প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়ে গেল, এরপর! কীভাবে পাব সবাই?
মহামারি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে পারে— এমন প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে গোটা দুনিয়া। ধরুন, এই মুহূর্তে প্রতিষেধক আবিষ্কারও হয়ে গেলো— এরপর! কীভাবে পাব আমরা সবাই? সেটাতো আমার, আপনার— সবারই প্রয়োজন। কীভাবে পৌঁছাবে আমাদের কাছে?
সময়টা ২০০৬ সালের ডিসেম্বর। ইন্দোনেশিয়ান কর্তৃপক্ষ বার্ড ফ্লু ভাইরাসের নমুনা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। তারা শর্ত জুড়ে দেয়, এক প্রকার গ্যারান্টি দিয়েই বলে, তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিনটি অন্য সব ভ্যাকসিন থেকে বেশি কার্যকরী হবে।
এরপর আসা যাক ২০০৯ সালে। যখন সোয়াইন ফ্লু মহামারি আকার ধারণ করেছে। অস্ট্রেলিয়া সরকার একটি ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেয়, বিশ্বব্যাপী চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন পরিমাণ ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে।
সে বছরের নভেম্বরে বেশিরভাগ ধনী দেশগুলো ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করতে থাকে। পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কর্মকর্তারা সামনে দুর্যোগ আসতে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ডব্লিউএইচও’র তৎকালীন প্রধান মেরি পাওল কেইনি বলেছিলেন, যদি মহামারি আরও খারাপ আকার ধারণ করতে থাকে, তাহলে খুব দ্রুতই ভ্যাকসিন বিতরণে অব্যবস্থাপনা আরও প্রকট হবে। এমনকি যে ভ্যাকসিন আছে, সেগুলোও দিতে চাইবে না কেউ।
এখন আসা যাক করোনাভাইরাস মহামারিতে। করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় একমাত্র সমাধান হল ভ্যাকসিন। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু করেছে। অপেক্ষা, এটি মানবদেহে করোনার বিরুদ্ধে লড়তে কার্যকর কি না দেখার আর অনুমোদনের। এসবের মধ্যে যে বিষয়টি আশঙ্কা করা হচ্ছে তা হলো— ‘ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজম’।
একটি ভ্যাকসিন তৈরি, পরীক্ষা ও র্যাপিডলি (ব্যাপকহারে) উৎপাদন প্রতিটি পদক্ষেপই মহাকাব্যিক চ্যালেঞ্জ। এরপর আসে বণ্টনব্যবস্থা ঘিরে রাজনৈতিক ও নৈতিক সিদ্ধান্তগুলো। ইতোমধ্যে উঠে এসেছে যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাম। কে কাকে ছেড়ে সামনের কাতারে পৌঁছাবে, সেই প্রতিযোগিতা।
জার্মান, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র— কোন দেশটি পাবে ভ্যাকসিন তৈরির অনুমোদন? কে নেবে এই সিদ্ধান্ত? শেষমেশ কে নিলাম ডাকবে? ধনী দেশগুলো কি ইতোমধ্যে সম্ভাব্য ভ্যাকসিন কিনতে শুরু করেছে? এখানে সরকার কী করতে পারে? এভাবে ভ্যাকসিন দখল করা বন্ধ করা কি আদৌও সম্ভব?
এসব প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন কার্যকর— এটা প্রমাণিত হওয়ার পর থেকেই হিসাব করলে কমপক্ষে এক বছর সময় লেগে যাবে বিশ্বের সবত্র এটি পৌঁছাতে। যদি সবকিছু ঠিক থাকে তাহলে কমপক্ষে ধাপে ধাপে এগোতে প্রয়োজন ১২ মাস সময়ের।
কানাডার ইবোলা ভ্যাকসিন তৈরির একটি দলের সদস্য স্টিভেন জোন্স বলেছেন, আসলে প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রক্রিয়া নেই। অর্থাৎ, কী উপায়ে সবার কাছে এটি পৌঁছাবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই।
সম্প্রতি দাতব্য সংস্থা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরাসহ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেল ও সমাজসেবী মেলিন্ডা গেটস বিশ্বব্যাপী করোনা চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন সমানভাবে বণ্টন নিশ্চিতে ডব্লিউএইচও’র উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাবও সর্মথন জানান। তবে এখানে যাদের নাম আসেনি, তারা হলেন— যুক্তরাষ্ট্র, ইন্ডিয়া, চীন ও রাশিয়া।
যখন গোটা বিশ্ব সংকটে, তখন অবশ্যই আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ওয়েলকাম ট্রাস্ট্রের ভ্যাকসিন বিভাগের প্রধান চারলি অয়েলার বলেন, আমরা বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির কথা বলছি। কিন্তু এসব ভ্যাকসিন কীভাবে আমরা সবদেশে পৌঁছে দেবো, তার কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ পাইনি।
ভ্যাকসিন কীভাবে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা যায়, সেজন্য বেশকিছু সংস্থা প্রস্তুত করা হচ্ছে। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গাভি’, যেটি মূলত দরিদ্র দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহে কাজ করে, এই সংস্থাসহ কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপারেশন ইনোভেশন কাজ করছে, যা যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে চলে।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভ্যাকসিন বিভাগের প্রাক্তন পরিচালক ডেভিড স্যালসবারি বলেছেন, আপনি কি ভাবতে পারেন, ডব্লিউএইচও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেছে— আপনি যে পরিমাণ ভ্যাকসিন চান, তার কেবল দশ ভাগের এক ভাগ থাকতে পারে। এরপর ট্রাম্প অবশ্যই আমেরিকাতে ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম কে তার চেষ্টা করেছেন। তিনি এরপর যখন যথেষ্ট পরিমাণে ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে পারবেন তখন নিশ্চয় ওই ভ্যাকসিনটি ছাড়তে রাজি হবেন না।
স্টিভেন জোন্সও এ বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ডব্লিউএইচও এই নেতৃত্বে ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তবে তারা একটি কঠিন পরিস্থিতিতে রয়েছে। তারা নৈতিকতার দিক দিয়ে একটি নির্দেশিকা প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীরা তাদের তৈরি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিতে চাপ দিচ্ছেন। এমনকি ভ্যাকসিন তৈরি করেও যে সুবিধাটা পাওয়া যাবে, সেটার দাবিদার তারাই হতে চাইছেন। যুক্তরাজ্যে ট্রায়ালে থাকা ভ্যাকসিনটি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক।
ইতোমধ্যে কার্যকরী ভ্যাকসিনটি আগাম কিনে রাখার ব্যাপারেও বেশকিছু দেশ উৎসাহ প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে যেসব দেশ ভ্যাকসিনের গবেষণা করছে, তাদের জন্য এই অর্থ কাজে দেবে। কিন্তু, পরবর্তীতে ভ্যাকসিনের সরবরাহ হবে কীভাবে, সে সংক্রান্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
দুর্ভাগ্যক্রমে, করোনার ভ্যাকসিন এই মুহূর্তে সবচেয়ে অনিবার্য। আক্রান্ত দেশগুলোকে বাঁচাতে কয়েক মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োজন। জিএসকে ভ্যাকসিনের চিফ মেডিকেল অফিসার টমাস ব্রেউয়ারের সংস্থা বৃহৎ পরিমাণে সরবরাহ করতে পারে, তেমন উৎপাদন প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে সহযোগী ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট সানোফির সঙ্গে কাজ করছে। তিনি বলেন, জিএসকে ও সানোফি যৌথভাবে এক বছরেও সারাবিশ্বে ২০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করতে পারবে না। আমরা একা যদি কাজটি করতে চাই, তাহলে করোনা সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘসময় লেগে যাবে।
আরও পড়ুন- করোনার চিকিৎসায় চার ওষুধ নিয়ে কাজ করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার কতদূর?
৫ মাস চলছে, করোনাভাইরাস সম্পর্কে যা জানাল বিজ্ঞানীরা
ফাইজার-বায়োএনটেক’র চুক্তি, এপ্রিলেই ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল
রেমডেসিভির ওষুধে দ্রুত সুস্থ হচ্ছেন করোনা রোগী
সেপ্টেম্বরের মধ্যেই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন
ভেন্টিলেটর ছাড়াই সহজ পদ্ধতিতে করোনা রোগীর চিকিৎসা