

সোমবার (১২ মে) সকালে সরেজমিনে নওগাঁ সদর উপজেলার মুক্তির মোড় কেন্দ্র শহীদ মিনারের পাশে দেখা যায়, সূর্যমুখী বাতাসে; দুলছে আলোর প্রতিফলনে পাপড়িগুলো যেন চকচকে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে। মৌমাছি এক ফুল থেকে অন্যফুলে মধু আহরণে ছুটাছুটি করছে আর এসব দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে পথচারীরা। এছাড়াও নওগাঁর বেশ কিছু অঞ্চলে চাষ হচ্ছে সূর্যমুখী। একদিকে যেমন ফুলগুলো সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে তেমনি বীজ থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে সূর্যমুখীর বীজ। সূর্যমুখী গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। 

প্রতিদিন ভোরে সূর্যমুখী বাগানের সকল গাছ অনেকটা পূর্বদিকে মুখ করে থাকে। যেদিকে সূর্য দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকে। সূর্যের সাথে সাথে সূর্যমুখীগুলোও ধীরে ধীরে নিজেদের দিক পাল্টাতে থাকে। সূর্য যেদিকে যায় তারাও সেদিকে যায়। সবসময়ই এগুলো সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। সূর্য যখন পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তারাও তখন পশ্চিম দিক বরাবর থাকে। অস্ত যাওয়ার পরে তারা রাতব্যাপী আবার উল্টো দিকে ঘুরে পূর্বমুখী হয়। এভাবে শুকিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের এই চক্র চলতেই থাকে।

সূর্যের সাথে সাথে নিজেদের দিকও পাল্টাতে থাকে সূর্যমুখী

তবে সবার মাঝে একটি প্রশ্ন অনেক সময় ঘুরপাক খায় যে সূর্যমুখী ফুল কেন সূর্যে দিক হয়ে থাকে! সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের একটি দল সূর্যমুখীর এই দিক পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের রহস্য উন্মোচন করেছেন। তাদের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে সূর্যমুখীরা তাদের নিজস্ব সার্কাডিয়ান চক্রে আবদ্ধ। এই চক্র সচল থাকার কারণে সূর্যমুখীরা সব সময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। গবেষকরা সায়েন্স জার্নালে তাদের গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন। সার্কাডিয়ান চক্র বা সার্কাডিয়ান ঘড়িকে অনেক সময় ‘দেহঘড়ি’ নামেও ডাকা হয়। মানুষের মাঝেও এই চক্র বিদ্যমান। যেমন প্রত্যেক মানুষেরই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম চলে আসে।

পথচারী রায়হান বলেন, ফুল শুভ্রতার প্রতীক ও পবিত্র। ফুলকে যারা ভালোবাসে তাদের মনটাও সুন্দর। সূর্যমুখী ফুল সব ফুলের চেয়ে আলাদা কারন সূর্যের দিক মুখ করে বেশিরভাগ থাকে এ ফুল। বিশেষ করে দুপুর শুরু হলে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে এ ফুল যা দেখতেও খুব সুন্দর লাগে তাছাড়া এ ফুলের বীজ থেকে তেল হয় যা অনেক স্বাস্থ্যকর।

ক্ষুদে শিক্ষার্থী আফরিন (১০) জানায়, আমি ফুল খুবই ভালোবাসি আর সূর্যমুখী ফুলগুলো হলুদ হবার কারনে আরো বেশি ভালো লাগে। নামটা যেমন সুন্দর তেমনি মুগ্ধতাও ছড়ায়। ফুলগুলো থেকে তেল হয় তাই কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। আমরা দূর থেকে দেখেই শান্তি পাই।

সূর্যের সাথেই একাত্মতা সূর্যমুখীর

স্থানীয় বাসিন্দা আরেফিন তুহিন বলেন, স্বল্প পরিসরে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যারা সূর্যমুখী ফুলের গাছ লাগিয়েছে তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ফুল মানেই সুন্দর সূর্যমুখীও এটিএ ব্যাতিক্রম নয়। মাঝে মাঝে যখন ফুলের দিকে চোখ যায় খুব ভালোলাগা কাজ করে। এ ফুল দেখতে যেমন সুন্দর এটির তেল ও খুব পুষ্টিকর।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে চলতি অর্থবছরে সূর্যমুখী চাষের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ হেক্টর ও অর্জন হয়েছে ৬৫ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন হয়েছে ১০০ মেট্রিক টন। 

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বার্তা২৪.কমকে বলেন- সূর্যমুখী একদিকে যেমন শুভ্রতার প্রতীক আবার অন্যদিকে বীজ থেকে তেল উৎপাদন হয় আবার মধুও পাওয়া যায়। বাজারে যে ভৈজ্যতেল গুলো রয়েছে যেমন, সয়াবিন,সরিষা, পাম-ওয়েল ইত্যাদি এগুলোর চেয়েও অনেক বেশি পুষ্টিগুণ আছে সূর্যমুখীর তেলে যা স্বাস্থ্যকর এবং স্বাস্থ্যর জন্য খুবই উপকারী। আমরা বেশি বেশি উৎপাদনে কৃষকদের সব রকম পরামর্শ দিয়ে থাকি।

;

ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা



সহিদুল আলম স্বপন, লেখক জেনেভা সুইজারল্যান্ড
ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা

ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা

  • Font increase
  • Font Decrease

তো ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকের কথা, তখন সুইস কোম্পনী ফাদসা এস এ তে চাকরী করি। হঠাৎ একদিন কোম্পানীর মালিক মশিউয়্যু মিশেল লাসের (বাংলায় জনাব মিশেল ল্যাসার) তার অফিসে ডেকে পাঠালেন।আমিতো ভয়ে দিশেহারা, ভাবলাম ফ্রেন্স ভাষা না জানার কারণে আমার মনে হয় এবার চাকরীটাই গেল। বলে রাখা ভালো, সুইজারল্যান্ডের চারটি সরকারী ভাষার(ফরাসী, সুইস জার্মান, ইতালীয়ান এবং রোমন্স - রোমান নয়)মাঝে জেনেভা ফরাসী ভাষাভাষী।নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা ভ্যানিশিং ক্রিমের পাবলিসিটি ছিল-ম্যানোলা সিবোঁ ভ্যানিশিং ক্রিম নিয়ে এলো ফরাসী সৌরভ। পরে জেনেছি সিবোঁ ফরাসী শব্দ যার অর্থ খুব ভালো (হয়তো বাংলায় বুঝাতে চেয়েছেন সুগন্ধময়)-আর এটাই শুধু আমার ফরাসী ভাষার ভান্ডার।

যাই হোক, ভয়ে ভয়ে তাঁর খাস কামরায় হাজির হলাম।দেখি কামরায় সোফার এককোনে প্যাট্রিক(আমার সুইস সহকর্মী আমার চেয়ে বছর দুয়েক এর ছোট হবে)আর লরেতা মার্টিনি এইচ আর হেড বসে আছে। বুঝতে আর দেরী হলোনা, এখনি বস বলবেন ইউ আর ফায়ার এবং প্যাট্রিককে তোমার সব কাজগুলো বুঝিয়ে দাও।

কোথায় ফায়ার তা না বলে মশিউয়্যু লাসের বললেন মাই ডিয়ার, আগামী সপ্তাহে প্যাট্রিক আর আলম (আমি) তোমরা দুজনে রটারডাম যাচ্ছো ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং এর জন্য। আলম তুমি কাল ভোরে বার্ণ(সুইজারল্যান্ডের রাজধানী)যাবে নেদারল্যান্ডের ভিসা করাতে। লরেতা তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে। বলে রাখা ভালো তখনো আমি সুইস নাগরিক হয়ে উঠিনি, আর মশিউয়্যু মিশেল লাসের ই আমাকে সুইজারল্যান্ডে স্হায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

রটারডাম উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর( আমস্টারডামের পরেই)।এটি ইউরোপের বৃহত্তম ও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর।নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণ হল্যান্ড প্রদেশে, উত্তর সাগরের তীরে, রাইন নদীর মোহনায় অবস্থিত এই বন্দর শহরকে প্রায়শই "ইউরোপের প্রবেশদ্বার" নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

তো যেই কথা সেই কাজ, সমস্ত আনুষ্ঠিকতা শেষে সপ্তাহান্তে কেএলএম রয়্যাল ডাচ এয়ারলাইন্সে চেপে জেনেভা থেকে আমস্টারডামের শিফল বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলাম। আমস্টারডাম শিফল বিমানবন্দর থেকে ট্রেনে রটারডাম সেন্ট্রাল ট্রেন ষ্টেশনে এসে নামলাম। সেখান থেকে টেক্সীকরে সরাসরি রটারডাম ম্যারিয়ট হোটেলে।রটারডাম স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট, ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি (আরএসএম) ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় বিসনেস স্কুলগুলির মধ্যে একটি, এখানেই আমাদের কোর্স। বাংলাদেশ আর নেদারল্যান্ডসের মাঝে চার পাঁচ ঘন্টার পার্থক্য। প্রতিদিন বাবা -মা সাথে কথা হয়। বাবা আমার জ্ঞানের পাগল। ৬০ বছর বয়সে উনি তাঁর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। কিন্তু বাবা মা দুজনের কেউ মানতে পারছিলেন না আমি বিদেশে থাকি। দেশে থাকতে মা এর আহাজারীতে বাবা বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশ মিলিাটারী একাডেমী থেকে আমায় ছাড়িয়ে এনেছিলেন। রাতে ঘুমাতে যাবার আগের মা কে ফোন করে ঘুমাই। বরাবরের মতে ১৮ ই ফেব্রুয়ারি রাতে মার সাথে কথা বলছি, মা আমার প্রাইমেরীর গন্ডি পেরুনো কিন্তু শিক্ষার প্রতি তাঁর পরম শ্রদ্ধা। গান-নাটক সংস্কৃতির পাগল আমি। মা আমার প্রতিদিন ই জিজ্ঞেস করেন কেমন চলছে গান-বাজনা। অনেক গুলো নূতন গানের ক্যাসেট কিনে রেখেছেন তিনি, সুইজারল্যান্ডে ফিরলেই ডাকযোগে পাঠিয়ে দিবেন, আমার প্রিয় কুমিল্লার খদ্দরের হাউয়াই শার্টসহ। আরো কত কথা, শেষ হয়েও হয়না শেষ। মায়ের প্রতিটি কথায় সেকি এক অনুপ্রেরণা। আজ বাংলাদেশে শেষ রোজা। পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার রোজার ঈদ।

পরদিন ক্লাস নেই, ভেবে রেখেছি সকালে ব্রেকফাস্ট না করে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে ফ্রেস হয়ে তারপর সারাদিন ঘুরে বেড়াবো, দেখবো বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী বন্দর, রটারডাম চিড়িয়াখানা, রিমাস্টারড" ডিজিটাল আর্ট অডিওভিজ্যুয়াল, ইউরোমাস্ট টাওয়ার, কিউব হাউস ইত্যাদি আর রাতে যাবে বাইয়্যাবীচ ক্লাবে নাচতে।

হোটেল রুমের সাইড টেবিলে রাখা ফোনটা সাত সকালেই আজ চিৎকার করে কান্না করে চলেছে, ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং……। ফোনটা যেন পাগল হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়েই মিনিট খানেক পর আঁধো বোজা চোখে ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বললাম, হোয়াট দ্যা হেল প্যাট্রিক, লেট মি গেট সাম স্লিপ । ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে ভেসে এলো ভাইয়া আমি ফরিদ(আমার ছোট বোন পান্নার বর), এক নি:শ্বাসে বলে চলছেন, ভাইয়া আমরা এই মাত্র কবরস্তান থেকে আসলাম, সব কিছুই ঠিক ছিল, দাফন- কাফন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে, কেঁদে আর কি করবেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, এইযে আব্বার সাথে কথা বলেন, আম্মাতো কাউকে কষ্ট দেননি, আল্লাহর কাছে আম্মার রুহের মাগফিরাত কামনা করে নামাজ পড়ুন যেন উনাকে আল্লাহ জান্নাতে স্হান করে দেন।চোখের জলে বালিশ ভিজেঁ যাচ্ছে আমি আজো প্রতিনিয়ত গেয়ে চলছি - " সবাই বলে, "ওই আকাশে লুকিয়ে আছে" "খুঁজে দেখ, পাবে দূর নক্ষত্রমাঝে"রাতের তারা, আমায় কি তুই বলতে পারিস কোথায় আছে, কেমন আছে মা? ভোরের তারা, রাতের তারা, মা-কে জানিয়ে দিস অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে পারি না।

;

১২ মে: আন্তর্জাতিক মা দিবস, মায়েদের ত্যাগের স্বীকৃতির দিন



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মা পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী শব্দ। এটি কেবল একটি ডাক নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারও আবেগ, সুখ-দুঃখ, ব্যথা, আনন্দ, আকাঙ্ক্ষা, অভিযোগ- না জানি আরো কত কত অনুভূতি!

হাদিসে বলা আছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সনাতন ধর্মের পুরাণে লিখিত রয়েছে- জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী অর্থাৎ মা এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এমনকী অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি অশেষ ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷

অশেষ কষ্ট সহ্য করে আমাদের লালন-পালন করেন জন্মদাত্রী মা। তাদের কষ্ট উপলব্ধি করতে উদযাপন করা হয়, আন্তর্জাতিক মা দিবস। এই বিশেষ দিনে মা এবং মাতৃসমতুল্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সারাবিশ্বের অনেক দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার উদযাপিত হয়, আন্তর্জাতিক মা দিবস। এই দিনটি ‘মাদারিং সানডে’ নামেও পরিচিত। এ বছর ১২ মে পড়েছে মা দিবস।

মা দিবসের আদি ইতিহাস
আন্তর্জাতিক মা দিবসের ইতিহাস বিষয়ে উইকিপিডিয়ায় লেখা হয়েছে, মা দিবস বা মাতৃ দিবস হলো একটি সম্মান প্রদর্শনের অনুষ্ঠান যা, মায়ের সম্মানে এবং মাতৃত্ব, মায়ের প্রতি ঋণ হিসেবে এবং সমাজে মায়েদের ভূমিকার জন্য উদযাপন করা হয়। বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বিভিন্ন দিনে, সাধারণত মার্চ, এপ্রিল বা মে মাসে উদ্‌যাপন করা হয়।

বিশ্বের সবখানে মায়ের এবং মাতৃত্বের অনুষ্ঠান উদযাপন করতে দেখা যায়। এগুলির অনেকই প্রাচীন উৎসবের সাক্ষ্য। যেমন- সিবেল গ্রিক ধর্মানুষ্ঠান, হিলারিয়ার রোমান উৎসব, যা গ্রিকের সিবেল থেকে আসে অথবা সিবেল এবং হিলারিয়া থেকে আসা খ্রিস্টান ‘মাদারিং সানডে’ অনুষ্ঠানের মতোই।

একটি গোষ্ঠীর মতে, এই দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রিসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে, যেখানে গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেল-এর উদ্দেশে পালন করা হতো। এশিয়া মাইনরে মহাবিষুবের সময়ে এবং তারপর রোমে আইডিস অব মার্চ (১৫ মার্চ) থেকে ১৮ মার্চের মধ্যে এই উৎসবটি উদযাপন করা হতো।

প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গিত আরো একটি ছুটির দিন ছিল। সেদিন মায়েদের উপহার দেওয়া হতো। মাদারিং সানডে-তে ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে অনেক দিন আগে থেকেই বহু আচারানুষ্ঠান ছিল, যেখানে মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট রোববারকে আলাদা করে রাখা হতো।

মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিস্টানদের অ্যাংগ্লিকানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকার অঙ্গ। ক্যাথলিক পঞ্জিকা অনুযায়ী, এটিকে বলা হয়, ‘লেতারে সানডে’ যা লেন্টের সময়ে চতুর্থ রোববার পালন করা হতো ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার ও প্রধান গির্জার সম্মানে।

প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পৃথিবীর সব মায়ের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি জানানোর দিন, গ্রাফিকস- সংগৃহীত

প্রথানুযায়ী, দিনটিতে প্রতীকী উপহার দেওয়া এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রান্না আর ধোয়ামোছার মতো মেয়েদের কাজগুলো বাড়ির অন্য কেউ করার মাধ্যমে উদযাপন করা হতো।

জুলিয়া ওয়ার্ড হোই রচিত ‘মাদার্স ডে প্রোক্লেমেশন’ বা ‘মা দিবসের ঘোষণাপত্র’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস উদযাপনের গোড়ার দিকের চেষ্টাগুলির মধ্যে অন্যতম।

আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ১৮৭০ সালে রচিত ‘হোই’-এর মা দিবসের ঘোষণাপত্রটি ছিল একটি শান্তিকামী উদ্যোগ। রাজনৈতিক স্তরে সমাজকে গঠন করার ক্ষেত্রে নারীর একটি দায়িত্ব ও ভূমিকা আছে, হোই-এর এই নারীবাদী বিশ্বাস ঘোষণাপত্রটির মধ্যে নিহিত ছিল।

ঘোষণা
১৯১২ সালে আনা জার্ভিস ‘মাদার'স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন (আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন।

জানা যায়, ভার্জিনিয়ায় অ্যান নামে একজন শান্তিবাদী সমাজকর্মী ছিলেন। অ্যান ছিলেন খুবই ধর্মপ্রাণ এবং নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। তিনি ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়েপড়া নারীদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালাতেন। নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য তিনি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতেন।
অ্যানের একটি মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল- আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস।

একদিন ছোট মেয়ের সামনেই অ্যান হাত জোড় করে বলেছিলেন, আমি প্রার্থনা করি, একদিন কেউ না কেউ, কোনো মায়েদের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুক। কারণ, মায়েরা রোজ মনুষ্যত্বের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। একটি দিন উৎসর্গ করা তাদের অধিকার।

মায়ের সেই প্রার্থনা হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায় আনার। অ্যানের মৃত্যুর দিনটিকে সারাবিশ্বের প্রতিটি মায়ের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন তিনি। তার পর থেকে মায়েদের প্রতি সম্মানে উদযাপিত হয়ে আসছে, আন্তর্জাতিক মা দিবস হিসেবে।

১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে প্রতিবছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার আন্তর্জাতিক মা দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে।

;