বিপদমুক্তির জন্য গণমোনাজাত আয়োজন প্রসঙ্গে
‘তাওয়াক্কুল’ অর্থ আল্লাহর ওপর ভরসা করা, নির্ভর করা। কোরআনে কারিমে তাওয়াক্কুল সম্পর্কে বহু আয়াত, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু হাদিস রয়েছে। নবী-রাসূল, সাহাবা ও অলি-আউলিয়াদের জীবনীতে এ সংক্রান্ত বহু ঘটনা পাওয়া যায়।
তাওয়াক্কুল আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায়, আত্মা ও মনের প্রশান্তি অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। কোনো লক্ষ্য হাসিলের জন্য চেষ্টা-তদবির বর্জন করার নাম তাওয়াক্কুল নয়। বরং সাধ্যানুযায়ী সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনার পর ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করাই হচ্ছে- তাওয়াক্কুল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারী লোকদেরকে ভালোবাসেন।’ –সূরা আলে ইমরান: ১৫৯
এ প্রসঙ্গে হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার প্রতি যেরূপ তাওয়াক্কুল করা উচিত, তোমরা যদি তার প্রতি সেরূপ তাওয়াক্কুল করতে পারো তবে তিনি তোমাদেরকে রিজিক দান করবেন। পশু-পাখিরা সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে বেরিয়ে যায় এবং দিনশেষে পূর্ণ উদরে তৃপ্ত হয়ে নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে আসে।’ –সুনানে তিরমিজি
তাওয়াক্কুল একটি আধ্যাত্মিক মহৎ গুণ। যার আত্মা ও আধ্যাত্মিক অবস্থা যত উন্নত, তার তাওয়াক্কুলের উৎকর্ষ তত অধিক। আল্লাহতায়ালাকে যে যত বেশি ভালোবাসতে পারেন, তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পারেন, তার সন্তুষ্টি অর্জনকে জীবনের পরম লক্ষ্য বানাতে পারেন- তার তাওয়াক্কুলের উৎকর্ষও হয় তত অধিক।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বগুণে সবার সেরা, তার তাওয়াক্কুল ছিল নজিরবিহীন। দুশমনের শানিত তরবারির নীচের তিনি নির্বিকার কণ্ঠে ‘আল্লাহর’ ওপর ভরসা করেছেন। হিজরতের সময়কার ঘটনা তো আরও বিস্ময়কর। সওর পর্বতে শত্রুপক্ষের উপস্থিতিতে বিচলিত হজরত আবু বকরকে (রা.) নবী করিম (সা.) প্রশান্তচিত্তে নিরুদ্বিগ্নভাবে বলেছিলেন, ‘তুমি চিন্তিত হয়ো না (হে আবু বকর!) আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’
অসীম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ। তার অপার করুণা, দয়া ও মেহেরবানী। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা সূরা জুমারে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?’ হ্যাঁ, অবশ্যই আল্লাহ যথেষ্ট। তিনিই সব।
মুমিন-মুসলমানরা শত বিপদ, রোগ-বালাই, কঠিন মুসিবত ও ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝেও আল্লাহর ওপর ভরসা করেন। তাদের যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশার কথা আল্লাহর দরবারে পেশ করেন। তার কাছে আশ্রয় চান। এর মাঝে আত্মিক প্রশান্তি মেলে। কেউ না দেখুক, কেউ না শুনুক, কেউ পাশে এসে না দাঁড়াক- আমার আল্লাহ আছেন। আমার এই জীবনই শেষ কথা নয়, পরকাল আছে। এখানে প্রতারণা, বঞ্চনার শিকার হলেও সেখানে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ইনসাফ পাবো। পুরস্কার পাবো। তাই চারদিকে আঁধার হয়ে এলেও খাঁটি মুমিন বান্দা অবিচল থাকেন। তাওয়াক্কুল তার মনে অসীম শক্তি ও সাহস যোগায়।
বিশ্ব এখন মহামারিতে আক্রান্ত। বাংলাদেশে করোনার সঙ্গে যোগ হয়েছে বন্যা। আমরা জানি, শুধু মুসলমান নয় বিশ্বমানবের ওপর কোনো আসমানি-জমিনি সমস্যা কিংবা সঙ্কট দেখা দিলে, দূর্যোগ-বিপর্যয় এলে ধৈর্য্য সহকারে তা মোকাবিলা করার শক্তি মানুষকে দান করা হয়েছে এবং এর উপায় উদ্ভাবনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটা মুসলমানদের বিশ্বাস। তবে এর অর্থ এই নয়, প্রাকৃতিক সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা মানুষকে দেওয়া হয়েছে। অনেক কিছুতেই মানুষ অসহায়, অক্ষম। বিভিন্ন বালা-মুসিবত মানুষের অপকর্মের পরীক্ষা হিসেবে আল্লাহর পক্ষ হতে আপতিত হয়।
বিনাদ্বিধায় এটা বলা যায়, করোনার বিস্তাররোধে আরোপিত আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান মেনে চলতে গিয়ে আল্লাহর ফরজ ইবাদত ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত মুসলমানরা যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না। ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন- মুসলমানরা। এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
তারপরও মুসলমানরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, আল্লাহ যেমন মানুষের পরীক্ষার জন্য বহুবিধ রোগ সৃষ্টি করেছেন, তেমনি মৃত্যু ব্যতীত প্রতিটি রোগেরও প্রতিষেধক সৃষ্টি করেছেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কারও অসুখ হলে চিকিৎসা করার উপদেশ দিয়েছেন। তাই ইসলামে চিকিৎসাবিজ্ঞান একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘তোমরা আমার কাছে প্রার্থনা করো, আমি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করবো।’ দোয়ার অগণিত তাৎপর্যের কথা কোরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। দোয়া বালা-মুসিবত দূর করে বলে হাদিসে বলা হয়েছে।
প্রাকৃতিক বিপদে নানা রকমের দোয়া-মোনাজাত কোরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে এবং ‘গণমোনাজাত’ কিংবা সম্মিলিত মোনাজাতেরও বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। খরাকালে বৃষ্টির জন্য গণসমাবেশের মাধ্যমে ‘ইসতেসকার’ নামাজ পড়ার ব্যাপক প্রচলন সর্বস্তরে স্বীকৃত ও প্রচলিত।
বাংলাদেশ করোনাকবলিত হওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে মারাত্মক বন্যা-প্লাবনের শিকার। আবার কোনো কোনো দেশে করোনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভূমিকম্প, দাবানল এবং পঙ্গপালের আক্রমণ ইত্যাদি। বস্তুত নানা রোগ-বালাই আল্লাহতায়ালার পরীক্ষা, মানুষের পাপের ফল। তাই আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে একা এবং সমবেতভাবে।
করোনা ও বন্যার নানাবিধ ক্ষতি থেকে বাঁচতে বৈষয়িক ব্যবস্থাদি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আল্লাহর দরবারে গণমোনাজাতের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আমাদের দেশের ইমাম-খতিবরা প্রতি ওয়াক্ত নামাজ ও জুমা শেষে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করে থাকেন। যেন আল্লাহ সব ধরনের জমিনি, আসমানি ও আকস্মিক বিপদাপদ হতে রক্ষা করেন। তবে দোয়া-মোনাজাত কবুল হওয়ার সময় ও শর্তাবলি পালিত হয় কিনা তা গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।
হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা দীর্ঘ মোনাজাত করবে, তা কবুল হওয়ার আশা করা যায়।’ নবী করিম (সা.) কেন দীর্ঘ মোনাজাতের কথা বলেছেন, তার তাৎপর্য অনুভব করতে হবে। এ সর্ম্পকে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত দোয়া মোনাজাতগুলোর অনুসরণ করা উত্তম, তার প্রতি দরুদ ও সালাম অবশ্যই থাকবে এবং দীর্ঘ মোনাজাতের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে। হালাল খাবারে গঠিত দেহ ও হালাল উপার্জনের টাকায় কেনা পোশাক পরিধান করে মোনাজাত করতে হবে।
সেই সঙ্গে এটা মনে রাখতে হবে, আল্লাহতায়ালা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব কিছু দেখেন ও শোনেন। গণমোনাজাত নফল আমল। এটার আয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে- শুধুমাত্র সচেতনতার জন্য। কমপক্ষে এই উপলক্ষে যেন মানুষ আল্লাহমুখি হয়। আল্লাহর দরবারে আশ্রয় চায়।