আসুন, দুনিয়া থেকেই কবরের পাথেয় সংগ্রহ করি
সম্পদশালী পরিবারের এক সন্তান। সমাজে ছিলো তার বেশ প্রভাব। অনেক মানুষ তার ইশারায় চলত। অধীনদের সবকিছু তার ওপরই নির্ভর করত। বাসা কিংবা অফিস ছিল তার প্রভূত ক্ষমতা। বেশ খোশমেজাজেই তার দিনকাল যাচ্ছিল। দুনিয়ার সুখ- সাচ্ছন্দ্য তাকে মোহিত করে রেখেছিল। প্রতিদিন সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজ পড়ে তার দিনের শুরু হয়। সারাদিন কর্মব্যস্ত থেকে রাতে নীড়ে ফেরেন। কিছুক্ষণ খোশগল্প করে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েন। এভাবেই একদিন তার জীবনের প্রদীপ তার অজান্তে নিভে যায়। থেমে যায় তার জীবনের চাকা। এমন গল্প বহু মানুষের জীবনকথার সঙ্গে মিলে যায়। তবে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে দুনিয়ালোভী মানুষের প্রাণ কবজ করার ভয়াবহ অবস্থা বর্ণনা করে গেছেন। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ বলতে গেলে উদাসীন।
আল্লাহ বিমূখ মানুষের মৃত্যু যন্ত্রণার কথা কোরআনে কারিমের একাধিক স্থানে সবিস্তারে এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তুমি দেখতে যখন জালিমগণ মৃত্যুযন্ত্রণায় পড়বে এবং ফেরেশতাগণ হাত বাড়িয়ে বলবে, তোমাদের প্রাণ বের করো।’ –সূরা আনআম: ৯৩
কোরআনের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি যদি দেখতে পেতে ফেরেশতাগণ কাফেরদের চেহারা ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে তাদের প্রাণ হরণ করছে এবং বলছে, তোমরা দহনযন্ত্রণা ভোগ করো।’ -সূরা আনফাল: ৫০
মৃত্যুপথযাত্রী কিংবা মুমূর্ষু ব্যক্তি পাপাচারী হলে, বীভৎস আকৃতির ফেরেশতা বলেন, হে নিকৃষ্ট দেহের নিকৃষ্ট আত্মা! নিন্দিত অবস্থায় বের হয়ে আসতে বলা হয়ম সেই সঙ্গে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়- উত্তপ্ত গরম পানি ও রক্ত-পুঁজের দুঃসংবাদ গ্রহণ এবং অনুরূপ বহু বিষাক্ত বস্তুর। রূহ বের হয়ে আসা পর্যন্ত তারা এভাবে আহ্বান জানাতে থাকে। অতঃপর তারা রূহসহ উর্দ্ধাকাশে আরোহণ করেন। কিন্তু তার জন্য দরজা খোলা হয় না। জিজ্ঞেস করা হয়, এ ব্যক্তি কে? বলা হয়, অমুক। তখন বলা হয়, নিকৃষ্ট দেহের নিকৃষ্ট আত্মার জন্য নাই কোনো সাদর সম্ভাষণ। নিন্দাবাদ করে সেই আত্মাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হয়, তার জন্য আকাশের দ্বারসমূহ খোলা হবে না। অতঃপর একে আসমান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং তা কবরে ফিরে আসে।’ -মুসনাদে আহমদ: ৮৫৫১
অন্যদিকে একজন আল্লাহভীরু মানুষ, যার দিন আরম্ভ হয় মহান রবের হুকুম পালন ফজরের নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে। সাদাসিধে জীবন সে খুব ভালোভাবে উপভোগ করে। দুনিয়ার যশ-খ্যাতির পেছনে তার কোনো কসরত নেই। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার মাঝেই নিজের সফলতা নিহিত বলে বিশ্বাস করে। দিনের কর্মমুখরতায়, রাতের নির্জনতায় সে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি খোঁজে। কোনো স্খলন হলে তওবা করতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করে না। তার একান্ত ইচ্ছে মৃত্যু পরবর্তী জীবন যেন তার সুখের হয়। কবর, হাশর আর পুলসিরাত যেন তার নির্ভয়ে কেটে যায়। এই ভাবনায় তার দিন গুজরান হচ্ছে। আর সে নির্ধারিত মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এভাবেই তার দুনিয়ার জীবনের আলো থেমে গেলো। তার নিকটও মালাকুল মওত হাজির হলো। কিন্তু তার অবস্থা পূর্বের ব্যক্তির চেয়ে সম্পূর্ন ভিন্ন। তাকে স্বাগতম জানানোর জন্য অগণিত ফেরেশতা উপস্থিত হয়। তার সারাজীবনের ভাবনা আজ অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। কঠিন সেই অন্তিম সময়ে যখন কোনো আপনজন পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখনও সে থাকে নিশ্চিন্ত। মহান আল্লাহ তাদের বিষয়ে বলেছেন। যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর (সে কথার ওপর) সুদৃঢ় থাকে, ফেরেশতারা তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় আর বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না, আর জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। পার্থিব জীবনে আর আখেরাতে আমরাই তোমাদের সঙ্গী-সাথী। আর সেখানে (অর্থাৎ জান্নাতে) তোমাদের জন্য তোমাদের মন যা চায় তাই আছে; তোমরা যে জিনিসের আকাঙ্ক্ষা করো, তোমাদের জন্য সেখানে তা-ই আছে। -সূরা হামিম সেজদা: ৩০-৩১
সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, মৃত্যুর সময় মানুষের নিকট ফেরেশতা আগমন করেন। অতএব মুমূর্ষু ব্যক্তি উত্তম লোক হলে তারা বলেন, হে পবিত্র আত্মা! পবিত্র দেহ থেকে প্রশংসিত অবস্থায় বের হয়ে এসো এবং আল্লাহর রহমত ও সুঘ্রাণের সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমার রব তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নয়। রূহ বের হয়ে আসা পর্যন্ত তারা এভাবে আহবান জানাতে থাকেন। অতঃপর রূহ বের হয়ে আসলে তারা তা নিয়ে আসমানে আরোহণ করেন। এ রূহের জন্যে আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জিজ্ঞেস করা হয়, সে কে? ফেরেশতাগণ বলেন, অমুক ব্যক্তি। তখন বলা হয়, পবিত্র আত্মাকে স্বাগতম, যা ছিল পবিত্র দেহে। প্রশংসিত অবস্থায় তুমি প্রবেশ করো। আল্লাহর রহমত ও সুঘ্রাণের সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমার রব তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। তাকে অবিরতভাবে এ সংবাদ প্রদান করা হয় যে যাবত তা মহামহিম আল্লাহ যে আসমানে অবস্থান করেন সেখানে পৌঁছে না যায়। -মুসনাদে আহমদ: ৮৫৫১
তাই বলি, আসুন! একটু বসি; একটু চিন্তা করি। আমাদের জীবন সম্পর্কে, রহস্যময় জীবনের গতি-প্রকৃতি নিয়ে। প্রকৃত জিনিস উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। নিজের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ফিরে আসি। নির্জনে প্রার্থনা করে, তওবা করে অতীতের পাপ ধুয়ে ফেলি। মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের জীবনকে সিক্ত করি। অন্ধকার কবরের প্রদীপ এখন থেকেই প্রস্তুত করি। এতেই রয়েছে শান্তি ও কল্যাণ বহমান জীবনের জন্য।
মুফতি জাওয়াদ তাহের: সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর, ঢাকা-১২৩০।