হিন্দু 'কালেজ' থেকে প্রেসিডেন্সি: ২০৩ বছরের যাত্রাপথ
বইটি হাতে নিয়ে চমকে উঠি। আমরা তো জেনেছি, হিন্দু কলেজ। বইয়ে দেখছি লেখা রয়েছে, কলেজ নয়, 'কালেজ'। শুরুতে নামের ক্ষেত্রে হিন্দু কালেজই ছিল। ইতিহাস বইয়ে তেমনই বলা হয়েছে। তারপর হয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজ।
১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করা হয় অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতার এই নতুন কলেজের। হিন্দু কালেজ। কালে কালে যে নাম বদলে প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে।
পুরো ইতিহাসটি লিপিবদ্ধ আছে প্রসাদ সেনগুপ্ত রচিত ঢাউস ইতিহাস গ্রন্থ 'হিন্দু কালেজ'-এর প্রায় পাঁচশতাধিক পাতায়। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে গেলে চোখে পড়ে ২০২ বছরের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান, ইতিহাসের শত আখ্যান যার পরতে পরতে মিশে আছে। সিগনেট প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত বইটিও কিনেছি কয়েক মাস আগে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট থেকেই, মূল কলেজের আশেপাশের এলাকায় এক বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে।
কলেজের জন্মদিনে (২০ জানুয়ারি) বইটি আবার হাতে নিতেই ফিরে এলো ২০০ বছরের সুপ্রাচীন ইতিহাসের বহুমাত্রিক ঝলক। তখন উনবিংশ শতকের প্রথম দিক। সেই সময়, বা তারও আগে বাংলায় সেরকম উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। পশ্চিমী ধাঁচের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাও তখন প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
তবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ক্ষমতা দখল করে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিকে কব্জা করছিল। আস্তে আস্তে বাংলা হয়ে পুরো ভারতে ছড়াচ্ছিল মিশনারি শিক্ষা, খ্রিস্ট ধর্ম ও পশ্চিমা ভাবাদর্শ।
এসব ইতিহাসের ধারা এবং রাজনীতির হাত ধরে পশ্চিমা ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা প্রসারের ইতিবৃত্ত নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, 'সরকারি ও মিশনারি শিক্ষা' গ্রন্থের নাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মহীবুল আজিজের এই গবেষণায় একেবারের শুরুর ইতিহাসটি আছে। দেখানো হয়েছে, মিশনারি ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার কেমন করে বাংলা তথা ভারতে নতুন রাষ্ট্রনীতির পাশাপাশি নতুন ধর্ম, জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলছে দেশজ কাঠামো ভেঙে ভেঙে।
শিক্ষা এই পশ্চিমীকরণের পহেলা নম্বরের হাতিয়ার ছিল। এবং একে কেন্দ্র করে কলকাতাভিত্তিক নবজাগরণ আসে। যাকে অনেকে হিন্দু নবজাগরণও বলেন। এইসব ক্ষেত্রে হিন্দু কালেজের প্রভূত ভূমিকা রয়েছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলায় উনবিংশ শতকের শুরুর সময় থেকেই হিন্দু ঘরের সন্তানদের ইংরেজি, ভারতীয় ভাষা, বিজ্ঞান-সাহিত্য শেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয় স্থানীয় হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় কুসংস্কার যাতে দানা না বাঁধতে পারে, সেই ভাবনাও চলতে থাকে। এই সমস্ত কিছুর ফসল হিসেবে আসে নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হিন্দু কালেজ।
তারপর ২০৩ বছর পেরিয়ে গেছে কলেজ স্ট্রিটের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। তবে এতে কিছু ঐতিহাসিক পালাবদল আছে। দেখা যায়, হিন্দু কালেজের ইতিহাস থেমে আছে শুরুর ৩৭ বছরেই। শুরুর দিকে জুনিয়র ও সিনিয়র দুটি বিভাগ থাকলেও, ১৮৫৪ সালে তা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। জুনিয়র বিভাগ হয়ে যায় হিন্দু স্কুল, এবং সিনিয়র বিভাগ প্রেসিডেন্সি কলেজ। এভাবেই প্রাচীন 'হিন্দু কালেজ'-এর কাঠামোর ভেতর থেকে রূপ লাভ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়।
সামগ্রিকভাবে 'হিন্দু কালেজ' তথা প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূমিকা হয়েছে সুদূরপ্রসারী। শুধু বর্তমান পড়ুয়ারাই নন, এখানকার শিক্ষকরাও বাংলা এবং ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। ভারত (রাজেন্দ্র প্রসাদ), পাকিস্তান (মহম্মদ আলি বগুড়া), বাংলাদেশ (আবু সাঈদ চৌধুরী), তিন দেশেরই প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান এখানকার ছাত্র ছিলেন। এমন গৌরব কম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই আছে।
তবে কলকাতায় যে বিশাল ক্যাম্পাসটি যাতায়াতের পথে সকলের চোখে পড়ে, একসময় কিন্তু তেমনটা ছিল না। বারবার জায়গা বদল হয়েছে এই কলেজের। চিৎপুর, বউবাজার-সহ কলকাতার নানা জায়গায় ভাড়া বাড়িতে চলেছে পড়াশোনা।
বস্তুত ছাত্রসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় স্থান সংকুলানের জন্য বার বার স্থান বদল করতে হয়েছে কলেজকে। এক পর্যায়ে কলেজের পরিচালন সমিতির অন্যতম সদস্য রাজা রামমোহন রায়ের তৎকালীন বড়লাট লর্ড আমহার্স্টকে লেখা একটি চিঠি পরিস্থিতির সুরাহা ঘটায়। এখনকার সংস্কৃত কলেজের সঙ্গে একই বাড়িতে ঠাঁই পায় হিন্দু কালেজ।
তারপর অবশ্য একসময়ের দেশীয় হিন্দু পরিচালন সমিতি ভেঙে যায় ১৮৫৪ সালে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে আসে এই কলেজের পরিচালনা ভার। হিন্দু কালেজ বদলে যায় প্রেসিডেন্সি কলেজে। নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি হাতে আর ফিরে যায়নি, থাকে সরকারি কর্তৃত্বেই।
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ বদলে দেওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে একদার হিন্দু কালেজ তথা আজকের প্রেসিডেন্সি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। ২০৩ বছর পেরিয়েও সেসব অর্জন উল্লেখযোগ্য, যা বাংলার ঔপনিবেশিক শাসনে পশ্চিমী আধুনিকতায় উত্তরণের ইতিহাসের মূল্যবান অংশ হয়ে আছে।