ক্লিনটন হত্যাচেষ্টার যে ঘটনা গোপন করা হয়েছিল

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৬ সালের ২৩ নভেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন এবং ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন এয়ার ফোর্স ওয়ান এ চড়ে ম্যানিলায় যাচ্ছিলেন। তাদের ইউএস সিক্রেট সার্ভিস বিশদ উদ্বেগজনক বলে তথ্য পায় গোয়েন্দা সংস্থা। জানতে পারে, ফিলিপাইনের মোটরকেডের রুটে একটি বিস্ফোরক ডিভাইস লাগানো হয়েছে। বিকল্প পথ ধরে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বার্ষিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্মেলনে পৌঁছান বিল ক্লিনটন। অন্যদিকে ফিলিপিনো নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মোটরশেডটি ক্রল করার সাথে সাথে ব্রিজের উপর একটি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করে। বোমার সাথে ছিল একটি এসইউভি ও একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেল।

সে যাত্রায় বিল ক্লিনটন প্রাণে বেঁচে গেলেও আল কায়দার সন্দেহভাজন এই হামলার তথ্য প্রকাশিত হয়নি কোনো গণমাধ্যমে। রয়টার্সকে সেসব অজানা তথ্য জানিয়েছেন চারজন অবসরপ্রাপ্ত এজেন্ট। রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দেওয়া এসব সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা ম্যানিলা ঘটনার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন যা অনেক বছর ধরেই ছিল অজানা।

বিজ্ঞাপন

প্রেসিডেন্টকে হত্যার প্রচেষ্টা সেসময় ব্যর্থ করে এজেন্টরা ক্লিনটনকে হোটেলে একটি ব্যাক-আপ রুটে স্যুইচ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলার প্রচেষ্টা হিসেবে গুপ্তহত্যার পথই বেছে নিত আল কায়েদা। ২০১০ এবং ২০১৯ সালে প্রকাশিত বইগুলোতেও সংক্ষিপ্তভাবে এসব কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। 

রয়টার্সকে সেই ব্যর্থ হত্যা চক্রান্তের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন আটজন অবসরপ্রাপ্ত সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট- যাদের মধ্যে সাতজন সেসময় ম্যানিলায় ছিলেন। তবে ক্লিনটনের হত্যা চেষ্টার বিষয়ে মার্কিন সরকারের তদন্তের কোনো প্রমাণ পায়নি রয়টার্স। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শ্রেণীবদ্ধ তদন্ত পরিচালনা করেছে কিনা তাও বার্তাসংস্থা স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করতে পারেনি।

বিজ্ঞাপন

ম্যানিলার লিড সিক্রেট সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট এবং প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে কথা বলা সাতজন এজেন্টের একজন গ্রেগরি গ্লোড। তিনি বলেছেন, ‘আমি সবসময় ভাবতাম আমাকে কেন কোনো তদন্তের জন্য ম্যানিলায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। এর পরিবর্তে ক্লিনটন চলে যাওয়ার পরের দিন তারা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।’

তখন এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল বলে স্বীকার করেন সিক্রেট সার্ভিসের মুখপাত্র অ্যান্টনি গুগলিয়েলমি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে কি ব্যবস্থা নিয়েছিল বা ব্যবস্থা নিয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। ক্লিনটন তার মুখপাত্র এবং ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছানোর একাধিক প্রচেষ্টায় সাড়া দেননি।

সাবেক সিআইএ ডিরেক্টর লিওন প্যানেটা, যিনি সেই সময়ে ক্লিনটনের চিফ অফ স্টাফ ছিলেন। তিনি বলেন, তিনি এই ঘটনা সম্পর্কে অবগত নন। তবে একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যার চেষ্টার তদন্ত হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, ‘একজন সাবেক চিফ অফ স্টাফ হিসেবে, কেউ এই তথ্যটি অপ্রকাশ্য রেখেছিল কিনা এবং এমন ঘটনায় যাদের সচেতন হওয়া উচিত ছিল তাদের নজরে আনেনি কেন তা খুঁজে বের করতে আমি খুব আগ্রহী হব।’

ম্যানিলায় তৎকালীন রাষ্ট্রদূত থমাস হাবার্ডসহ চার প্রাক্তন মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে হামলা ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে তারা মার্কিন তদন্ত বা ফলোআপ পদক্ষেপ সম্পর্কেও অবগত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন।

গ্রেগরি গ্লোড বলেন, একটি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়নে দেখা যায়, বিন লাদেনের নির্দেশে আল-কায়েদা অপারেটর এবং আবু সায়াফ গ্রুপ, ফিলিপিনো ইসলামপন্থীরা ব্যাপকভাবে একটি প্লট তৈরি করেছিল। তবে সিআইএ সংস্থার পরিচয় দিতে বা এই বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।

২০২২ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের রিপোর্ট অনুসারে, গ্রুপটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে, এর মাত্র কয়েকজন নেতা এখনও বেঁচে আছেন। ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, পররাষ্ট্র দপ্তর এবং জাতীয় পুলিশ এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি।

১৯৮৬ সালের একটি আইনে বলা হয়, কোনো বিদেশী চরমপন্থী সংগঠনের পক্ষে মার্কিন নাগরিককে হত্যার চেষ্টা করা অপরাধ। প্রসিকিউশনের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে অনুমোদনের প্রয়োজন হবে বলে ১৯৯৬ সালে প্রয়াত জ্যানেট রেনো একটি এফবিআই তদন্ত শুরু করে। তবে ম্যানিলা হত্যা প্রচেষ্টার বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায় এফবিআই।

রয়টার্সের সাথে কথা বলা সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের চারজন উল্লেখ করেন, সেদিন ম্যানিলায় উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলার প্রধান বোমা হামলাকারী রামজি ইউসুফ। ১৯৯৩ সালের সেই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার হামলার উপদেশদাতা ও বিনিয়োগকারী এবং ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পরিকল্পনাকারী খালিদ শেখ মোহাম্মদের ভাতিজা রামজি ইউসুফ। ১৯৯৪ সাল থেকে  ক্লিনটনের সফরের কয়েকদিন আগ পর্যন্ত তিনি আবু সায়াফ জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ইউসুফ কলোরাডোর একটি ফেডারেল সুপারম্যাক্স কারাগারে বর্তমানে যাবজ্জীবন সাজা (২৪০ বছর সাজা) ভোগ করছেন।

১৯৯৫ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর ইউসুফের প্রথম সাক্ষাৎকার এফবিআই স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ম্যানিলার সাইটগুলো জরিপ করে দেখা যায়, মোটরকেডের রুট বরাবর একটি স্থানে একটি ইম্প্রোভাইজড বিস্ফোরক ডিভাইস রাখার কথা ভাবে ইউসুফ। খুব বেশি নিরাপত্তা এবং আক্রমণের পর্যাপ্ত সময় না থাকার কারণে ওই হামলা ব্যর্থ হয়।

তিনজন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট বলেন, ১৯৯৬ সালের হামলার জন্য ইউসুফ প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে তারা বিশ্বাস করেন।

ইউসুফের আইনজীবী বার্নার্ড ক্লেইনম্যান রয়টার্সকে বলেন, ক্লিনটনের বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার জন্য ইউসুফ ১৯৯৪ সালে ম্যানিলায় ছিলেন। 

তিন এজেন্ট স্মরণ করেন, সিক্রেট সার্ভিসের নিরাপত্তা দলের অস্থিরতার একটি কারণ হতে পারে আল কায়েদা এবং ইউসুফের দ্বারা সৃষ্ট হুমকি। সে সময় তারা ফিলিপাইন কমিউনিস্ট এবং ইসলামপন্থী বিদ্রোহের সাথে লড়াই করছিল বলে এই হুমকি বাড়তে থাকে বলে মনে করেন তারা। 

কি ঘটেছিল সেদিন?

ক্লিনটনের আসার বেশ কয়েক দিন আগে ম্যানিলা বিমানবন্দরে একটি বোমা এবং সুবিক বে-র শীর্ষ সম্মেলন কেন্দ্রে আরেকটি বোমা আবিষ্কার করে পুলিশ। তাই ম্যানিলায় যাওয়ার আগের দিন মার্কিন কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে হুমকির বিষয়ে সতর্ক করেছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।

টপ-সিক্রেট প্রেসিডেন্টের বিব্রতিতে সেদিন সফরের আগেই ক্লিনটনের জন্য সম্ভাব্য বিপদগুলো হাইলাইট করা হয়েছিল। একজন সামরিক সহযোগীর মতে, অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন বিমান বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল রবার্ট প্যাটারসন ক্লিনটনের সফরে সঙ্গী ছিলেন।

ক্লিনটন যখন ম্যানিলায় আসেন তখন সন্ধ্যা। এয়ার ফোর্স ওয়ান নেমে আসার সাথে সাথে, সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট ড্যানিয়েল লুইস ম্যানিলা হোটেলের প্রধান রুটে একটি ব্রিজের উপর একটি ডিভাইস সম্পর্কে বিমানবন্দরের সিক্রেট সার্ভিস টিমের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আসে।

ক্লিনটনের প্রতিরক্ষামূলক বিবরণের নেতৃত্ব দেওয়ার পর সিক্রেট সার্ভিসের পরিচালক হয়েছিলেন লুইস মেরলেটি। তিনি বলেন, তিনি মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তার কলের পরে একই সতর্কবার্তা প্রকাশ করছিলেন নাম না জানা অচেনা একজন। ‘সেতু জুড়ে বিবাহ’ উল্লেখ করে তিনি যাতায়াতে বাধা দেন।

তিনি বলেন, তখন তিনি বেশ কয়েক বছর আগের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কথা স্মরণ করেন যারা বিবাহকে ‘হত্যার জন্য সন্ত্রাসী কোড’ হিসেবে চিহ্নিত করে। পরিকল্পিত মোটরশেডের রুটটি ক্লিনটনের হোটেলের প্রধান রুটে তিনটি সেতু দেখায়। এরপরেই আমরা রুট পরিবর্তন করেছি।

মের্লেটি, লুইস এবং গ্লোড বলেন, ক্লিনটনের উদ্দেশ্যে রাখা বোমাটি মূল রুট বরাবর একটি সেতুর একটি বৈদ্যুতিক বাক্সের উপরে পাওয়া গিয়েছিল। 

রয়টার্সের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ক্লিনটনের আগমনের সময় বোমা নিষ্ক্রিয়করণ বিশেষজ্ঞরা একটি ব্রিজের ওপর একটি বৈদ্যুতিক বাক্সের পাশে একটি বিস্ফোরক বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছেন এবং বাক্সের উপরে কোন বোমা দেখা যাচ্ছে না।

ফিলিপিনো নিরাপত্তা কর্মীরা সেতুর শেষ প্রান্তে পরিত্যক্ত একটি লাল মিতসুবিশি পাজেরোও উদ্ধার করেছে বলে জানিয়েছেন এজেন্টরা। তারা বলেছেন, ভিতরে পাওয়া একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেলগুলো থেকে বোঝা যায়, হামলাকারীরা গাড়ির সাথে স্প্যানটি আটকে দেওয়ার এবং মোটরকেডে আগুন দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।

পরের দিন সকালে, গ্লোড এবং মেরলেটি বলেন, মার্কিন দূতাবাসের একজন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাদের প্লট সম্পর্কে ব্রিফ করেছিলেন এবং ডিভাইসের ছবি দেখিয়েছিলেন। এটি একটি বর্ম-ছিদ্রকারী রাইফেল-চালিত গ্রেনেড ছিল। একটি বাক্সের উপরে টিএনটি যুক্ত নকিয়া ফোনে একটি ডেটোনেটর হিসাবে স্থাপন করা হয়েছিল এটি। ম্যানিলা গ্রাউন্ড টিমের দায়িত্বে থাকা এজেন্ট লুইস এবং ক্রেগ উলমার বলেছেন, তারাও পরে ছবিগুলো দেখেছেন।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত সন্ত্রাসবাদ বিশ্লেষক ডেনিস প্লুচিনস্কি ২০২০ সালের মার্কিন-বিরোধী ইতিহাসের গবেষণা করার সময় এ চক্রান্ত সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। 

১৯৯৫ সালে ক্লিনটন প্রেসিডেন্সিয়াল ডিসিশন ডাইরেক্টিভ ৩৯ জারি করে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে সকল সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধ করার এবং দায়ী ব্যক্তিদের ‘গ্রেফতার ও বিচার’ জোরালোভাবে করার প্রতিশ্রুতি দেন।

১৯৯৮ সালের আগস্টে কেনিয়া এবং তানজানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসগুলোতে আল কায়েদার বোমা হামলায় ২২০ জন মারা যাওয়ার পরেও ক্লিনটন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা হামলার পরিকল্পনা করা থেকে লাদেনকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর ১৩ বছর পরের বর্তমান আল কায়েদা অনেকটাই কম শক্তিধর সংগঠন। কিন্তু ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল হামলার ঘটনা নতুন অনুসারীদের দলে ভিড়ানোর প্রচেষ্টাকে বাড়াতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবেদনটিতে।

সূত্র: রয়টার্স, অনুবাদক: আসমা ইসলাম