গত শতকের সবচেয়ে নৃশংসতম গণ-আত্মহত্যার কাহিনী



ওসমান জাফর, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
জিম জোনসের অনুসারীদের একাংশ

জিম জোনসের অনুসারীদের একাংশ

  • Font increase
  • Font Decrease

ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু বহুকাল ধরে কিছু ব্যক্তি ধর্মকে পুঁজি করে চালিয়েছে জঘন্য নৃশংস কর্মকাণ্ড। এমনকি গত শতকের গণআত্মহত্যা-খুনের ঘটনাটিও ঘটেছে জিম জোনস্ নামে এক ধর্মগুরুর প্ররোচনায় ও নির্দেশে, গায়ানায়।

স্বঘোষিত ধর্মগুরু জিম জোনস্

১৮ নভেম্বর, ১৯৭৮। গায়নার জঙ্গল বেষ্টিত এক প্রত্যন্ত এলাকা। নাম জোনস্ টাউন। আশেপাশে কোনো জনপদ নাই। একটা স্টেজের সামনে বসে আছেন কালো চশমা পরিহিত একজন ধর্মগুরু নাম জিম জোনস্। গায়ে কোর্ট টাই, প্যান্ট। একটা পাটাতনের ওপর সিরিয়াল ধরে আসছে ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা, তাদের চোখ মুখে আতঙ্ক। প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষরাও আসছে। তাদের চোখ-মুখে আতঙ্ক, বিষণ্নতার ছাপ। এদেরকে জোর করে স্টেজের মঞ্চের সামনের দিকে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। চারদিক ঘিরে রেখেছে ধর্মগুরুর একদল পোষা বাহিনী। তাদের হাতে রাইফেল, তাক করা। মঞ্চের সামনে দু-তিনটা বালতিতে ফ্লেভারমিশ্রিত বেভারেজের সাথে সায়ানাইড মিশ্রণ করা হচ্ছে। একটার পর একটা ইনজেকশনের প্যাকেট ছিঁড়ে সেগুলোতে ভরা হচ্ছে ফ্লেভারমিশ্রিত বেভারেজের সাথে সায়ানাইড। শিশুরা কাঁদো কাঁদো মুখে এগিয়ে যাচ্ছে আর তাদের শরীরে পুশ করা হচ্ছে সায়ানাইড। একজনের পর একজন কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।

গণ-আত্মহত্যায় ব্যবহৃত সায়ানাইড মিশ্রণ ও ইনজেকশন

নারী আর শিশুরাই বেশি। শিশুরা শেষ হওয়ার পর প্রাপ্তবয়স্ক নারী, পুরুষ, বুড়া-বুড়ি সকলের গায়ে ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছে। মাইকে উত্তেজিত অবস্থায় জোরে জোরে মটিভেশনাল স্পেরেচুয়াল আত্নহত্যামূলক বক্তৃতা দিচ্ছেন ধর্মগুরু জিম জোনস্। ওদিকে জোনস্ টাউন থেকে কয়েক কিলো দূরে একটা হেলিকাপ্টারের পাশে পড়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান লিও রায়ানের লাশ। তার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরো কয়েকজন সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, মানবাধিকার কর্মী, জোনস্ টাউন থেকে নিজের মেয়েকে নিয়ে যেতে আসা বাবার লাশ পড়ে আছে। তাদেরকে গুলি করেছে জিম জোনসের অনুসারী একদল পোষা বাহিনী। আস্তে আস্তে জোনস্ টাউন একটা বিশাল লাশের স্তূপে পরিণত হচ্ছে। অবশেষে ধর্মগুরু জিম জোনস্ সায়ানাইডের মরার দৃশ্য দেখে নিজেও আতঙ্কিত। যে ডাক্তার এতক্ষণ অন্যদের শরীরে ইনজেকশন পুশ করেছে সে এবার নিজের গায়ে পুশ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। অতঃপর জিম জোনস্ নিজের মাথায় গুলি করে আত্নহত্যা করেন। এদিকে গায়নার রাজধানী জর্জটাউনে পিপল’স টেপলের শাখায় জিম জোনসের অডিও টেপের মাধ্যমে প্রেরিত নির্দেশে সুইসাইড করেছে তার অনুসারীরা। মোট লাশের সংখ্যা দাঁড়াল ৯১৮ জন। ৭০ জন ধর্মগুরু জিম জোনসের নির্দেশে স্বেচ্ছায় আত্নহত্যা করেন।

মোট লাশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯১৮

পেছনের ইতিহাস
জিম জোনস্ ১৯৩১ সালের ১৩ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোর বয়সে কার্ল মাক্স, স্টেলিন, মাও, গান্ধী ও হিটলার সম্পর্কে গভীরভাবে পড়াশোনা করেন। তাদের দুর্বল ও সবল দিক সম্পর্কে অবগত হন। জিম জোনসের জন্ম হয়েছিল আমেরিকার ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একটি দরিদ্র পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বেশ বুদ্ধিমান এবং কিছুটা অদ্ভুত স্বভাবের। কিশোর বয়স থেকেই ধর্মের প্রতি তার টান ছিল প্রবল। সংস্কারবাদী খ্রিস্টান ধর্মীয় মতবাদগুলোর প্রতি ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। তরুণ বয়স থেকেই তিনি রাস্তায় রাস্তায় ধর্ম প্রচার শুরু করেন। বর্ণবাদ প্রথার বিরুদ্ধে তখন থেকেই তার ছিল বলিষ্ঠ আন্দোলন।

একসময় খ্রিস্টান ধর্মের সাথে কম্যুনিজম এবং সোশ্যালিজম জুড়ে দিয়ে তিনি এক নতুন ধরনের ধর্ম প্রচার শুরু করেন। জিম জোনসের স্বকীয় ধর্ম প্রচার কৌশল, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার কণ্ঠ, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি এবং সর্বোপরি তার তারুণ্যের উদ্যম খুব দ্রুতই তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। বেশ কিছু ভক্ত জুটে যায় তার। তিনি তার নতুন প্রচারিত মতবাদের নাম দেন পিপল’স টেম্পল।

পিপল’স টেম্পল-এর লোগো

১৯৬৫ সালে জিম জোন্স তার অনুসারীদের ইন্ডিয়ানা থেকে ক্যালিফোর্নিয়াতে গিয়ে বসবাস করার নির্দেশ দেন। সেসময় তার বয়স ছিল ৩৫ বছরের কাছাকাছি। তিনি ধীরে ধীরে সনাতন খ্রিস্টান বিশ্বাস থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন এবং নিজেকে একজন মসিহা বা নবী বলে দাবি করা শুরু করেন। তিনি নিজেকে গৌতম বুদ্ধ ও যিশু খ্রিস্টের মতো মহাপুরুষ হিসেবে জোর প্রচারণা চালাতে থাকেন। ইতোমধ্যে জোনস্ ও তার অনুসারীরা ক্যালিফোর্নিয়াতে পিপল’স টেম্পলের একটি চার্চ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। জিম জোনস্ তার অনুসারীদেরকে নিপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। অভাবগ্রস্ত মানুষদেরকে সাহায্য করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি। কিভাবে সমাজের বঞ্চিত গোষ্ঠীদেরকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা যায় এবং সমাজের সার্বিক উন্নয়নে তাদের কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে কাজ করা শুরু করেন এই টেম্পলের অনুসারীরা। অবশ্য আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে নিজের দর্শনের প্রতি আকর্ষিত করাও এসব জনহিতৈষী কর্মকাণ্ডের আরেকটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছিল।

পিপল’স টেম্পলের একটি চার্চ

ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকা সময়েই জোনস্ একবার দাবি করে বসেন, তিনি নাকি বিভিন্ন ধরনের মোজেজা দেখাতে পারেন। তার মধ্যে একটি ছিল ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে সারিয়ে তোলা। যদিও আদতেই তিনি কাউকে কখনো সারিয়ে তুলতে পেরেছিলেন কিনা, তার প্রমাণ মেলেনি। তবে তার ভক্তকূল এই প্রচারণাটি বেশ আনন্দের সাথেই গ্রহণ করেছিল।

১৯৭০ সালের দিকে এসে পিপল’স টেম্পল রাজনৈতিক দলগুলোর সহানুভূতি অর্জনে সক্ষম হয়। এসময় জোনসের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সখ্য গড়ে ওঠে। নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর পক্ষে সবসময় সোচ্চার থাকার কারণে জিম জোনস্ ও তার পিপল’স টেম্পল অ্যাঞ্জেলা ডেভিস এবং হার্ভি মিল্ক-এর মতো বামপন্থী নেতার এবং ব্ল্যাক প্যান্থারের মতো বিপ্লবী কৃষ্ণাঙ্গ গেরিলা সংগঠনের সুদৃষ্টি লাভ করে। ব্ল্যাক প্যান্থারের সুদৃষ্টি থাকায় বিপুল সংখ্যক আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক পিপল’স টেম্পলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।

গণ-আত্মহত্যার পরে উদ্ধারকৃত মৃতদের পাসপোর্ট

জীবনের বেশিরভাগ সময় আমেরিকায় কাটানো জিম জোনস্ কোনো এক কারণে আমেরিকার নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় শঙ্কিত থাকতেন। তার ধারণা ছিল, খুব শীঘ্রই আমেরিকার ওপর নিউক্লিয়ার হামলা হবে। কিন্তু কেন হবে বা কারা তা করবে, সে সম্পর্কে তিনি কখনোই সুস্পষ্ট করে কিছু বলেননি। বরং এই নিউক্লিয়ার হামলার ধারণা তিনি তার অনুসারীদের মধ্যে সজোরে প্রচার করতে থাকেন। নিজের মতাদর্শ এবং অনুসারীদের রক্ষা করার জন্য তিনি সবাইকে নিয়ে আমেরিকা ত্যাগ করার পরিকল্পনা করেন। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে সবার থাকার মতো ভূখণ্ডের খোঁজ চলতে থাকে।

অবশেষে গায়ানার এক গহীন জঙ্গলের পরিত্যক্ত বিশাল একটি এলাকা পছন্দ হয় জোনসের। ১৯৭৭ সালে তিনি ও তার অনুসারীরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দল বেঁধে রওনা হন গায়ানার উদ্দেশে। সেখানে তারা পিপল’স টেম্পলের নতুন চার্চ স্থপন করেন।

গায়ানার ওই জঙ্গলে এক নতুন শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন জোনস্। তবে সরকার এবং গণমাধ্যমবিহীন ওই সমাজের প্রধান সমস্যা ছিল বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ। অবশ্য সময়ের সাথে সাথে জোনসের অনুসারীরা সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। তারা আশেপাশের বনজঙ্গল কেটে সেগুলোকে কৃষি জমিতে রূপান্তরিত করেন। শুরু হয় কৃষিভিত্তিক এক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, যা পরবর্তীতে জোনস্ টাউন নামে খ্যাতি লাভ করে।

জোনস্ টাউনে পিপল’স টেম্বলের চার্চ

জোনস্ টাউনের সদস্যদের দিনের বেলায় বাধ্যতামূলক ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। সন্ধ্যার পর থাকত জিম জোনসের বক্তৃতা শোনার পর্ব। সপ্তাহের কিছু কিছু রাতে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হতো। অবশ্য চলচ্চিত্রের পরিবর্তে বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে ভীতিমূলক বিভিন্ন তথ্যচিত্রই বেশি প্রদর্শিত হতো। বাইরের সমাজের সাথে যোগাযোগ না থাকায় জোনস্ টাউনে খাদ্যের অভাব ছিল প্রবল। তার ওপর যে কোনো ভুল কাজের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা তো ছিলই।

জোনস্ টাউনে থাকা অস্থায় জোনসের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। তিনি ধীরে ধীরে বাস্তব জগত এবং কাল্পনিক জগতের মধ্যে পার্থক্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন। অবশ্য এসবের পেছনে উচ্চমাত্রার ড্রাগ গ্রহণ ছিল অন্যতম কারণ। একসময় তিনি তার অনুসারীদেরকে বাইরের শত্রুর আক্রমণের ভয় দেখাতে শুরু করেন।

জোনস্ টাউন গণহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা একজন বলেন, জিম জোনস্ বাহিরের পৃথিবী সম্পর্কে তাদের ভূয়া ও মিথ্যা তথ্য দিতেন। যেমন : নিগ্রোদের আমেরিকাতে ক্যাম্পে রেখে অত্যাচার করা হচ্ছে।

জোনস্ টাউনে আমেরিকানদের এই কাল্পনিক আক্রমণের একটি সমাধানও বের করে ফেলেন জোনস্। আর তা হলো গণ-আত্মহত্যা! অবশ্য জোনস্ এর নামকরণ করেছিলেন ‘বিপ্লবী মৃত্যু’। তিনি তার অনুসারীদের বলেন, যদি কখনো শত্রুপক্ষ জোনস্ টাউন আক্রমণ করে, তবে সবাই যেন এই বিপ্লবী মৃত্যু স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়।

ভীতিমূলক বিভিন্ন তথ্যচিত্রের রিল

১৯৭৮ সালের দিকে যখন বর্ণবাদ এবং দারিদ্র্যমুক্ত জোনস্ টাউনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন একজন আমেরিকান কংগ্রেসম্যান-লিও রায়ান, জোনস্ টাউন প্রকল্প পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৮ জন সদস্যের একটি পরিদর্শক দল নিয়ে গায়ানার উদ্দেশে রওনা হন এবং ১৭ নভেম্বর, ১৯৭৮ তারিখে জোনস্ টাউনে জিম জোনস্ এবং তার অনুসারীদের সাথে সাক্ষাত করেন।

জোনস্ টাউনের পরিস্থিতি কংগ্রেসম্যান রায়ানের কাছে বেশ স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল। জোনসের অনুসারীরা যে স্বেচ্ছায় নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করে গায়ানায় এসেছেন, তা-ও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে গায়ানা ত্যাগের আগে জোনসের কাছে নিজের সন্তুষ্টির কথা অকপটে প্রকাশ করেন তিনি।

কিন্তু এরপরও কংগ্রেসম্যানের এই সফর নিয়ে জোনসের উৎকণ্ঠা কাটল না। তার ভয় হচ্ছিল, যদি রায়ান আমেরিকায় গিয়ে জোনস্ টাউনের নামে কোনো বৈরি মন্তব্য করেন, তাহলে সরকার হয়তো তার গোটা জোনস্ টাউন প্রজেক্টই বন্ধ করে দিতে পারে।

কংগ্রেসম্যান-লিও রায়ান

তা যাতে না হয়, সেজন্য জোনস্ তার সিকিউরিটি ফোর্সকে পরিদর্শক দলের ওপর হামলা করার জন্য পাঠান। পরিদর্শক দল যখন গায়ানার বিমানবন্দরে পৌঁছে, তখন তাদের ওপর হামলে পড়ে জোনসের বাহিনী। তাদের হামলায় চারজন পরিদর্শক নিহত হন। নিহতদের মধ্যে কংগ্রেসম্যান লিও রায়ানও ছিলেন। তিনি মোট ২০টি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।

আমেরিকান কংগ্রেসম্যান নিহত হয়েছেন। এখন তো জোনস্ ও তার পিপল’স টেম্পলের বাঁচার কোনো রাস্তা নেই। আমেরিকান সরকার অবশ্যই তাদেরকে গ্রেফতারের জন্য সেনাবাহিনী পাঠাবে। তাই এই গ্রেফতার এবং গ্রেফতার-পরবর্তী নির্যাতন এড়াতে জোনস্ তার অনুসারীদেরকে গণ-আত্মহত্যার নির্দেশ দেন।

তবে একজন নারী অনুসারী এর আংশিক বিরোধিতা করে বলেন, “মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। মরতে আমি রাজি আছি। কিন্তু আমাদের বাচ্চাদেরকে বাঁচার সুযোগ দেওয়া হোক।” উত্তরে জোনস্ বলেন, “বাচ্চাদের শান্তি প্রয়োজন। আমেরিকান বাহিনী আমাদের সাথে যা করতে যাচ্ছে, তা দেখার চেয়ে তাদের মৃত্যুবরণ করাটাই শ্রেয়।”

বিমানবন্দরে জোনসের অনুসারীদের হামলার পর

জোনসের নির্দেশে সায়ানাইড মিশ্রিত একধরনের পানীয়ভর্তি ড্রাম নিয়ে আসা হয় চার্চ প্রাঙ্গণে। একে একে সবাই সেই পানীয় পান করে এবং ইনজেকশনে শরীরে প্রবেশ করিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। শিশুরাও বাদ যায়নি। তাদের শরীরেও ইনজেকট্ করা হয় সায়ানাইড। এসময় জোনস্ সবাইকে দ্রুত এই আত্মহত্যা কার্যক্রম শেষ করার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছিলেন।

অবশ্য জোনস্ নিজে সায়ানাইডের মাধ্যমে আত্মহত্যা করেননি। সায়ানাইড গ্রহণের পর তার অনুসারীদের যে প্রচণ্ড যন্ত্রণার মাধ্যমে মৃত্যু হচ্ছিল, তা দেখে তিনি ওই রাস্তা বাদ দেন। তার বদলে তিনি মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

পরবর্তীতে গায়ানার সেনাবাহিনী যখন কংগ্রেসম্যানের হত্যাকারীদের ধরতে জোনস্ টাউনে যান, তারা ভেবেছিলেন হয়তো জিম জোনসের অনুসারীরা তাদের ওপর আক্রমণ করে বসবে। কিন্তু কিসের কী! জোনস্ টাউনে পৌঁছার পর তাদের সবার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে যাবার অবস্থা হয়। যত দূর চোখ যায়, শুধু লাশ আর লাশ। একজন আরেকজনের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। যুবক, বৃদ্ধ, নারী, শিশু—কেউ বাদ যায়নি।

যত দূর চোখ যায়, শুধু লাশ আর লাশ

সেদিনের সেই লাশের মিছিলের মধ্যে শিশু ছিল ৩০০ জন, যাদেরকে তাদের পিতামাতা হত্যা করেছিল। বৃদ্ধ নাগরিকের সংখ্যাও ছিল ৩০০ জনের মতো। জোনস্ টাউনের নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় তাদের শরীরে সায়ানাইড প্রবেশ করানো হয়। বাকিরা স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছিল মৃত্যুকে।

জোনস্ টাউনের ঘটনাকে গণহত্যা বা গণ-আত্মহত্যা যাই বলা হোক না কেন তা আমেরিকার ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায় এটি। ওইদিন যারা মৃত্যুবরণ করেছিল, এমন নয় যে তারা সবাই নিরক্ষর বা চলমান নাগরিক জীবনযাত্রা সম্পর্কে অজ্ঞ। বরং জিম জোনসের অনেক অনুসারীই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাহলে কেনইবা এত বিপুল সংখ্যক মানুষ শুধুমাত্র একজনের কথায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়ে নিজেকে ধ্বংস করে দিলেন, তা আজও রহস্যময়।

জুবায়ের সিদ্দিকী ছিলেন সিলেটে শিক্ষাবিপ্লবের সমর নায়ক



সাঈদ চৌধুরী
জুবায়ের সিদ্দিকী

জুবায়ের সিদ্দিকী

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী (অব.) ছিলেন সিলেটে এক নীরব শিক্ষা বিপ্লবের মহানায়ক। শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব। অন্তঃকরণে এই একটাই ভাবনা ছিল। স্কলার্স হোম ছিল তার স্বপ্নপূরণের গন্তব্য। তার অন্তঃকরণ কল্পনাতীত ভাবেই উদার ও সুপ্রশস্ত ছিল।

জুবায়ের সিদ্দিকী মূলত একজন অকুতোভয় সৈনিক, সফল শিক্ষাবিদ ও খ্যাতিমান লেখক। নিয়মানুবর্তী এই মানুষটার সাথে পরিচয়ের পর থেকেই হৃদয়ের কোণে জমে আছে অফুরান ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা। তার নতুন দুটি মাইলফলক অর্জন, একজন সমর নায়ক থেকে শিক্ষক ও লেখক হিসেবে সফল উত্তরণ আমাদের চোখের সামনেই। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তাকে কাছে থেকে দেখেছি। তাই দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে পারি, এই বহুমুখী শিল্প সাধকের অনেকগুলো উত্তম গুণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিরল। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী, নির্লোভ ও নিরহংকার জীবনের অধিকারী।

হঠাৎ এই আলোর প্রদীপ নিভে যাবে তা ভাবতে পারিনি। ইন্তেকালের কিছুদিন আগে তার শিক্ষা বিপ্লব নিয়ে কথা হয়েছিল। এক্ষেত্রে তিনি আমাকে প্রেরণা সঞ্চারকারী ভাবতেন। সিলেটে ইংরেজি মাধ্যমে খাজাঞ্চীবাড়ি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের যাত্রা আগে শুরু হলেও আমাদের বৃটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলকে (বিবিআইএস) তিনি নতুন মাত্রা হিসেবে বিবেচনা করতেন। ফলে তার শিক্ষা কার্যক্রম ও ক্যাম্পাস বৃদ্ধির সর্বশেষ অগ্রগতি শেয়ার করতেন। এ নিয়ে কিছু লেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু লেখার আগেই তিনি চলে গেলেন তার শেষ ঠিকানায়, মহান মাবুদের কাছে।

২০২০ সালের ৯ মার্চ বাহাত্তর বছরে পা রাখেন প্রবীণ এই কৃতি ব্যক্তিত্ব। বয়সের কারণে তাকে প্রবীণ বললেও এক উজ্জল তারুণ্য তার মাঝে ছিল বিদ্যমান। সৈনিক জীবন থেকে অবসরে এলেও কর্মজীবনে কোন বিরতি গ্রহণ করেননি। তার সর্বশেষ সাধনার ক্ষেত্র ছিল হাফিজ মজুমদার ট্রাস্টের শিক্ষা প্রকল্প ‘স্কলার্স হোম’।

১৯৯৭ সালে আমরা বৃটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (বিবিআইএস) প্রতিষ্ঠার পর সিলেট অঞ্চলে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার যে প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়, এরই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কলার্স হোম স্কুল অ্যান্ড কলেজ। বর্তমানে এর ছয়টি শাখা রয়েছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। সেখানে হাজার হাজার কোমলমতি শিশু-কিশোরদের জীবন গড়ার প্রধান কারিগর এই জুবায়ের সিদ্দিকী। সিলেটে এক নিরব শিক্ষা বিপ্লবের তিনি ছিলেন সমর নায়ক।

কথায় আছে, রতনে রতন চেনে। মানব কল্যাণে জীবন উৎসর্গকারী হাফিজ মজুমদার ঠিকই চিনতে পেরেছেন সিলেটের দুই রত্নকে। একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী (অব.) আর অন্যজন হলেন বৃটেনে সাড়া জাগানো মেইনস্ট্রিম পলিটিশিয়ান ও শিক্ষাবিদ ড. কবীর চৌধুরী। এই কৃতি ব্যক্তিত্বরা সিলেট অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে রেখেছেন অপরিমেয় অবদান। এ এক বিরাট জাগরণ।

স্কলার্স হোম যেন খুলে দিয়েছে রূপকথার দরজা৷ জুবায়ের সিদ্দিকী বুঝতে পেরেছিলেন, আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে কত পিস মিগ বিমান এল তার চেয়ে কতটা ছেলে-মেয়ে প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হল তা অনেক বেশি গুরুত্বপর্ণ। উন্নত বিশ্বের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন তিনি। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছি, সেখানে আধুনিক শিক্ষার উপরে যে থিসিস হয়েছে তা জানতে গিয়ে তার আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি মনে করতেন, সিলেটে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কী হবে, যদি সেখানে স্থানীয় শিক্ষার্থী ভর্তি হতে না পারে! স্কলার্স হোমকে তিনি সে ঘাটতি পূরণের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করতে পেরেছেন। আরও বিশাল মহীরূহে পরিণত করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন।

জুবায়ের সিদ্দিকী সৈনিক জীবন থেকে সিভিলিয়ান জীবনে ফিরে এলেও সময় নষ্ট করার মত সাধারণ্যে তিনি ফিরে আসেননি। এজন্য পরিচিত মহলেও তার কিছুটা দূরত্ব ছিল। এটা তিনি সহজভাবে স্বীকার করতেন। সংকীর্ণতা, হীনমন্যতা ও দলাদলির এই দেশে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে জুবায়ের সিদ্দিকী সামাজিক ও রাজনৈতিক বেড়াজাল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তিনি কখনও কোনো দল বা মতের পক্ষে কথা বলেননি।

সৈনিক জীবনে অনেক দক্ষ ও সাহসী ভূমিকার ফলে পর্যায়ক্রমে জুবায়ের সিদ্দিকী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কুয়েতের স্বাধীনতা রক্ষায় তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। ১৯৯০ সালে ইরাক অতর্কিতে কুয়েত দখল করলে আমেরিকা সেখানে যৌথবাহিনী পাঠায়। বাংলাদেশ থেকেও আড়াই হাজার সৈন্য অংশ নেয়। বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন জুবায়ের সিদ্দিকী।

কর্মজীবনে বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। জুবায়ের সিদ্দিকী ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালে ৩২ বছরের সেনাবাহিনী জীবনের ইতি টানেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী (অব.)’র আত্মজীবনিমুলক বই ‘আমার জীবন আমার যুদ্ধ’ পড়লে মুগ্ধ হতে হয়। এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রখ্যাত কবি, সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত মোফাজ্জল করিম বলেছিলেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকীরা সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীন করেছেন। জীবন যুদ্ধে জয়লাভ করেই মহাপুরুষে পরিণত হয়েছেন। দেশকে সুন্দর করতে সমৃদ্ধ করতে সোনালী ভবিষ্যতের জন্যে প্রয়োজন তারমত দেশপ্রেমিক নিষ্কলুষ মানুষের।

সিলেটে এক সময় আমার সহযোদ্ধা দাপুটে সাংবাদিক ও বাম রাজনীতিক শামীম সিদ্দিকীর বড় ভাই আমাদের প্রিয় জুবায়ের সিদ্দিকী ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বুধবার ভোরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। ২৪ মার্চ তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে তাকে সিলেটের হার্ট ফাউন্ডেশনে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওই দিন বিকেলে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি মারা যান।

জুবায়ের সিদ্দিকী স্মরণে দেশে ও প্রবাসে অনেক অনুষ্ঠান হয়। গত বুধবার (২২ মার্চ) সকালে স্কলার্সহোম শাহী ঈদগাহ ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মুনীর আহমেদ কাদেরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জুবায়ের সিদ্দিকী বৃত্তি প্রদান ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ইয়াসমিন সিদ্দিকী, সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী, ট্রাস্টের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ছয়ফুল করিম চৌধুরী হায়াত।

ফারজানা মুর্শেদের সঞ্চালনায় এসময় আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন হাফিজ মজুমদার ট্রাস্টের যুগ্ম সচিব খায়রল আলম, মদনীবাগ ক্যাম্পাসের অধ্যক্ষ আক্তারী বেগম,পাঠানটুলা (প্রাথমিক) ক্যাম্পাসের ইনচার্জ জেবুন্নেছা জীবন, মেজরটিলা ক্যাম্পাসের নাহিদা খান, মোস্তাফিজুর রহমান ও শরিফ উদ্দিন। কবিতা আবৃত্তি করেন গণিত বিভাগের প্রভাষক বাপ্পি কুমার মজুমদার, দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাওদুরা রহমান আরিশা। জুবায়ের সিদ্দিকীর মহৎকর্ম নিয়ে ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করেন আইসিটি বিভাগের প্রভাষক জাহিদুল ইসলাম।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী (অব.) ট্রাস্টের পক্ষ থেকে এবছর বিভিন্ন শ্রেণির ১৫ জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে বক্তারা এই মহতি মানুষের অবদান স্মরণ করে নতুন প্রজন্মকে সেভাবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমীন।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী। সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

;

১৩টি ‘মহাবিপন্ন’ বাংলা শকুনের মৃত্যু



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বাংলা শকুন। ছবি: বন বিভাগ

বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বাংলা শকুন। ছবি: বন বিভাগ

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি প্রাণ হারিয়েছে ১৩টি মহাবিপন্ন বাংলা শকুন (White-ramped Vulture)। তবে এদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। বিষক্রিয়াজনিত কারণে এদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্ট প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ দাবি করেছে।

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) সকালে সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের কালারবাজারের কাছে বড়কাপন গ্রামের বুড়িকোনা বিল থেকে বনবিভাগের কর্মকর্তারা ১০টি মৃত শকুন উদ্ধার করেন। পরে সেদিন দুপুরে সেখান থেকে আরও ৩টি মৃত শকুন উদ্ধার করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর সর্বশেষ ২০১৪ সালে জরিপ অনুযায়ী, দেশে ২৬০টি শকুন ছিল। এর মধ্যে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে ছিল ৮০টি। এই ১৩টি শকুনের মৃত্যুর পর সংখ্যাটি আরও কমে গেল।

মৌলভীবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুস ছামাদ বলেন, ‘মৃত ১০টি শকুন আইইউসিএন কর্মকর্তারা বস্তায় করে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। এগুলো ১০-১২ দিন আগে মরেছে বলে ধারণা করছি। সব পচে-গলে গেছে। শকুনগুলোর মৃত্যুর কারণ জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সিলেট ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছি। ধারণা করছি, মৃত গরু, ছাগল, কুকুর বা শিয়ালের মাংশ খেয়ে শকুনগুলো মারা যেতে পারে। অনেক সময় গরুর চিকিৎসায় নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় এবং কুকুর-শিয়াল নিধনে গ্রামগঞ্জে বিষ জাতীয় পদার্থ ব্যবহৃত হয়। এই প্রাণীগুলোর কোনোটি মারা যাওয়ার পর তার মাংস শকুন ভক্ষণ করলে তারাও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে।’

ঘটনাস্থলে বনবিভাগের কর্মকর্তাগণ। ছবি: বন বিভাগ

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শ্যামল কুমার মিত্র বলেন, ‘মহাবিপন্ন বাংলা শকুন এক সঙ্গে এতগুলো মারা যাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে ব্যাপক খোঁজাখুজির পর আরো তিনটি শকুন মৃত অবস্থায় পেয়ে উদ্ধার করেছি। এর আগে ১০টি মৃত শকুন আইইউসিএনের কর্মীরা সিলেটে নিয়ে গেছেন। অর্থাৎ মোট ১৩টি শকুন বা তার বেশি মারা গেছে।

তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, বিষক্রিয়ায় শকুনগুলো মারা গেছে। এই শকুনগুলোর মৃত্যুর ব্যাপারে স্থানীয় কেউই তথ্য দিয়ে আমাদের সহায়তা করেনি। তবে এই শিশু আমাদের জানিয়েছে এই এলাকায় শিয়াল একাধিক ছাগল খেলে ফেলায় মৃতছাগলের পরিত্যক্ত মংশে বিষ মিশিয়ে দেয়া হয় শিয়ালদের মারার জন্য। সেই বিষ থেকে শকুনগুলো মারা যেতে পারে বলেও আমাদের ধারণা। তবে সিলেট ল্যাব থেকে রিপোর্ট পেলে শকুনগুলোর মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে মৌলভীবাজার মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

পাখি গবেষকেরা বলছেন, পশু চিকিৎসায় বিশেষ করে গরুর চিকিৎসায় ব্যবহার হওয়া দুটি ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের বহুল ব্যবহারের ফলেই মূলত শকুন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে। এই দুইটি ওষুধ খাওয়া প্রাণীর মাংস খাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে কিডনি বিকল হয়ে মারা যায় শকুন।

পাখি বিশেষজ্ঞ, পাখিপ্রেমী এবং পরিবেশকর্মীদের জোর দাবীর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সরকার ২০১০ সালে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক এবং ২০১৭ সালে দেশের দুইটি এলাকায় কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।

;

পাখি ও বন্যপ্রাণীদের দুঃসময়



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

জলবায়ু পরিবর্তনে পাখিদের সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। কমেছে পাখির আবাসস্থল। ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী।

বৈশ্বিক পাখি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার প্রজাতি হুমকির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ২৮ ভাগ। বিগত দুশো বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। এভাবে চলতে থাকলে আগামী একশ বছরের মধ্যে এই বন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সুন্দরবনের খয়রাপাখা মাছরাঙা পাখি। ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতি বিশেজ্ঞরা বলছে, বনের ওপর মানুষের অধিক নির্ভরশীলতার কারণে ক্রমান্বয়ে এর আয়তন অতি দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে। বনের আয়তনের সাথে সাথে হ্রাস পাচ্ছে এর জীববৈচিত্র। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ, ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী প্রাণী হুমকির মুখে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সুন্দরবনে একাধিক অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হলেও কাজে আসছে না তার সুফল।

পাখি বিশেজ্ঞরা বলছেন, এক দিকে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে পাখি সংখ্যা কমলেও ভারত অংশে সুন্দরবনে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের পাখি-বৈচিত্র্যের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’। ‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামের সেই বইটিতে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রতিটি পাখি প্রজাতির ছবি-সহ বিশদ বর্ণনা নথিভুক্ত হয়েছে।

‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামক বই।

বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪২০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে সুন্দরবনে পরিযায়ী ও স্থানীয় পাখি মিলিয়ে রয়েছে ৪২৮টি প্রজাতি। দেশে প্রাপ্ত ১২টি প্রজাতির মাছরাঙার ৯টিরই দেখা মেলে এই অঞ্চলে। সেইসঙ্গে গোলিয়াথ হেরোন, স্পুনবিল স্যান্টপিপার, হুইমবেল, লার্জ ইগ্রেট, টেরেক স্যান্ডপিপার, প্যাসিফিক গোল্ডেন প্রোভারের মতো বিরল প্রজাতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই অঞ্চলে।

যা ইতিবাচক দিক হিসেবেই মনে করছেন ভারতের প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। ভারতে বর্তমানে ১৩০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। যার প্রায় এক তৃতীয়াংশই বাসিন্দা সুন্দরবনের। বৈচিত্র্যের নিরিখে গোটা ভারতের মধ্যে যা রয়েছে শীর্ষস্থানে। আবাসস্থল ও অবাধে চলাচলের জন্যে বাংলাদেশ অংশের পাখিরা ভারত অংশের সুন্দরবনে নিজেদের নিরাপদ মনে করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

অন্যদিকে, কমতে থাকায় বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০। এর মধ্যে পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৭২১। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর অবস্থা কী - তা দেখার জন্য ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন এর ‘লাল তালিকা’ দেখা যেতে পারে। সেখানে রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রায় ১২৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী হুমকি বা বিলুপ্তির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ১৪ ভাগ। গত ১০০ বছরে প্রায় ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে, যা এ দেশের মোট বন্যপ্রাণীর প্রায় ২ ভাগ।

;

হাকালুকিতে কম এসেছে পরিযায়ী পাখি



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
হাকালুকিতে পাতি-সরালির ঝাঁকও কমে গেছে। ছবি: এবি সিদ্দিক

হাকালুকিতে পাতি-সরালির ঝাঁকও কমে গেছে। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

হাকালুকিতে পাখি শিকারিদের কারণে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে। যার কারণে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য অনেকটাই হুমকির মুখে।

হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, নদী দূষণ, জাল বিষ টোপ ও পটাশ দিয়ে পাখি শিকার। একসঙ্গে বেশ কয়েকটি বিলে মাছ আহরণ, বিল শুকিয়ে মাছ নিধন, বিলে ২৪ ঘণ্টা পাহারা ও জলজ বৃক্ষ নিধনসহ রয়েছে নানান সমস্যা।

চলতি বছরের শীত মৌসুমের পাখিশুমারিতে সে তথ্যই জানান দিয়েছে। জানুয়ারি মাসের ২৮ ও ২৯ তারিখ দু’দিন ব্যাপী হাকালুকি হাওরে করা হয় পাখি শুমারি করে বন বিভাগ, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) যৌথ উদ্যোগে এ শুমারি করে।

বাংলাদেশে ৭১৮ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩৮৮ প্রজাতির পাখিই পরিযায়ী। এরা শীতকালে পরিযায়ী হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসে বাংলাদেশে। আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় হাকালুকি হাওরের মতো জলাশয়। প্রায় ১৮১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ হাওরে রয়েছে ছোট-বড় ২৭৬টি বিল। পাখিশুমারিতে তাদের জরিপে হাকালুকিতে এ বছর এসেছে প্রায় ২৫ হাজার পাখি। যা বিগত বছর থেকে অনেক কম। যা ২০২০ সালে ছিলো প্রায় ৪০ হাজার ১২৬ পাখি। মাত্র কয়েক বছর আগে দেশে ৫-৬ লাখ পরিযায়ী পাখি আসতো। এসব পাখির বেশিরভাগ মৌলভীবাজার ও সিলেটের হাওরে অবস্থান করতো।

যুগল বেগুনি কালেমের সৌন্দর্য। ছবি: এবি সিদ্দিক

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এর পর্যবেক্ষণ বলছে, গত ২০ বছরে সারা বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে ৩৫ শতাংশ। হাকালুকিতে কমেছে ৪৫ শতাংশ। ২০০০ সালের আগে হাওরে বিচরণ করতো প্রায় ৭৫-৮০ হাজার পাখি। তার ৮০ শতাংশই হাকালুকি হাওরে ছিলো।

পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাকালুকি হাওরে যে নদীগুলো মিলিত হয়েছে এখন সেই নদীগুলো প্লাস্টিক, পলিথিন, দূষিত পানি ও ময়লার ভাগাড়। পাখি কমার বিশেষ কয়েকটি কারণের মধ্যে এটি একটি। অরক্ষিত থাকায় দিন দিন কমেছে পাখির সংখ্যা। হাওরের পরিযায়ী পাখি রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, পাশাপাশি প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা থাকতে হবে। এতেই বাঁচবে পাখি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেট এর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, প্রতি বছর হাওরে বিল ইজারা দেওয়া হয়। এ বছরও হয়েছে। এতে বেশ লোকসমাগম ঘটে। দিনরাত পাহারা দেওয়া হয়। এসব কারণে পরিযায়ী পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে না। বিল শুকিয়ে মাছ আহরণের কারণে নষ্ট হচ্ছে হাওরের জীববৈচিত্র্য। ফলে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমছে।

;