গাজা সংঘাতে স্ত্রী-সন্তানসহ ১০৩ স্বজনের মৃত্যু, খুঁজছেন মরদেহ
গাজা উপত্যকার এক অসহায় বাবা আহমাদ আল-গুফেরি। তিন মেয়ে তালা, লানা ও নাজলা ও স্ত্রী শিরিনকে নিয়ে তার ছোট্ট পরিবার ছিল। ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) এক বোমা হামলাতেই ধ্বংস হয়ে যায় সব। বহুদিন ইসরায়েলের সামরিক বাধায় আটকে থেকে অবশেষে ফিরলেন সেই প্রাণহীন বাড়িতে; উদ্ধার করছেন নিখোঁজ স্বজনের মরদেহ।
তেল আবিবের একটি নির্মাণ সাইটে কাজ করতেন আহমাদ। ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরুর সময়েও সেখানেই অবস্থান করছিলেন তিনি। ইসরায়েলের সামরিক অবরোধের কারণে তার স্ত্রী এবং তিন কন্যার কাছে ফিরে যেতে পারেনি। এরই মধ্যে সব শেষ। রেখে যাওয়া বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ; স্বপ্নভঙ্গের মতো ভেঙ্গে গেছে সাজানো সংসার। হারিয়েছেন শতাধিক আত্মীয়-স্বজন।
গাজা শহরের জেইতুন পাড়ার সাহাবা মেডিকেল সেন্টারের কোণে চার তলা ভবনটিতেই শেষবার পরিবারকে দেখেছিলেন। পরিবার থেকে ৫০ মাইল (৮০ কিলোমিটার) দূরে জেরিকোর দখলকৃত পশ্চিম তীরের শহরে আটকে পড়েছিলেন তিনি। এদিকে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) হামলায় পরিবারের সকল সদস্যসহ তার অন্তত ১০৩ জন আত্মীয় নিহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘গাজায় আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। আমি কার জন্য ফিরে যাব? কে আমাকে বাবা বলে ডাকবে? কে আমাকে প্রিয়তম বলে ডাকবে?’
আহমাদের সবচেয়ে ছোট মেয়ে নাজলার জন্মদিন ছিল গত সপ্তাহে। বেঁচে থাকলে শিশুটি দুই বছরে পা রাখত।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আহমাদ বলেন, ‘আমার মেয়েরা ছিল ছোট্ট পাখির মতো। আমার এখনো মনে হয়, আমি একটি দুঃস্বপ্ন দেখছি। আমার জীবনে যা ঘটে গেল, তা আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।’
সন্তানদের ছবি দেখলেই মুষড়ে পড়েন আহমাদ। কিছুতেই তিনি শোক সামাল দিতে পারছেন না। মর্মযাতনা থেকে বাঁচতে তিনি সন্তানদের ছবি মুঠোফোন ও ল্যাপটপের পর্দা থেকে সরিয়ে ফেলেছেন। এরপরও স্ত্রী-সন্তান-স্বজন হারানোর শোক তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
গাজা শহরের হামলা আহমাদ আল-গুফেরির পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের পরিবার থেকে ৫০ মাইল (৮০ কিলোমিটার) দূরে জেরিকোর দখলকৃত পশ্চিম তীরের শহরে আটকে পড়েছিলেন আহমাদ।
৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হামলার ঠিক আগমুহুর্তে তার স্ত্রী শিরিনের সাথে ফোনে কথা বলছিলেন আহমাদ। তিনি বলেন, ‘সে আমাকে বলেছিল তাকে যেন ক্ষমা করে দিই। সে যেন জেনে গিয়েছিল আর দেখা হবেনা আমাদের। আমি তাকে বলেছিলাম যে এটি বলার দরকার নেই। এবং এটি ছিল আমাদের মধ্যে শেষ কথোপকথন। সেই সন্ধ্যাতেই একটি বড় বোমা হামলায় আমার স্ত্রী এবং তিন কন্যা - তালা, লানা এবং নাজলা নিহত হয়। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমার চাচার চারতলা বাড়ির ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান চক্কর দিচ্ছিল বলে আমার স্ত্রী জানায়।’
এতে আহমাদের মা, তার চার ভাই এবং তাদের পরিবার, সেইসাথে তার কয়েকজন খালা, চাচা এবং চাচাত ভাইকেও হত্যা করা হয়। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা শতাধিক। দুই মাস পার হয়ে গেলেও ধ্বংসস্তূপের নিচে তাদের কিছু মরদেহ এখনও আটকে আছে।
আহমাদের জীবিত আত্মীয়দের একজন হামিদ আল-গুফেরি বিবিসিকে বলেছেন, ‘হামলা শুরুর সাথে সাথে যারা পাহাড়ে পালিয়ে গিয়েছিল তারা বেঁচে গিয়েছিল এবং যারা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা নিহত হয়েছে। এটি একটি ফায়ার-বেল্ট ছিল। আমাদের পাশের চারটি বাড়িতে হামলা হয়েছে। প্রতি ১০ মিনিট অন্তর তারা একটি বাড়িতে আঘাত করে।’
তিনি বলেন, গুফেরি পরিবারের ১১০ জন লোক সেখানে ছিল। গুটিকয়েক ব্যতীত সবাই মারা গেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক ছিলেন ৯৮ বছর বয়সী দাদী এবং সবচেয়ে কম বয়সী ছিল মাত্র নয় দিন আগে জন্ম নেওয়া একটি শিশু ছেলে।
আহমাদ বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছি। এদের মধ্যে আমার ভাইয়ের স্ত্রী এবং আমার ভাগ্নে মোহাম্মদ রয়েছে। এদেরকে টুকরো টুকরো করে বের করা আনা হয়েছে। তাদের মরদেহ ৭৫ দিন ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে ছিল।’
আহমাদের পরিবারকে হত্যার ঠিক আগের দিন এবং পরের দিনগুলিতে আল-গুফেরি বাড়ির দক্ষিণে কয়েক ব্লকের শেজাইয়া এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনী এবং হামাসের বন্দুকধারীদের মধ্যে তীব্র লড়াই হয়েছিল।