একজন আলতাফ মাহমুদ অথবা আত্মপরিচয়ের সুরস্রষ্টা

  • আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

তাঁর সৃষ্ট সুরগুলো বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করে যাবে চিরকাল

তাঁর সৃষ্ট সুরগুলো বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করে যাবে চিরকাল

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
                            আমি কি ভুলিতে পারি?”
বাঙালি জীবনের সাথে মিশে আছে গানটার সুর। যেন জাতীয় পরিচয়ের সঞ্জিবনী শক্তি। যে সুর বাঙালিকে উদ্ধুব্ধ করেছে মুক্তির সংগ্রামে। অনুপ্রাণিত করবে ভবিষ্যতেও। আর সেই সুরের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ; দেশ ও জাতির জন্য আত্মোৎসর্গকারী সুরস্রষ্টা—আলতাফ মাহমুদ। বাঙালি জাতির প্রেক্ষিতে তাঁকে বরং যীশু হিসাবেই আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।

২৩ ডিসেম্বর, ১৯৩৩ সাল। বরিশাল জেলার মুলাদি থানার পাতারচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করলো ‘ঝিলু’ নামের ছেলেটি। পিতা নাজেম আলী হাওলাদার ছিলেন আদালতের পেশকার এবং মাতা কদবানু গৃহিণী। তখন কে জানত পাড়া মাতিয়ে রাখা চঞ্চল স্বভাবের ঝিলুই একদিন সমগ্র বাংলাদেশের সুর ধরতে পারবে? পরিণত হবে অন্যতম প্রধান সংগীতস্রষ্টার আসীনে?

বিজ্ঞাপন

ছেলেবেলা থেকেই স্থানীয় সাংস্কৃতিক আবহে অংশগ্রহণ ছিল। পাঠ্যপুস্তকে মন দেবার বদলে হাত পাকালেন বেহালা আর বাঁশিতে। পিতা চেয়েছিলেন ছেলেটা মেট্রিকুলেশন পাশ করুক; কিন্তু সে আশা পূরণ হলো না। ফলাফল প্রকাশের দিন বিকালে পিতা যখন রাগে ফেটে যাচ্ছেন; ভীত পুত্র তখন বাড়ি থেকে বহু দূরে। বরিশাল সদর বেল পার্কের কাছে কীর্তনখোলার তীরে দরাজ গলায় গানে মগ্ন। সায়গলের সেই বিখ্যাত গজল—
“দুনিয়া মে হু দুনিয়াকি তলবগার নেহি হু 
বাজার সে গুজরা হুয়া থরিদ্দার নেহি হু।”

নতুন জীবন
বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএসসিতে ভর্তি হলেও শেষ করতে পারেননি। ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে চলে আসেন ঢাকায়। সেখান থেকে শুরু নতুন পথের। ভর্তি হন ঢাকা আর্ট কলেজে। যোগ দেন ঢাকাকেন্দ্রিক জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ধূমকেতু শিল্পী সংঘ’-তে। সংগঠন ও আলতাফ মাহমুদ উভয়েই উপকৃত হলেন তাতে। প্রগতিশীল চিন্তাধারায় শিক্ষিত সাহসী তরুণেরা সবাই মিলে গণজীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মঞ্চস্থ করতে লাগলেন। আস্তে আস্তে গণসংগীতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। গানের মাধ্যমে উঠে আসতে লাগল স্বাধিকার আন্দোলন, অন্যায়ের প্রতিবাদ, অধিকার এবং অপ্রাপ্তির কথা। অসংখ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শাণিত করা হয়েছে মানুষের চেতনাকে। এরকম কিছু গাণের উদাহরণ হতে পারে—‘হুনছনি ভাই দেখছনি’, ‘স্বর্গে যাব গো স্বর্গে যাব’, ‘মোরা উজিরে নজিরে বাঁচায়ে রাখিতে চির উপবাসী হব’, ‘মরি হায়রে হায় দুঃখ বলি কারে’, ‘ম্যায় ভুখা হু’ প্রভৃতি।

বিজ্ঞাপন

সংগীতের প্রেম আর দেশপ্রেম যে মিশে গেছে একবিন্দুতে
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আলতাফ মাহমুদ আপোসহীন নির্ভীক সক্রিয় কর্মীর ভূমিকা পালন করেন। বাঙালি জাতীয় অভিযাত্রায় দ্বিতীয় স্ফুরণ এই ভাষা আন্দোলন। সংগীতের প্রতি ভালোবাসা, দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে মাত্র ২০ বছর বয়সে আলতাফ মাহমুদ সৃষ্টি করে ফেললেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলির সুর—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’। একুশে ফেব্রুয়ারির সার্বজনীনতার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম প্রতীক শহীদ মিনার হলে দ্বিতীয় প্রতীক এই গানটি।

অরক্ষিত দিনগুলো
বায়ান্নের পরবর্তী বছরগুলোতে গণসংগীতের যে বজ্রনিশান বেজে ওঠে; তার পেছনে অন্যতম নায়কের ভূমিকা আলতাফ মাহমুদের। ১৯৫৬ সালের পর তিনি করাচি সফর করেন। পরিচয় ঘটে বিখ্যাত সংগীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সাথে। খুব শীঘ্রই করাচিতে বাঙালিদের মাঝে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে। সে সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জাগো হুয়া সাভেরা’-তে কণ্ঠ দিয়ে খ্যাতি আসে বোদ্ধামহলেও। ১৯৫৯ সালে ঢাকায় ফিরে এসে ‘তানহা’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসাবে চুক্তিবদ্ধ হন। এরপরে আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের নির্মিত সিনেমা ‘বেহুলা’-তেও কাজ করেছেন তিনি। স্থায়ী হয়েছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসাবে। তার সংগীত পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য কিছু সিনেমা হলো—‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘অবুঝ মন’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘কার বউ’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘নয়নতারা’, ‘দুই ভাই’, ‘সংসার’, ‘আপন দুলাল’, ‘প্রতিশোধ’ প্রভৃতি।

করাচি থেকে ফিরে ঢাকার চলচ্চিত্রে স্থির হলেন সংগীত পরিচালক হিসাবে

আলতাফ মাহমুদের আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি—‘হাজার তারের বীণা’। ১৯৬৭ সালের দিকে প্রকাশিত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে কালজয়ী গীতি আলেখ্য এটি। মূল চরিত্রে ছিলেন শাহনাজ বেগম এবং মাহমুদুন্নবী চৌধুরী। গীতি আলেখ্যটি এখনো মাঝে মাঝে মঞ্চস্থ হয়। ওই সময় প্রকাশিত হয়েছিল EMI Pakistan থেকে। রচয়িতা এনামুল হক এবং সুরকার আলতাফ মাহমুদ। ১৯৬৭ সালে মহান অক্টোবর বিপ্লবের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে পল্টন ময়দানে দুইদিন ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়; যার পরিচালক ছিলেন তিনি। ছায়ানটের সার্থক নজরুলজয়ন্তীয়ও পরিচালিত হয়েছে তার পরিচালনায়।

স্বাধীনতার সুর
এরই মধ্যে স্বাধীনতার ডাক এসে পড়ল। আলতাফ মাহমুদ হাতে অস্ত্র আর গলায় গান নিয়ে নেমে গেলেন যুদ্ধে। তার বাড়ি পরিণত হয়েছিল একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম দুর্গ হিসাবে। ঢাকার বিভিন্ন গেরিলা যোদ্ধাদের গ্রুপ তার সাথে দেখা ও পরামর্শ করত। এদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও চলছিল বেশ ভালোভাবেই। আলতাফ মাহমুদ নতুন গানের অভাব বোধ করে সেদিকে মনোযোগী হলেন। দরজা-জানলা বন্ধ করে চলত নতুন আন্দোলন। আবদুল লতিফ লিখছেন গান আর সুর করছেন আলতাফ মাহমুদ। ভীতিকর পরিস্থিতির কারণে গলা খুলে গাইতে পারতেন না। কোনো কোনো রেকর্ড করতে হতো দুই বা ততোধিক বার।

আলতাফ মাহমুদের হাতে লেখা চিরকুট 

আলতাফ মাহমুদের ১২টি গানের স্পুল নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় একজন ধরা পড়ে গেল। হত্যা করা হলো তাঁকে। সেই স্পুলগুলো আর পাওয়া গেল না। জুলাইয়ের শেষদিকেই আবার অনেকগুলো গান রেকর্ড করে দুইটি বড় বড় স্পুল তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠালেন। তার সুর করা গানগুলো বাঙালির প্রাণে আত্মপরিচয়ে সচেতনতা আনে। আনে নতুন লড়াইয়ের শক্তি।

তারপর
ব্যক্তিগত জীবনে আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ এবং কন্য শাওন মাহমুদ। সেই সময় থাকতেন ৩৭০; আউটার সার্কুলার রোডে। স্ত্রী সারার ভাইবোন ও মা ছিলেন পরিবারের সাথেই। সব ছাপিয়ে উত্তপ্ত সময়ের তরুণেরা তার কাছে আদৃত হতো সন্তানের মতন। জুলাইয়ের প্রথম দিকেই তিনি ঢাকায় ক্র্যাকপ্লাটুনের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বেশিদিন তাকে সময় দেওয়া হয়নি। ৩০ আগস্ট, ভোর ৫টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁর বাসা ঘেরাও করে। তারপর আর তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাঙালি জাতির আকাশ থেকে খসে পড়ল এক নিঃস্বার্থ বিপ্লবী। অনন্য এক মুক্তিকামী স্বপ্নদ্রষ্টা। বাংলার সমাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যিনি আজন্ম যুদ্ধ করেছেন সুর এবং শক্তি দিয়ে।