সোলাইমানিকে হত্যা করে পথের কাঁটা সরাল যুক্তরাষ্ট্র
ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষস্থানে ছিলেন কাসিম সোলাইমানি। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি কুদস সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। এছাড়াও তিনি মধ্যপ্রাচ্যে দেশের বিভিন্ন কার্যক্রমের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। দেশের শান্তি ও যুদ্ধের সময়গুলোতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদের পক্ষে যুদ্ধ, ইরাকে ইরানপন্থীদের উত্থান, ইসলামিক স্টেট গ্রুপের বিরুদ্ধে লড়াই এবং এর বাইরেও অনেক লড়াইয়ে তিনি মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ছিলেন।
সহজাত দক্ষতা সম্পন্ন এবং অধরা কমান্ডার হিসেবে পরিচিত এই কাসিম সোলাইমানিকে অনেকেই সম্মান করতেন। আবার অনেকেই তাকে ঘৃণা করতেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ ছবিও প্রকাশ হয়েছে।
তবে দিনকে দিন ইরানের প্রতিবেদন, ডকুমেন্টরি এমনকি বিভিন্ন গানের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
তাকে নিয়ে ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র অফিসার জন মাগুয়ের বলেছিলেন, ‘কাসিম মধ্যপ্রাচ্যের একক শক্তিশালী ব্যক্তি।’
তবে সবকিছুই যেন হঠাৎ করে এলোমেলো হয়ে গেছে। কাসিমের শেষটা পুরোপুরি হিংসাত্মক ছিল, যখন জানা গেল শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাসিম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে।
ইরাকের একটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মার্কিন সামরিক ঠিকাদারের মৃত্যুর পরেই এই হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। আর এই হামলার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরান এবং ইরাক সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্পর্ক খুব বাজেভাবে নষ্ট হয়। আর ওই হামলার জন্য আমেরিকা সরাসরি ইরানকে দায়ী করে।
দায়ী করে অবশ্য চুপ থাকেনি ট্রাম্প প্রশাসন। প্রতিশোধ নিতে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া খাতাব হিজবুল্লাহর ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এরপরে অবশ্য মিলিশিয়া সমর্থকরা বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায়।
আমেরিকা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশ রোধে ইরানকে চাপ প্রয়োগ করছিল। এই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে অনেকদিন ধরেই উত্তেজনা বাড়ছিল। সেই সঙ্গে ইরানের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি করে যা ইরানের অর্থনীতিতে সরাসরি আঘাত হানে। তবে ইরান আমেরিকার এসব নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করেনি।
মিলিশিয়ানদের উথান
ধারণা করা হয় যে, সোলাইমানি খুব দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতাও তেমন নেই। তবে তিনি ইরানের অভিজাত ও সবচেয়ে শক্তিশালী বিপ্লবীদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছিলেন এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
১৯৯৮ সালে কুদস ফোর্সের কমান্ডার হওয়ার পরে, সোলাইমানি গোপনীয় অভিযান পরিচালনা, মিত্রদের অস্ত্র সরবরাহ এবং ইরানের অনুগত মিলিশিয়াদের নেটওয়ার্ক বিকাশের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব প্রসারিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
তিনি ইরাকের শিয়া মুসলিম ও কুর্দি গোষ্ঠীগুলোর সহায়তাকারী হিসেবে সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হুসেনের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছেন। পাশাপাশি লেবাননের শিয়া জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসলামি সংগঠন হামাসসহ এই অঞ্চলের অন্যান্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
২০০৩ সালে আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমণ করে তখন তিনি জঙ্গিগোষ্ঠীদের মার্কিন সেনা ও তাদের ঘাঁটির ওপর হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। এতে শতাধিক সেনা নিহত হয়।
২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করার পরে তিনি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে মার্কিন সেনা ও ঘাঁটির বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর নির্দেশনা দেওয়া শুরু করে এবং শতাধিক মার্কিন সেনাকে হত্যা করে।
২০১১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যেই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল সেখানে রাশিয়ার বিমান বাহিনী ও ইরানের সহায়তায় সেই জোয়ার বদলাতে তিনি দারুণ ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে ওই বিদ্রোহ সরকারের অনুকূলে আসতে থাকে এবং মূল শহরগুলো পুনরায় দখল করতে সক্ষম হয় বাশার সরকার।
পতনের শুরু
গত বছরের এপ্রিল মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পে ইরানের বিপ্লবী গার্ডস এবং কুদস ফোর্সকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেন।
এ বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন বলেন, কুদস ফোর্স মধ্য প্রাচ্যের মার্কিন মনোনীত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে তহবিল, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র এবং সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিল যেখানে হিজবুল্লাহ আন্দোলন এবং গাজায় অবস্থিত ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদগোষ্ঠীর মতো জঙ্গি সংগঠন ছিল।
এদিকে, এক বিবৃতিতে পেন্টাগন বলেছে যে, সোলাইমানি ইরাকের অঞ্চলজুড়ে আমেরিকান কূটনীতিক এবং বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সদস্যদের আক্রমণ করার জন্য সক্রিয়ভাবে পরিকল্পনা তৈরি করছিলেন।
‘জেনারেল সোলাইমানি এবং তার কুদস ফোর্স কয়েকশো আমেরিকান ও জোট বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুর জন্য এবং আরও কয়েক হাজার আহত হওয়ার জন্য দায়ী ছিলেন।’