করোনাভাইরাস পরবর্তী দুনিয়া



ইউভাল নোয়াহ হারারি
গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

এই ঝড় চলে যাবে। তবে এখনকার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বদলে দিতে পারে আমাদের ভবিষ্যত জীবন। মানবজাতি এখন এক বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলা করছে। সম্ভবত আমাদের প্রজন্মের সবথেকে বড় সংকট। জনতা এবং সরকারগুলো আসছে কয়েক সপ্তাহ যে সিদ্ধান্তগুলো নেবে, তা-ই গঠন করবে আগামী পৃথিবী। তারা কেবল আমাদের স্বাস্থ্যসেবাই নির্ধারণ করবে না; নির্ধারণ করবে আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি। আমাদের ভূমিকা হতে হবে দ্রুত এবং সিদ্ধান্তমূলক। মাথায় রাখতে হবে সুদূরপ্রসারী ফলাফল। দুইটা বিকল্পের মধ্য থেকে বেছে নেবার সময় যেন কেবল সাময়িক হুমকি কাটিয়ে ওঠাই মুখ্য না হয়; সেই সাথে মাথায় থাকে দুর্যোগপরবর্তী কেমন দুনিয়ায় আমরা বসবাস করতে চাই। এই ঝড় থেমে যাবে, টিকে থাকবে মানব সম্প্রদায়। তখনও বেঁচে থাকবে আমাদের অনেকে। কিন্তু বসবাস করবে এক ভিন্ন পৃথিবীতে।

অনেক স্বল্পমেয়াদী জরুরি পদক্ষেপ তখন রুটিনে পরিণত হবে। জরুরি অবস্থার প্রকৃতিই এই যে তা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া অব্দি দ্রুততম করে ফেলে। যে সিদ্ধান্ত নিতে সাধারণ সময়ে কয়েক বছর লেগে যেত জরুরি অবস্থায় তা হয় কয়েক ঘণ্টায়। অপরিণত এমনকি বিপদজনক প্রযুক্তিগুলোকেও নামানো হয় কাজে। কারণ কিছু একটা না করার পরিণাম আরো ভয়াবহ। বড়সড় সামাজিক পরীক্ষার জন্য গোটা দেশই তখন গিনিপিগ। যখন সবাই বাড়ি থেকে কাজ করে এবং দূরত্ব বজায় রেখে যোগাযোগ রাখে—কী হবে? কী ঘটবে যখন সব কয়টা স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় হয় অনলাইন নির্ভর? স্বাভাবিক সময়ে সরকার, ব্যবসায়ী এবং শিক্ষাবোর্ডগুলো এই ধরনের পরীক্ষা মেনে নিত না। কিন্তু এটা স্বাভাবিক সময় না। এই সংকটে আমাদের সামনে খোলা আছে মাত্র দুইটি পথ। প্রথমটি নিশ্ছিদ্র নজরদারি এবং তা নাগরিক ক্ষমতায়নের মধ্য থেকে। আর দ্বিতীয়টা জাতীয়ভাবে বিচ্ছিন্নতা এবং বৈশ্বিক সংহতির মধ্য থেকে।

নিশ্ছিদ্র নজরদারি
মহামারি থামাতে গোটা জনসংখ্যাকে কিছু নিয়মে আনা প্রয়োজন। তা বাস্তবায়নের জন্য দুইটা রাস্তা খোলা আছে। প্রথমটা সরকার কর্তৃক জনগণের তদারকি করা এবং নিয়ম ভঙ্গকারীকে শাস্তি প্রদান। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব মানুষের ওপর নজরদারি সম্ভব করেছে আজকের প্রযুক্তি। পঞ্চাশ বছর আগেও কেজিবি ২৪০ মিলিয়ন সোভিয়েত নাগরিককে চব্বিশ ঘণ্টা তদারক করতে পারেনি। পারেনি প্রতিদিনের প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে আশানুরূপ সমন্বয় করতেও। কেজিবি নির্ভর করেছে শুধু ব্যক্তি এজেন্ট এবং বিশ্লেষকের ওপর। একজন এজেন্ট তো আর প্রতিটি নাগরিকের ওপর নজরদারি চালাতে পারে না। রক্তমাংসের গোয়েন্দা না, বর্তমান সরকারেরা নির্ভর করে সর্বত্র বিদ্যমান সেন্সর এবং শক্তিশালী এলগরিদমের ওপর।

রোমের কলোসিয়াম

করোনাভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে নতুন নজরদারি প্রযুক্তি সামনে এনেছে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে এগিয়ে চীন। জনতার স্মার্টফোন পর্যবেক্ষণ করে, কোটি কোটি ফেইস-রিকগনিশন ক্যামেরা ব্যবহার করে, মানুষকে শরীরের তাপমাত্রা এবং স্বাস্থ্যগত অবস্থা পরীক্ষা ও রিপোর্ট করতে বাধ্য করে চীনা কর্তৃপক্ষ কেবল সন্দেহভাজন আক্রান্তকেই দ্রুত সনাক্ত করেনি। সেই সাথে বের করেছে তাদের চলাফেরা এবং তাদের সাথে সংস্পর্শে আসা মানুষদেরও। এমনকি আশেপাশের সম্ভাব্য সংক্রমিত রোগী সম্পর্কে সাবধান করে দিত অনেক মোবাইল অ্যাপ।

যখন ফটোগ্রাফি
এই আর্টিকেলের সাথে সংযুক্ত ছবিগুলো নেওয়া হয়েছে ইতালির ফাঁকা রাস্তার ওয়েবক্যাম থেকে। পেয়েছেন লকডাউনে আটকে পড়া ফটোগ্রাফার—গ্রাজিয়ানো প্যানফিলি। এই ধরনের প্রযুক্তি কেবল পূর্ব এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। ইসলায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি ইসরায়েল সিকিউরিটি এজেন্সির বিশেষ নজরদারি প্রযুক্তিকে ব্যবহারের অনুমোদন করেছেন। স্বাভাবিক সময়ে যা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সংরক্ষিত ছিল; এখন তা হবে করোনা ভাইরাসের রোগীকে নজরদারিতে রাখতে। সংসদীয় উপকমিটি বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করলেও নেতানিয়াহু ‘জরুরি আইন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন সে বাধা।

লোদিতে ভেদ্যুতা দেলা কাসা ইউনিভার্সিটি

আপনি বলতে পারেন, এ তো আর নতুন কিছু না। বর্তমানে সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে তদারক, পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করছে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি। আমরা সচেতন না হলেও নজরদারির ইতিহাসে মহামারি একটা মাইলফলক হয়ে থাকতে পারে। আগে যারা জনতার ওপর নজরদারি প্রযুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তারাও এবার কেবল গ্রহণই করবে না; বরং তা হবে আরো কঠিন ও গভীরভাবে। তদারকির নাটকীয় রূপান্তর ঘটবে ‘ওভার দ্য স্কিন’ থেকে ‘আন্ডার দ্য স্কিন’-এ। আপনি যখন স্মার্টফোনের স্ক্রিনে কোনো লিংকে ক্লিক করেছেন এতদিন সরকার জানতে চাইত আপনি আসলে কিসের ওপর ক্লিক করেছেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের মৌসুমে তাদের আগ্রহের জায়গায় বদল ঘটেছে। এখন সরকার জানতে চায় আপনার আঙুলের তাপমাত্রা এবং ত্বকের নিচে রক্তচাপ।

জরুরি অবস্থার পুডিং
কর্মক্ষেত্রে নজরদারিতে থেকে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। যেমন আমরা জানি না যে এই নজরদারি কিভাবে কাজ করে কিংবা পরবর্তী দিনগুলোতে এর ফলাফল কী? সার্ভেইলেন্স প্রযুক্তি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে উন্নত হচ্ছে। দশ বছর আগেও যাকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মনে হতো এখন তা পরিণত হয়েছে পুরাতন খবরে। থট এক্সপেরিমেন্ট হিসাবে এমন এক সরকারকে ধরা যাক, যে প্রত্যেক নাগরিককে বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট পরিয়ে দেবে, আর চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করবে শরীরের তাপমাত্রা এবং রক্তচাপ। প্রাপ্ত উপাত্ত গিয়ে জমায়েত এবং বিশ্লেষিত হবে সরকারি এলগরিদমে। আপনার অসুস্থতা আপনি জানার আগেই জেনে যাবে এলগরিদম। জেনে যাবে আপনি কোথায় ছিলেন, কার কার সাথে দেখা করেছেন। এভাবে সংক্রমণকে অভাবনীয় গতিতে নামিয়ে আনা এমনকি থামিয়ে দেওয়া যায়। মহামারিকে আটকে দিতে পারে কয়েকদিনের মধ্যে। শুনতে দুর্দান্ত লাগছে তাই না?

আবশ্যকীয় খারাপ দিকটা হলো এর মধ্যে দিয়ে ভয়ানক নজরদারির ব্যবস্থা বৈধতা পেয়ে যাবে। আপনি যদি জানেন আমি সিএনএন-এর কোনো লিংকের বদলে ফক্স নিউজের লিংকে ক্লিক করেছি, তাহলে জানতে পারবেন আমার রাজনৈতিক দর্শন এমনকি সম্ভাব্য ব্যক্তিত্বও। আমার ভিডিও ক্লিপ দেখাকালে যদি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন আমার শরীরের তাপমাত্রা, রক্তচাপ এবং হৃদপিণ্ডের স্পন্দন, তবে বুঝে ফেলবেন—কী আমাকে হাসায়, কী কাঁদায় এবং কী রাগান্বিত করে। একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি। রাগ, হাসি, বিরক্তি এবং ভালোবাসা প্রকৃতপক্ষে জ্বর এবং কাশির মতোই জৈবিক ঘটনা। যে প্রযুক্তি কাশি সনাক্ত করতে পারে তা হাসিকেও পারে। সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো যদি বায়োমেট্রিক উপাত্তের বিপুল জমায়েত শুরু করে, তবে তারা আরো বেশি জানতে পারবে, যতটা আমরা আমাদের জানি। আমাদের অনুভূতি আগে থেকেই কেবল ধরে ফেলবে না, নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে নিজেদের মতো। পণ্য হোক বা রাজনীতিবিদ—আমাদের কাছে বিক্রি করতে পারবে সব। ক্যামব্রিজ এনালাইটিকার তথ্য হ্যাকের কৌশল এই বায়োমেট্রিক পর্যবেক্ষণের কাছে মনে হবে প্রস্তর যুগের কিছু। মনে করা যাক ২০৩০ সালের উত্তর কোরিয়ার কথা। প্রতিটি নাগরিকের বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট পরে থাকতে হয় চব্বিশ ঘণ্টা। মহান নেতার ভাষণ শুনে আপনি যদি রেগে যান আর সে কারণে আপনার ব্রেসলেটে তা প্রকাশিত হয়, তাহলে আপনি শেষ।

জরুরি অবস্থায় বায়োমেট্রিক নজরদারিকে সাময়িক পদক্ষেপ হিসাবে মেনে নেবেন আপনি। জরুরি অবস্থা উঠে গেলে এর উপযোগিতাও থাকে না। কিন্তু সাময়িক পদক্ষেপগুলোর জরুরি অবস্থাকে দীর্ঘ করার একটা বাজে বৈশিষ্ট্য আছে। বিশেষ করে সবসময় একটা না একটা নতুন জরুরি অবস্থার উদয় ঘটতেই থাকে। আমার মাতৃভূমি ইসরায়েল ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে এক জরুরি অবস্থার ঘোষণা দেয়। ফলে সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ এবং ভূমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে পুডিং বানানো অব্দি বিধিনিষেধের জাল বিস্তৃত হয় (জ্বি পুডিং, আমি মজা করছি না)। স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে, কিন্তু ইসরায়েলে জরুরি অবস্থা শেষ হবার ঘোষণা আসেনি। ব্যর্থ হয়েছে ১৯৪৮ সালে নেওয়া অনেক সাময়িক পদক্ষেপ বিলোপ করতে। (অবশ্য ২০১১ সালে দয়াপরবশ হয়ে পুডিংয়ের ওপর থেকে জরুরি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়)।

ক্যাসারতাতে রাজকীয় প্রাসাদ

এমনকি যদি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শূন্যতে নেমেও যায়; তবু কোনো কোনো তথ্যখেকো সরকার বায়োমেট্রিক নজরদারি ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দেখাবে। যদি দ্বিতীয় আরেকটা ধাক্কা আসে মহামারির কিংবা মধ্য আফ্রিকায় একটা নতুন ইবোলা স্ট্রেইনের আবির্ভাব ঘটেছে কিংবা… আপনি বুঝে নিন। আমাদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য একটা মহাযুদ্ধ চলছে সাম্প্রতিক সময়ে। করোনাভাইরাসের সংকট সেই যুদ্ধের শীর্ষবিন্দু হতে পারে। কারণ যখন মানুষকে গোপনীয়তা এবং স্বাস্থ্যের মধ্য থেকে একটি বেছে নিতে বলা হয়, তারা স্বাস্থ্যকেই বেছে নেবে।

সাবান পুলিশ
প্রকৃতপক্ষে মানুষকে স্বাস্থ্য এবং গোপনীয়তা থেকে একটি বেছে নিতে বলাই সমস্যার মূল। কারণ এটি একটি ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত। আমরা স্বাস্থ্য এবং গোপনীয়তা দুটোকেই পেতে পারি এবং পাওয়া উচিত। নিশ্ছিদ্র নজরদারিকে প্রাতিষ্ঠানিক করার বদলে নাগরিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমেও আমরা মহামারি থামাতে এবং আমাদের রক্ষা করতে পারি। গেল সপ্তাহে করোনা মহামারি মোকাবেলায় সবচেয়ে সফল প্রচেষ্টা দক্ষিণ কোরিয়ার, তাইওয়ান এবং সিঙ্গাপুরের। ট্র্যাকিং এপ্লিকেশন ব্যবহারের বাইরেও তারা বেশি নির্ভর করেছে ব্যাপক পরীক্ষা, নির্ভুল রিপোর্ট, স্বেচ্ছায় সহাযোগিতা এবং সচেতন জনগনের ওপর।

কেন্দ্রীভূত পর্যবেক্ষণ এবং কঠিন শাস্তি দিয়েই শুধু জনগণকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা যায় না। জনগণ যখন কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাস করে এবং তাদেরকে যদি বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলা হয়, তাহলে কোনো প্রকার নজরদারি ব্যাতিরেকেই মানুষ সঠিক কাজটা করবে। পুলিশ নিয়ন্ত্রণের অজ্ঞ জনগোষ্ঠীর চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এবং আত্মসচেতন জনগণ অনেক বেশি শক্তিশালী এবং কার্যকর। উদাহরণ হিসাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথাই বলা যাক। মানব সম্প্রদায়ের পরিচ্ছন্নতার ইতিহাসে এটি এক দুর্দান্ত অগ্রগতি। এই সাদামাটা কাজটি প্রতি বছর কোটি কোটি জীবন রক্ষা করে। ঘাঁটলে দেখা যায়, কেবল ঊনিশ শতকে এসেই বিজ্ঞানীরা প্রথম আবিষ্কার করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার গুরুত্ব। আগের দিনে ডাক্তার আর নার্সেরা একটার পর একটা সার্জারি করে যেতেন হাত না ধুয়েই। আজ বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ প্রতিদিন হাত ধোয়। সাবান পুলিশের ভয়ে না, বিষয়টা তারা বুঝতে পারে বলে। আমি সাবান দিয়ে হাত ধুই কারণ আমি ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে শুনেছি। বুঝি এই ছোট্ট জীবাণুরা রোগ ছড়ায় আর জানি সাবান তাদের দূর করে।

কিন্তু এমন আস্থা ও সহযোগিতামূলক অবস্থাতে যাবার জন্য সবার আগে দরকার বিশ্বাস। বিশ্বাস করতে হবে বিজ্ঞানকে, দেশের কর্তৃপক্ষকে এবং বিশেষ করে গণমাধ্যমকে। গত কয়েক বছরে দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিবিদগণ প্রায়শ খাটো করে এসেছে বিজ্ঞান, কর্তৃপক্ষ এবং গণমাধ্যমের ওপর বিশ্বাসকে। সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিবিদেরাই এবার কর্তৃত্ববাদ কায়েম করতে চাইতে পারে। এই অজুহাতে যে আপনি ঠিকটা করছেন কিনা এ বিষয়ে কেবল জনতার ওপরে বিশ্বাস রাখলেই হবে না।

পেসকারার পিয়েৎসা বিয়েতো রবার্তো 

যে বিশ্বাস বছরের পর বছর ধরে ক্ষয় হয়েছে তা রাতারাতি ফেরানো যায় না। কিন্তু এটা স্বাভাবিক সময় না। সংকটের সময়ে মনও খুব দ্রুত বদলায়। আপনার ভাইবোনদের সাথে বহু দিন ধরে আপনার তিক্ততা থাকতে পারে। কিন্তু যখনই জরুরি অবস্থা দুয়ারে আসে, তখনই আপনি নিজের ভেতর লুকায়িত বিশ্বাস এবং মৈত্রী আবিষ্কার করতে পারবেন। দৌড়ে যাবেন একে অপরকে সাহায্য করার জন্য। নজরদারির রাজত্ব তৈরি করার বদলে আমরা এদিকেই হাঁটতে পারি। বিজ্ঞানের প্রতি, জন কর্তৃপক্ষের প্রতি এবং মিডিয়ার প্রতি বিশ্বাস পুনঃনির্মাণের সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। অবশ্যই নতুন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু তা হবে জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য।

আমার শরীরের তাপমাত্রা এবং রক্তচাপ পর্যবেক্ষণের জন্য আমিই যথেষ্ট। তথ্যগুলো সরকারকে সর্বশক্তিমান করার জন্য না। উপরন্তু তথ্যগুলো আমাকে আমার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন করে। সরকারকে তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দায়ী করা যায়। যদি চব্বিশ ঘণ্টা আমার স্বাস্থ্যের অবস্থা অবগত হই; তখন খালি এতটুকুই বুঝব না যে কখন আমি অপরের স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠেছি। বরং এটাও জানব কোন অভ্যাস আমার স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। করোনাভাইরাসের মহামারিতে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান জানতে এবং বিশ্লেষণ করতে পারলে বিচার করতে পারব সত্যটা। সরকার আমাকে সত্য বলছে কিনা কিংবা মহামারির বিরুদ্ধে সঠিক রাস্তায় এগোচ্ছে কিনা। যখন নজরদারির ব্যাপারে কথা আসে, মনে রাখতে হবে যে প্রযুক্তি সরকার কর্তৃক জনগণকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, একই প্রযুক্তি জনগণের দ্বারা সরকারকে পর্যবেক্ষণ করায় ব্যবহৃত হতে পারে।

করোনাভাইরাস তাই নাগরিকত্বের জন্য প্রধান পরীক্ষা। আগামী দিনগুলোতে আমাদের উচিত হবে অপ্রতিষ্ঠিত ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব কিংবা স্বার্থবাদী রাজনীতিবিদের চেয়ে বৈজ্ঞানিক উপাত্ত এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কথা বিশ্বাস করা। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হবার মানে বিকিয়ে দিতে হবে অমূল্য স্বাধীনতা—এই ভেবে যে, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এটাই একমাত্র পথ।

একটা বৈশ্বিক পরিকল্পনা প্রয়োজন
আমাদের সম্মুখে দ্বিতীয় জরুরি সিদ্ধান্তটি হলো—জাতীয়তাভিত্তিক বিচ্ছিন্নতা নাকি বৈশ্বিক সংহতি। মহামারি এবং অর্থনৈতিক সংকট উভয়ই বৈশ্বিক সমস্যা। সমাধানও কেবল বৈশ্বিক সহযোগিতার মধ্য দিয়েই সম্ভব। ভাইরাসকে পরাজিত করতে সবার আগে প্রয়োজন তথ্যকে বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। সেটাই হবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের বড় সফলতা। চীনের করোনাভাইরাস এবং আমেরিকার করোনাভাইরাস কিন্তু মানুষকে সংক্রমিত করার ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারছে না। অথচ কিভাবে ভাইরাসের সাথে মোকাবিলা করতে হবে এই বিষয়ে চীন আমেরিকাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু শেখাতে পারে। সকালে ইতালির মিলানে কোনো ডাক্তার যা আবিষ্কার করল, তা সন্ধ্যায় তেহরানে মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। যখন যুক্তরাজ্য সরকার বিভিন্ন নীতি নিয়ে দ্বিধান্বিত, তখন সে কোরিয়া থেকে পরামর্শ নিতে পারে। প্রায় একই সমস্যায় তারা এক মাস আগে ভুগেছে। কিন্তু এর জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং বিশ্বাস প্রয়োজন। সামনের দিনগুলোতে প্রত্যেকের উচিত ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব এবং স্বার্থবাদী রাজনীতির চেয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকে বেশি বিশ্বাস করা।

দেশগুলোর উচিত স্বেচ্ছায় তথ্য প্রকাশ করা এবং সাহায্য চাওয়া। উচিত অন্য দেশের দেওয়া তথ্যকে বিশ্বাস করা এবং আস্থা রাখা। চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বিশেষ করে টেস্টিং কিট এবং রেসপিরেটরি মেশিনের উৎপাদন এবং তা বণ্টন করার বৈশ্বিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে প্রত্যেকের একা প্রচেষ্টার বদলে সহযোগিতামূলক বৈশ্বিক প্রচেষ্টা দরকার, যাতে উৎপাদন ত্বরান্বিত এবং জীবনরক্ষার যন্ত্রগুলোর বণ্টন সুষম হয়। যেভাবে যুদ্ধের সময় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানবজাতির এই যুদ্ধে সকল উৎপাদন ব্যবস্থার মানবিকরণ দরকার। কম আক্রান্ত ধনী দেশ মূল্যবান যন্ত্রপাতি পাঠিয়ে দিয়ে বেশি আক্রান্ত দরিদ্র দেশকে সাহায্য করতে পারে। এই বিশ্বাসে যে, তার যখন প্রয়োজন দেখা দেবে তখন অন্যান্য দেশ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসবে।

একই রকম বৈশ্বিক প্রচেষ্টা সম্ভব চিকিৎসকদের নিয়েও। করোনায় অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো তাদের ডাক্তারদের অপেক্ষাকৃত বেশি আক্রান্ত অঞ্চলে পাঠাতে পারে। নিজেদের বিপদে সাহায্য পাওয়া কিংবা ডাক্তারদের মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন—দুটোর জন্যই। পরবর্তীতে যখন মহামারি তার দিক বদল করবে, সাহায্য শুরু হবে বিপরীত দিক থেকেও। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক সহযোগিতা ব্যাপকভাবে প্রয়োজন। অর্থনীতির বৈশ্বিক গতিপ্রকৃতি এবং সাপ্লাই চেইন থেকেই তা বোধগম্য। যদি প্রতিটি সরকার অন্য কারো তোয়াক্কা না করে নিজে নিজে কাজ করতে থাকে, ফলাফল হবে কেবল বিশৃঙ্খলা এবং আরো গভীর সংকট। সবার আগে আমাদের দরকার একটা দ্রুত বৈশ্বিক পরিকল্পনা।

তোরে সান জিওভান্নি 

অন্য একটা পূর্বশর্ত বৈশ্বিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো। মাসের পর মাস সকল আন্তর্জাতিক ভ্রমণ স্থগিত রাখা কঠিন এক পরিস্থিতির তৈরি করবে। ব্যাঘাত ঘটাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রেও। দেশগুলোর উচিত অন্তত বিজ্ঞানী, ডাক্তার, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের মতো জরুরি ভ্রমণকারীদের ব্যাপারে পারস্পরিক সহযোগিতা করা। ভ্রমণকারীদের নিজের দেশে প্রি-স্ক্রিনিংয়ের ওপর নির্ভর করে এই বৈশ্বিক মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভব। যদি আপনি জানেন, সতর্কভাবে স্ক্রিনিংয়ের পরেই ভ্রমণকারীদের বিমানে ওঠানো হয়, তবে তাদেরকে আপনার দেশে গ্রহণ করতে দ্বিধা থাকবে না।

দুর্ভাগ্যবশত এগুলোর কিছুই করছে না দেশগুলো। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে গিলে ধরেছে প্যারালাইসিস। মনে হচ্ছে এখানে কেউ প্রাপ্তবয়স্ক নেই। অথচ কয়েক সপ্তাহ আগেই বিশ্বনেতাদের মধ্যে সাধারণ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে জরুরি সভা হয়ে যাবার কথা ছিল। জি-৭ এর নেতারা এই সপ্তাহে মাত্র একটা ভিডিও কনফারেন্সের আয়োজন করল, যদিও তেমন কোনো পরিকল্পনা উঠে আসেনি। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা ২০১৪ সালের ইবোলা মহামারির মতো বৈশ্বিক সংকটে আমেরিকা বিশ্বনেতার ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান আমেরিকা প্রশাসন ত্যাগ করেছে সেই অবস্থান। স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে, মানবজাতির ভবিষ্যতের চেয়ে আমেরিকার কল্যাণ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এমনকি সবচেয়ে কাছের মিত্রদেরকেও ত্যাগ করেছে এই প্রশাসন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেবার আগে একটা নোটিশ অব্দি পাঠায়নি তারা। এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা তো দূরের কথা। উপরন্তু কোভিড-১৯ এর একচেটিয়া আধিপত্যের জন্য এক জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিকে এক বিলিয়ন ডলার দেওয়ার দোষারূপ করেছে জার্মানির নামে।

 স্পিয়াজিয়া দি পোর্তো সান জিওরজিও

যদিও বর্তমান প্রশাসন মত বদল করে বৈশ্বিক পরিকল্পনায় নামে, খুব কম নেতাই তাকে অনুসরণ করবে। যে কোনো দায়িত্ব নেয় না, ভুল স্বীকার করে না এবং নিয়মিত সকল সফলতা নিজের দিকে আর দোষগুলো অন্যের কাঁধে ঢালে—তাকে অনুসরণ করবে কেন? আমেরিকার রেখে যাওয়া শূন্যস্থান যদি অন্য কেউ পূরণ না করে, তবে শুধু বর্তমান মহামারি মোকাবেলাই কঠিন হয়ে পড়বে না, আগামীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককেও বিষিয়ে দেবে। যদিও প্রত্যেক সংকট একটা সুযোগও বটে। আমরা প্রত্যাশা করি বর্তমান মহামারি মানব সম্প্রদায়কে বৈশ্বিক অনৈক্যের বিপদ বুঝিয়ে দেবে যথার্থভাবে। মানবজাতির প্রয়োজন একটা সিদ্ধান্ত। সে কি অনৈক্যের মধ্যে দিয়ে নিচের দিকে যাবে নাকি বৈশ্বিক সংহতির মধ্য দিয়ে উঠে আসবে উপরে? যদি আমরা অনৈক্যকে বেছে নেই, তবে শুধু এই সংকটই দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আরো ভয়াবহ দুর্যোগ আনতে পারে ভবিষ্যতে। আর যদি বৈশ্বিক সংহতি বেছে নেওয়া হয়, তা কেবল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেই বিজয় হবে না। বিজয় হবে একুশ শতকের সম্ভাব্য সমস্ত মহামারি এবং সংকটের বিরুদ্ধে।

আরো পড়ুন করোনাবিরোধী যুদ্ধে মানবজাতি নেতৃত্বহীন


ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত প্রবন্ধের রূপান্তর
অনুবাদ : আহমেদ দীন রুমি

   

বৃষ্টি নাকি ধান, কী প্রার্থনায় দেশ?



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
বৃষ্টি নাকি ধান, কী প্রার্থনায় দেশ?

বৃষ্টি নাকি ধান, কী প্রার্থনায় দেশ?

  • Font increase
  • Font Decrease

‘পথের কেনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সঙ্কেত/ সবুজে হদুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের ক্ষেত/ ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে/ ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়ে পাখিগুলে শুয়েছে মাঠের পরে/ কৃষাণ কনের বিয়ে হবে, তার হলদি কোটার শাড়ী/ হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কটি রোদ রেখা নাড়ি/ কলমী লতার গহনা তাহার গড়ার প্রতীক্ষায়/ ভিনদেশী বর আসা যাওয়া করে প্রভাত সাঁঝের নায়।’ পল্লীকবি জসীম উদদীনের ‘ধান ক্ষেত’ কবিতার অপূর্ব চিত্রায়ন কৃষকের শ্রম-ঘাম আর প্রকৃতির তরফে। কাব্যে-পঙক্তির বিমূর্ত চিত্র মূর্ত হয়েছে বিস্তীর্ণ মাঠে। কিষান-কিষানির বুক ভরা আশার সার্থক রূপায়ন হতে চলেছে এ-মৌসুমে।

এখন ভরা বৈশাখ। এ-সময়টা বোরো ধানের। বোরো ধান দেশের খাদ্যচাহিদার অন্তত ৫৫ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। দেশের হাওরভুক্ত ৭টি জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরে এই বোরোর চাষ বেশি হয়ে থাকে। এই ধান অতিবৃষ্টি, বন্যা ও ভারতের পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে দেশের খাদ্যচাহিদায় ঘাটতি পড়ে না। তাই এই ধান চাষ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত অনুকূল আবহাওয়া, বিশেষ করে রোদের উপস্থিতি অতি জরুরি। বর্তমানে সে পরিস্থিতি চলছে।

সিলেট অঞ্চলের মানুষ বলে এই অঞ্চলের মানুষের চাওয়া-পাওয়া, হতাশা-উচ্চাশার সঙ্গে আমি পরিচিত। তাদেরকে উদাহরণ হিসেবে টানছি। তাদের সঙ্গে থেকে জেনেছি, বোরো মৌসুমে নির্বিঘ্নে ঘরে ফসল তোলা কতটা জরুরি। গবাদি পশুর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে জরুরি খড় সংরক্ষণও। তীব্র রোদ এখানে সমস্যার নয়, এটা বরং আনন্দের। কারণ এই রোদ গা পোড়ালেও বুক ভরা আশার সার্থক বাস্তবায়নের পথ দেখায়। দেশের যে খাদ্যচাহিদা, যে খাদ্যনিরাপত্তা সেটা এই বোরো ধানের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই চাষ থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে দরকার হয় প্রকৃতির সহায়তা। এবার এখন পর্যন্ত সে সহায়তা আছে, যদিও এ মাসের শুরুর দিকে একবার ঝড়বৃষ্টিসহ শঙ্কার কালমেঘ হাতছানি দিয়েছিল। সেটা আপাতত দূরে সরেছে।

কিষান-কিষানির দরকার এখন তীব্র রোদ। তারা এটা পাচ্ছে। দেশে তীব্র তাপদাহ। এখানেও এর ব্যতিক্রম নয়। তবু তারা এই রোদের প্রার্থনায় রয়েছে। বৃষ্টি এখন তাদের কাছে দুর্যোগ-সম। কারণ এই বৃষ্টি এবং অতি-বৃষ্টিসৃষ্ট বন্যা তাদের স্বপ্নসাধ গুঁড়িয়ে ভাসিয়ে নিতে পারে সব। ২০১৭ সালের দুঃসহ স্মৃতি এখনও বিস্মৃত হয়নি সুনামগঞ্জের কৃষকেরা। সে বছর সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৩৭ হাওরের ফসল বন্যায় এবার ভেসে গিয়েছিল। গতবার কৃষক নির্বিঘ্নে ফসল ঘরে তুলেছেন। এরআগের বছর অন্তত ২০টি হাওরের ফসলহানি হয়েছিল বন্যায়।

প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ক্ষেতের ফসল, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা। এখানে প্রচণ্ড তাপদাহ তাই প্রভাব ফেলে সামান্যই। রোদে পুড়ে, প্রয়োজনে ছাতা মাথায় দিয়ে কিষান-কিষানিরা স্বপ্ন তোলেন ঘরে। তারা বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা না করে বরং রোদ আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখার প্রার্থনায় বসেন। কৃষকেরা পরিমিত বৃষ্টি চায় চৈত্র মাসে, বৈশাখে চায় খাঁ খাঁ রোদ্দুর, কারণ এই রোদে সোনালী ধান ঘরে ওঠে। লোককথার প্রচলিত, ধান তোলার মৌসুমে ঝড়বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য হাওরবাসীরা তন্ত্রসাধক বা ‘হিরাল’ ও ‘হিরালি’-দের আমন্ত্রণ জানাতেন। তারা এসে মন্ত্রপাঠ করে ঝড়বৃষ্টি থামানোর জন্য চেষ্টা করতেন। লোকায়ত বিশ্বাস থেকে আগেকার মানুষজন এমন আচার পালন করতেন। এসবে সত্যি কাজ হতো কিনা সেটা বিতর্ক এবং ব্যক্তি-বিশ্বাসসাপেক্ষ, তবে এই হিরাল-হিরালিদের আমন্ত্রণ বলে বৈশাখে একদম বৃষ্টি চায় না হাওরের কৃষক।

হাওরপারের মানুষেরা যখন রোদ অব্যাহত থাকার প্রার্থনায়, তখন দেশজুড়ে তীব্র তাপদাহে পুড়তে থাকা মানুষেরা আছেন বৃষ্টিপ্রার্থনায়। দেশের জায়গায়-জায়গায় বৃষ্টি প্রার্থনায় ইস্তিস্কার নামাজ পড়া হচ্ছে, গণমাধ্যমে সচিত্র সংবাদ আসছে এর। কোথাও প্রবল বিশ্বাসে কেউ কেউ ‘ব্যাঙের বিয়ে’ দিচ্ছেন, এটাও বৃষ্টি প্রার্থনায়। সামাজিক মাধ্যমে গরমের তীব্রতার আঁচ মিলছে, বৃষ্টি নাকি ধান—কোনটা জরুরি এই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের প্রচণ্ড তাপদাহ নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রচণ্ড গরমে দেশের মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে প্রতিবেদন করেছে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, এএফপি ও টাইমস অব ইন্ডিয়া। গণমাধ্যমগুলো বলছে, প্রচণ্ড গরমের কারণে টানা দ্বিতীয় বছর বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের ঘোষণাও এসেছে। বৃষ্টি-প্রার্থনায় নামাজের আয়োজনের কথাও এসেছে বিশ্বমিডিয়ায়।

একদিকে প্রচণ্ড তাপদাহ, অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তার প্রধান উপকরণ ধান ঘরে তোলার অনিশ্চয়তা—তবু অনেকের কাছে সাময়িক স্বস্তিই যেন মুখ্য। অথচ আর দিন দশেক বেরো আবাদ-এলাকায় বৃষ্টি না নামলে ধানগুলো ঘরে ওঠত কৃষকের। নিশ্চিত হতো খাদ্যনিরাপত্তার।

প্রকৃতির ওপর আমাদের হাত নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই; তবু মনে করি আমাদের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশে কৃষকদের গুরুত্ব থাকা উচিত। আমাদের চাওয়ায় হয়তো প্রকৃতির রীতি বদলাবে না, তুমুল রোদ্দুরের দেশে হঠাৎ বৃষ্টি নামবে না, তবে ধান ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত রোদ্দুর কামনায় কৃষক স্বস্তি পাবে; ভাবতে পারবে এই দেশ আছে তাদের সঙ্গে।

কৃষকের জয় হোক। অন্তত বোরো-এলাকায় প্রকৃতি কৃষকের সঙ্গে থাকুক।

;

৫০ বছর আগে মহাকাশ থেকে তোলা পৃথিবীর ছবি আজও শ্রেষ্ঠ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সালটা ১৯৬৮। বিশ্বব্যাপী মানুষ মেতে উঠেছিল বড়দিনের আনন্দে। তখনো জানতো না, বড়দিন উপলক্ষে তারা একটি বিশেষ উপহার পেতে চলেছে। পৃথিবী থেকে আমরা হরহামেশাই চাঁদ দেখি। অমাবস্যা-পূর্ণিমা, এমনকি পক্ষের মাঝামাঝি সময়ের বদৌলতে নানা দৃষ্টিকোণে নানা আকারের চাঁদ দেখতে পাই। তবে চাঁদ থেকে পৃথিবী দেখতে কেমন? এরকমটা হয়তো অনেকেই ভাবেন।

নাসার মহাকাশচারীরা অ্যাপোলো ৪ এ করে তখন চাঁদের চারপাশে টহল দিচ্ছে। সেখান থেকে তারা চাঁদের বাসকারীদের দৃষ্টিতে পৃথিবী কেমন হবে তার এক নমুনা জোগাড় করেন। ক্রিসমাসের কিছুদিন আগে ক্রুরা চাঁদকে প্রদক্ষিণ করার সময় ব্যারেন লুনার হরিজোন থেকে একটি ছবি তোলে। সেখানে সুদূর মহাকাশ থেকে পৃথিবীর একটি সুন্দর দৃশ্য ধারণ করা হয়। চমৎকার সেই রঙিন ছবিটি সবকিছু পরিবর্তন করতে চলেছিল।

ছবিটি তুলেছিলেন মার্কিন নভোচারী বিল অ্যান্ডার্স এবং জিম লাভেল। ছবিটি ধারণ করার পর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে যান। অর্ধ শতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পরও এটিকে প্রকৃতির সবচেয়ে আইকনিক ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, এটিই মহাকাশ থেকে তোলা প্রথম রঙিন এবং উচ্চ রেজুলেশনের ছবি।

১৯৭০ সালে পরিবেশ সচেতনতা এবং এই ব্যাপারে সক্রিয়তা বাড়ানোর উদ্দেশে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে পৃথিবী দিবস প্রচারিত হওয়ার কারণে ছবিটিকে বিশেষ কৃতিত্ব দেওয়া হয়।

যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মাইকেল প্রিচার্ড ছবিটিকে নিখুঁত দাবি করেন। তিনি বলেন, এই ছবিটি পৃথিবীর এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছিল, যা আগে কোনো ছবি করতে পারেনি। প্রকাণ্ড মহাবিশ্বে পৃথিবীর অস্তিত্ব কতটা ক্ষুদ্র গ্রহ, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ছবিটি।

১৯৬০ সালের পরই পৃথিবী নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। ষাটের দশকের শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মানুষ অনুধাবন করে পৃথিবীকে আজীবন একইভাবে ব্যবহার করা যাবে না। গ্রহের প্রতি আমাদের আরও অনুরাগী হতে হবে। সেই উদ্দেশে ১৯৬৯, ‘৭০ ও ‘৭১ সালে ‘ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ’, মার্কিন প্রতিষ্ঠান ‘এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি’ এবং ‘গ্রিনপিস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই ছবিটি প্রকাশের ১৮ মাস পর ২০ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক পৃথিবী রক্ষার আন্দোলনে রাস্তায় নামে।

পৃথিবী রক্ষা করার জন্য মানুষদের উৎসাহিত করার বেলায় ছবিটি অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। এখনো অবদি মহাকাশ থেকে পৃথিবীর পাঠানো ছবিগুলোর মধ্যে ১৯৬৮ সালে বড়দিনের আগে তোলা সেই ছবিটিকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়।

;

মাঝরাতে আইসক্রিম, পিৎজা খাওয়া নিষিদ্ধ করল মিলান!



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: স্কাই নিউজ

ছবি: স্কাই নিউজ

  • Font increase
  • Font Decrease

আইসক্রিম, পিৎজা অনেকের কাছেই ভীষণ পছন্দের খাবার। তবে ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে মাঝরাতে এসব মুখরোচক খাবার ও পানীয় খাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ইতালিতে জেলাটিনের তৈরি আইসক্রিম খুব বিখ্যাত। এজন্য ইতালিতে 'জেলাটো সংস্কৃতি' নামে একটা কালচার গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি ইতালির মিলানের বাসিন্দাদের জন্য একটি নতুন আইন প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিবেদন- স্কাই নিউজ।

মিলানে বসবাসকারীদের অধিকাংশই মাঝরাতে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে আইসক্রিম, পিৎজা, ফাষ্টফুড জাতীয় খাবার ও পানীয় পান করে থাকে। এতে করে সেখানকার এলাকাবাসীদের রাতের ঘুম বিঘ্নিত হয়। নতুন প্রস্তাবিত আইনে শহরবাসীর রাতের ঘুম নির্বিঘ্ন করতে মধ্যরাতের পর পিৎজা ও পানীয়সহ সব ধরনের টেকওয়ে খাবার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

তবে মধ্যরাতের পর আইসক্রিম নিষিদ্ধ করার চেষ্টা এবারই প্রথম নয়। ২০১৩ সালে, তৎকালীন মেয়র গিউলিয়ানো পিসাপিয়া অনুরূপ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু 'অকুপাই জেলাটো' আন্দোলনসহ তীব্র প্রতিক্রিয়ার পরে তিনি এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

এরপর আবারও মিলানে এ আইনটি প্রস্তাব করেছেন ডেপুটি মেয়র মার্কো গ্রানেল্লি। দেশটির ১২টি জেলা এই প্রস্তাবের আওতাভুক্ত হবে বলে জানিয়েছে মিলান কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে মিলানের মেয়র গ্রানেল্লি বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিকতা ও বিনোদন এবং বাসিন্দাদের শান্তি ও প্রশান্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা।

প্রস্তাবটি নিম্নলিখিত এলাকাগুলোতে প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়েছে মিলান কর্তৃপক্ষ: নোলো, লাজারেটো, মেলজো, ইসোলা, সারপি, ভায়া সিজারিয়ানো, আরকো ডেলা পেস, কোমো-গাইআউলেন্টি, পোর্টা গ্যারিবল্ডি, ব্রেরা, টিসিনিজ এবং দারসেনা-নাভিগলি।

জানা যায়, প্রস্তাবটি মে মাসের মাঝামাঝি থেকে কার্যকর থাকবে এবং নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। এটি প্রতিদিন রাত ১২.৩০ টায় এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং সরকারী ছুটির দিনে রাত ১.৩০ টা থেকে প্রয়োগ করা হবে। তবে এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে নাগরিকদের মে মাসের শুরু পর্যন্ত আপিল করার এবং আইন পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়ার সময় রয়েছে।

 

 

 

;

অস্ট্রেলিয়ায় নিখোঁজ কুকুর ফিরলো যুক্তরাজ্যের মালিকের কাছে



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরতে এসে নিখোঁজ হয় যুক্তরাজ্যের এক দম্পতির পালিত কুকুর। যুক্তরাজ্যে আসার ১৭ দিন পর মিলো নামের কুকুরটিকে ফিরে পেয়েছেন জেসন হোয়াটনাল নিক রোল্যান্ডস দম্পতি।

হোয়াটনাল এবং তার সঙ্গী নিক সম্প্রতি তাদের কুকুর মিলোকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া পরিদর্শনে যান। তারা যখন সোয়ানসিতে বাড়িতে যাচ্ছিলেন তখন মেলবোর্ন বিমানবন্দরে তার হ্যান্ডলার থেকে কুকুরটি পালিয়ে যায়।

সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী কুকুরটিকে অবশেষে মেলবোর্নের শহরতলিতে ১৭ দিন পর খুঁজে পাওয়া যায়।


হোয়াটনাল স্কাই নিউজকে বলেন, ‘মিলোকে ফিরে পাওয়াটা খুবই আশ্চর্যজনক ছিল আমার জন্য। যখন আমি আমার প্রিয় মিলোর (কুকুর) সাথে পুনরায় মিলিত হয়েছিলাম, তখন আমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। আমার কান্না দেখে অন্যরাও কেঁদেছিল। এটি সত্যিই আবেগপ্রবণ ছিল।

তিনি আরও বলেন, বিশ্বের অন্য প্রান্তে থেকে মিলোর কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। আমরা জানতাম না মিলো কোথায় আছে। এটি বেশ হতাশাজনক ছিল আমাদের জন্য, কিছুটা আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাকে ফিরে পাবো ভাবিনি।

মিলোকে পাওয়ার জন্য সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছিলাম, তখন স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে সাহায্য আসে, তারা মিলোর সন্ধান দেয়। মিলোকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের ধন্যবাদ।

;