শিশুকেন্দ্রিক ফোকলোরের অন্যতম অনুষঙ্গ লোকক্রীড়া। অতীতে খোলা মাঠ, বাড়ির উঠানে অনেককে নিয়ে চর্চিত হলেও প্রতিবেশগত তারতম্যের কারণে লোকক্রীড়া শহুরে বন্দী জীবনে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। খোলা মাঠের অভাবে কিছু লোকক্রীড়া আর চর্চিত হয় না। আর খোলা মাঠ থাকলেও বর্তমানে করোনা আতঙ্কের সময়ে চর্চা আরো সম্ভব নয়। আবার কিছু খেলা ঘরে বসেও সম্ভব। করোনাকালীন এই সময়ে গৃহবন্দী শিশুর শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য প্রায় ‘নো কস্ট’ বা বিনামূল্যের এই খেলাগুলো কতটা ভূমিকা রাখতে পারে এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত একটি সুস্থ শৈশব উপহার দিতে পারে—তার হদিশ করাই এই লেখার উদ্দেশ্য।
শিশুকেন্দ্রিক ফোকলোর
ফোকলোরের যেসব উপাদান শিশুদের কেন্দ্র করে তৈরি এবং আবহমানকাল ধরে টিকে আছে, তাকেই ‘চিলড্রেনস ফোকলোর’ বলা হয়। ড. নির্মলেন্দু ভৌমিক এই শাখাকে ‘চাইল্ডলোর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই লেখাটি মূলত পাঁচ থেকে বারো/চোদ্দ বছর বয়সী শিশুদের ওপর ভিত্তি করেই। শৈশবে মানুষ তার পরিবারের পাশাপাশি সমাজ ও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া শুরু করে। বন্ধু, পরিবার, শিক্ষক আলাদা আলাদা সম্পর্কের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করানো শুরু করা এবং শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘মানুষ হয়ে ওঠার কাল শৈশব কাল।’ এই সময়টাকে কেন্দ্র করে ফোকলোরের নানা উপাদান তৈরি হয়েছে। বহু ধাঁধা, ছড়াও এর অন্তর্গত। লোকক্রীড়া তার অন্যতম।
গৃহবন্দী শিশু ও ভিডিও গেমসের প্রভাব
করোনাকালে শিশু গৃহবন্দী। এই অসুখের বিস্তার ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময়ের শিশুরা কি অন্যান্য সময়ও গৃহবন্দী নয়? ঢাকাসহ বিভাগীয় কয়টি শহরে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ রয়েছে? বা কয়টি স্কুলে খেলার মাঠ আছে! নেই তো! মফস্বলে হয়তো পাড়া বা মহল্লায় কিছু খেলার মাঠ রয়েছে। কিন্তু যেহেতু ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে, তাই বেশি মানুষ জড়ো হয় সেরকম স্থানে খেলাধুলা একেবারেই সম্ভব না। বাকি থাকে নিজের বাড়ির বেড রুম, ড্রয়িং রুম, বারান্দা বা ছাদ। আবার অনেক সময় বিছানার ওপর, সোফার ওপর বা ফ্লোরে শিশুরা কত রকমের খেলা তৈরি করে ফেলে তার ইয়ত্তা নেই। অর্থাৎ নিজস্ব অভ্যাস বা সৃজনশীলতা দিয়ে শিশু স্বল্প পরিসরে নিজেদের ইচ্ছামতো খেলা তৈরি করতে পারে। কখনো একা, কখনো ভাইবোন, কখনো মা-বাবা তার সঙ্গী হয়। এ বিষয়ে নেত্রকোনা অঞ্চলে অভিভাবক শেলী রহমান (৪৩) বলেন, “করোনার জন্য শুধু নয়, এমনিতেও আমার মেয়ে (দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী) খুব বেশি বাইরে খেলে না। আমিও চাকরিতে চলে যাই, এসে দেখি বারান্দায় মনের সুখে পুতুলকে ঘুম পাড়াচ্ছে।” তবে যেহেতু স্কুল খোলা থাকলে বাচ্চাদের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়, নিজস্ব ব্যস্ততা থাকে, তাই তার মনের ওপর চাপ তুলনামূলক কম পড়ে। স্বাভাবিক গৃহবন্দী অবস্থার চেয়ে এ সময়ের বাধ্যতামূলক গৃহবন্দী অবস্থায় সেজন্য তার মানসিক প্রশান্তির জন্য খেলাধুলা আরো বেশি প্রয়োজন।
শিশু এখন খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা, মাঠ পাচ্ছে না। এমনিতে শিশুরা গৃহবন্দী, এই করোনাকালীন সময়ে শিশুরা আরো বেশি গৃহবন্দী। সেই বাস্তবতাগুলোকে মাথায় রেখেই ভিডিও গেমস ও কর্পোরেট সংস্থাগুলো শিশু মনস্তত্ত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে গেমস তৈরি করে। গেমস মার্কেটিংয়ে শিশুর চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগ হয়ে থাকে। শিশুকে আকর্ষণ করাই এদের মূল লক্ষ্য। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় টিকে থাকতে হবে এটিই অন্যতম কাজ। অস্বীকার করছি না, কোনো কোনো সময় এই গেমসগুলো শিশুর বুদ্ধিমত্তা বিকাশে সহায়ক হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো শিশুর মস্তিষ্কের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এবং ইচ্ছার তীব্রতা এতই বৃদ্ধি পায় যে সে আর তা ছাড়তে পারে না। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা একে গেমিং রোগ বলে চিহ্নিত করেছে। অনেক সময় ভিডিও গেমস শিশুর মানসিকতাকে আক্রমণাত্মক করে তোলে। কোন গেমস হেরে গেলে শিশুর মনে বিষণ্ণতা তৈরি হয়, যেখানে খেলা শুধু আনন্দের উৎস হওয়ার কথা। খেলা বিনোদনের মাধ্যম হলেও, অনেক গেমসের চরিত্রের প্রতিফলন তার মধ্যে হচ্ছে। সে হয়ে যাচ্ছে হিংস্র, কঠোর আর অসামাজিক। এছাড়া চোখে সমস্যা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি শারীরিক জটিলতা তো বৃদ্ধি পাচ্ছেই। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র পিকু বলে, “অনলাইন গেমসে কয়েন জমাতে আমার ভালো লাগে। হেরে গেলে কয়েন কাটে, তখন মন খারাপ হয়।”
আবার দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র বর্ণ। তার মা বেবী চৌধুরী(৪০) জানান, “ফোনে গেমস খেলা শুরু করলে ডাকলে সাড়া দেয় না, খেতে ডাকলে আসে না, ঘুমানোর সময় ঘুমায় না।” এ বিষয়ে বর্ণকে জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তর দেয়, সে ফোনে ‘শেডো ফাইট থ্রি’, ‘থরটাল কমব্যাট’ ইত্যাদি খেলে। এই খেলা রেখে তার আসলে মাঠে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গেও খেলতে ইচ্ছে করে না। অথচ এই খেলাগুলোর প্রত্যেকটিই সহিংসতার শিক্ষা দেয়। নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হতে বাঁধা সৃষ্টি করে। শিশুরা এই খেলাগুলোর প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে যায় যে খেলার প্রয়োজনে টাকা খরচ করে ‘ডায়মন্ড’ কেনে। তাই অনেক গবেষক একে ডিজিটাল মাদকাসক্তি বলে চিহ্নিত করেন। করোনার এই দীর্ঘ লকডাউনে ভিডিও গেমসের প্রতি আসক্তি আরো বাড়ছে। এছাড়াও শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা তো তৈরি হয়ই। তাই শিশুর ভিডিও গেমসের প্রতি ভালো লাগা যেন আসক্তিতে পরিণত না হয় তা খেয়াল রাখা উচিত।
করোনায় গৃহবন্দী শিশুর জন্য লোকক্রীড়া
লোকক্রীড়াগুলোর অধিকাংশই অতীতে সৃষ্টি হয়ে বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন, পরিমার্জন ও রূপান্তর হয়ে এখনকার এই স্থানে পৌঁছেছে। খেলাধুলা জীবন-সংস্কৃতির অংশ। খেলাধুলা মানুষের জীবনে গভীর সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
শিশুর বুদ্ধির বিকাশের শুরু ঘর থেকে, যার অনেকটাই হয় ছয় বছরের মধ্যে। আর সিংহভাগ সম্পন্ন হয় বারো বছরের মধ্যে। তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার শুরুও সেখানে। অর্থাৎ তার শারীরিক, সামাজিক ও মানসিক বিকাশ পরিবার থেকেই বেশিটা তৈরি হয়। তার মধ্যে এ সময়ে শিশুদের জন্য বাইরে যাওয়া একেবারেই বন্ধ। তাই তার সামগ্রিক দক্ষতা বিকাশের কাজটা প্রায় পুরোটাই পরিবারের হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে মানুষের দক্ষতা বলতে যে কয়েকটি গুণকে আমরা বুঝে থাকি সেগুলো হচ্ছে: সৃজনশীলতা, সূক্ষ্ম চিন্তা বা ক্রিটিক্যাল থিংকিং দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, যুক্তি প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা, সহযোগিতা/ নেতৃত্বের গুণ, কৌতূহল ও কল্পনা করার দক্ষতা, যে কোনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বা অভিযোজন ক্ষমতা।
লোকক্রীড়া মূলত বিনোদনের খোরাক। যে শিক্ষাপদ্ধতি শিশুর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তা শিশুর সহজাত গ্রহণের ক্ষমতাকে বাঁধাগ্রস্ত করে। বরং আনন্দের সঙ্গে সে অনেক কিছু শিখে ফেলে। করোনার এই বন্দী সময়ে শিশুকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে আনন্দ অত্যন্ত প্রয়োজন।
এই নির্মল বিনোদনের মাধ্যম হতে পারে লোকক্রীড়া। এ সময়ে শিশুর বিষণ্ণতা কাটাতে সাহায্য করতে পারে এসব খেলাধুলা। কিন্তু শিশুর সার্বিক শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা তৈরির জন্য তাকে ভয়বিহীন ও চাপমুক্ত রাখতে লোকক্রীড়া কতটা উপযোগী হতে পারে তা হয়তো আমরা ভাবি না। করোনায় ঘরে থেকে চর্চা করা যায় তেমন কিছু লোকক্রীড়ার উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো। যেগুলো একই সঙ্গে শিশুর শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষতার জন্য সমভাবে কার্যকরী। যেমন—
পুতুল খেলা
একে মেয়েদের খেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবে এই খেলা ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্যই প্রয়োজন। পুতুল খেলার জন্য অনেক সময় কাপড় বা মাটি দিয়ে পুতুল বানাতে হয়, আবার কখনো বাজার থেকে কিনে আনা হয়। যে শিশু পুতুল বানায়, স্বভাবতই তার মধ্যে কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতার বিকাশ হয়। যে বানায় না, সেও তার মনের মতো করে পুতুলকে সাজায়। মাটির বা কাঠের পুতুলকে রঙ-বেরঙের কাপড়ের টুকরো কেটে সাজায়। পুতুলের খাবার, বিছানা, বালিশ তৈরি করে। এই বিষয়ে চিন্তা করতে গিয়ে তার মধ্যে সৌন্দর্য্যবোধ, শিল্পবোধ তৈরি হয়। কল্পনা শক্তি বাড়ে। পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্ক বোঝার ক্ষেত্রে পুতুল খেলা অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
দড়ি লাফ
শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে মানসিক সুস্থতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই করোনাকালীন সময়ে শিশুর জন্য ব্যায়াম অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু শিশুকে তা বোঝানো কঠিন। তবে খুব কম শিশুই আছে যাকে দড়ি লাফ খেলতে বললে আপত্তি করবে। আর বাড়ির ছাদ, ব্যালকনি বা ড্রয়িং রুমে খুব সহজেই দড়ি লাফ খেলা সম্ভব। করোনাকালে ফুসফুসের সুস্থতা অত্যন্ত প্রয়োজন। শরীরের ভারসাম্য তৈরি, মনোযোগ বৃদ্ধি, শারীরিক স্থিরতা ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দড়ি লাফ খেলার কোনো বিকল্প নেই।
বাঘবন্দী খেলা
ঘর বা ছক তৈরি করে এ খেলা করা হয়। ঘরে বসেই এই খেলার চর্চা করা সম্ভব। সাধারণত দুজনে এই খেলা হয়ে থেকে। বাঘবন্দী খেলায় মূলত শিকারের কৌশল রয়েছে, ঘুঁটির চাল দিয়ে বাঘবন্দী করা হয়। এই খেলা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে খেলতে হয়। এর সঙ্গে দাবার কিছুটা মিল রয়েছে। খেলাটি বেশ জটিল। একই রকম আরেকটি খেলা আছে, যার নাম ষোল ঘুঁটি। এই খেলাগুলো খেলতে বুদ্ধিদীপ্ত হওয়া প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলা যায় এই খেলার মাধ্যমে শিশু ক্রিটিক্যাল থিংকিং বা সূক্ষ্ম চিন্তা করতে শেখে। সেই সঙ্গে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা অর্জন করে এবং স্থির বুদ্ধি ছাড়া যেহেতু এই খেলা সম্ভব নয়, তাই তার মধ্যে মনোযোগ ও স্থিরতা বৃদ্ধি পায়।
চোর-পুলিশ খেলা
চার বা পাঁচজনের পরিবারে খুবই প্রচলিত একটি খেলা হতে পারে। এটি নিছকই বিনোদন। কয়েক টুকরো কাগজ এ খেলার সামগ্রী। এ খেলা একেক অঞ্চলে একেক নিয়মে হয়। বেশিরভাগ লোকক্রীড়ার ক্ষেত্রেই প্রয়োজন ও স্থান অনুযায়ী নিয়ম বদলানোর সুযোগ থাকে। প্রায়ই শিশুরা নিজে থেকেই নিয়ম-কানুন তৈরি করে যা পরবর্তীতে যে কোনো সময় কাজে লাগে। এই গৃহবন্দী সময়ে নির্মল বিনোদন ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য এ খেলা অনন্য।
রান্না-বাটি খেলা
এ খেলাটি নিয়ে গুগল দুনিয়ায় অসংখ্য গেমসের বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়, যা লোকক্রীড়া রান্না-বাটির রূপান্তরিত রূপ। অথচ অনলাইন ভিত্তিক সেসব গেমসে শিশুর মস্তিষ্কপ্রসূত কিছুই থাকে না। তাকে যে নিয়ম কানুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাই সে করতে থাকে। অথচ রান্না-বাটি খেলায় শিশু নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে পাতা দিয়ে সবজি, ইটের টুকরো দিয়ে মাংস রান্নাসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ড করে থাকে। এতে তার কল্পনা শক্তি আর সৃজনশীলতা দুই বৃদ্ধি পায়। তাই অনলাইন কুকিং গেমসের চাইতে রান্না-বাটি খেলা সব দিক থেকেই বেশ কার্যকরী ও সহজ।
লুডু খেলা
লুডু বোর্ড, লুডু ঘুঁটি, একটি ছক্কা আর ছোট একটি কৌটা দিয়ে লুডু খেলা হয়ে থাকে। এ দেশে সাধারণত সাপ লুডু ও ঘর লুডু খেলা হয়। এ দেশের বহুল জনপ্রিয় খেলার মধ্যে এটি একটি। গ্রাম বা মফস্বল দুই জায়গাতেই এ খেলা তুমুল জনপ্রিয়। লোকক্রীড়াগুলোর মধ্যে এখনো সবচেয়ে জীবন্ত এই খেলাটি। এই খেলা দিয়ে বুদ্ধিমত্তা ও সূক্ষ্ম চিন্তার চর্চা হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তুলনায় একজন শিশুর মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা প্রায় আড়াইগুণ বেশি। তাই এ ধরনের খেলার মাধ্যমে সে খুব সহজে সংখ্যার ধারণা লাভ করতে পারে। এই খেলার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে অনলাইনে লুডু কিং বা লুডু স্টারের মতো অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এ খেলায় বুঁদ হয়ে থাকে। এটি যান্ত্রিক উৎকর্ষতার সময়ে লোকক্রীড়ার অনলাইন রূপান্তর মাত্র। তবে এ খেলার অনলাইন ভার্সনে বিশ্বের অনেক দেশের গেমারকে দেখা যায়। তাই বলা যায়, এই খেলা বিশ্বের অনেক দেশের ঐতিহ্য। তবে অনলাইন ভার্সনের খেলাটিতে নিয়ম কানুন নির্দিষ্ট থাকে। চাইলেও এর বাইরে যাওয়া যায় না। কিন্তু কাগজের লুডুতে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রায়ই নিয়ম পরিবর্তন করতে দেখা যায়। তাতে শিশুর উপস্থিত বুদ্ধি চর্চিত হয়।
ঘুড়ি ওড়ানো
করোনাকালীন এই লকডাউনে সবচেয়ে বেশি যে লোকক্রীড়াটি ফিরে এসেছে তা হলো ঘুড়ি ওড়ানো। নেত্রকোনা, টাঙ্গাইলসহ দেশের প্রায় সব অঞ্চলে বিকাল-সন্ধ্যার আকাশে যেন ঘুড়ির মেলা বসছে। শিশুরা এমনকি কিশোর-যুবকরাও সারাদিন ধরে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি বানিয়ে বিকালে ঘুড়ির লড়াইয়ে মেতে উঠছে। বাড়ির ছাদগুলো এই খেলার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। করোনাকালীন সময়ে ঘুড়ি কেনাবেচার ধুম লেগেছে। এছাড়া শিশুরা নিজেই তৈরি করছে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি। নেত্রকোনা জেলার প্রতিটি মহল্লায় লাল, নীল, সবুজ, বেগুনী কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনে ঘুড়ি বানানো হচ্ছে। শিশুদের শৈল্পিক মন ও সৃজনশীলতা দুটোই এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘুড়িগুলো কোনো নির্দিষ্ট ডিজাইনে তৈরি হচ্ছে না। যে যার কল্পনা আর সৃজনশীল দক্ষতা দিয়ে তৈরি করছে। প্রতিযোগিতা হচ্ছে কার ঘুড়ি কত সুন্দর তা নিয়ে। রাতের আকাশে ওড়ানোর জন্য ঘুড়ির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে রঙ-বেরঙের ছোট ছোট লাইট। সেই কাজটিও শিশুরা নিজেরাই করছে। ঘুড়ি তৈরি ও তা উড়িয়ে ঘুড়ির লড়াইয়ের বিনোদন ও সৌন্দর্য্যের সুস্থ প্রতিযোগিতা এই করোনাকালীন সময়ে অনেক শিশুর নিত্যদিনের অনুষঙ্গ।
উল্লিখিত খেলাগুলো ছাড়াও লাটিম খেলা, মার্বেলসহ আরো অনেক লোকক্রীড়ায় শিশুর গৃহবন্দী সময় আরও সুন্দর করা সম্ভব।
দুনিয়া বদলাচ্ছে। পুঁজির প্রতিযোগিতা বাড়ছে, মানুষকে পণ্য বানাচ্ছে পুঁজিবাদ। গৃহবন্দী জীবন ব্যবস্থায় শিশুর মনোজগত খেলার মাঠের চেয়ে অনেক বেশি দখল করে নিচ্ছে ভিডিও গেমস। একটি ভিডিও গেমসের লিংকে ক্লিক করলে আরও দশটির আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন আসছে। সেই বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিচ্ছে শিশু। আটারি, সেগ, সনির মতো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপনী প্রচারণার মাধ্যমে গেমসকে বিনোদন পণ্য হিসেবে পৌঁছে দিচ্ছে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। গৃহবন্দী একা শিশু আরো বেশি একা হচ্ছে, মানসিক অবসন্নতা ও বিষণ্ণতায় ভুগছে। অথচ লোকক্রীড়াগুলো কোনোরকম ক্ষতিকারক প্রভাব ছাড়াই সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম হতে পারে। একক পরিবার সংস্কৃতিতে এই সময়ে শিশুর সঙ্গে অনেক সহজ সম্পর্ক হওয়া উচিত বাবা-মায়ের। গৃহে খেলা যায় এমন লোকক্রীড়াগুলো পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেললে শিশুর একাকিত্ব, হতাশা দূর হতে পারে। মানসিক নানা দক্ষতা এবং সুস্থ সামাজিকীকরণ তৈরি হতে পারে। তাই শুধুমাত্র দেশীয় সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে নয় বরং শিশু ও সমাজ মননের সুস্থ কার্যকারিতার জন্যই লোকক্রীড়া চর্চা করা প্রয়োজন। অন্তত করোনাকালীন এই বন্দী দশায় মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য এই চর্চার বিকল্প নেই।