কোরআনের শব্দ দ্বীনের প্রতিশব্দ ধর্ম নয়

  • মুফতি মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দ্বীন, ছবি: সংগৃহীত

নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দ্বীন, ছবি: সংগৃহীত

কোরআনে কারিমের সূরা ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দ্বীন।’ ‘দ্বীন’ শব্দের বাংলা অর্থ হলো জীবনশৈলী, জীবনব্যবস্থা, জীবনাদর্শ, জীবনাচরণ, জীবনবেদ ইত্যাদি। ইংরেজিতে ‘কোড অব লাইফ।’

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাঙালি মুসলিমদের কাছে আল্লাহর দ্বীনকে উপস্থাপন করা হলো ‘ধর্ম’ হিসেবে। যার ইংরেজি অনুবাদ ‘রিলিজিয়ন।’ ধর্মের ইংরেজি অনুবাদ রিলিজিয়ন হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু ধর্ম হচ্ছে- মানবপ্রণীত। যেমন- সনাতনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ও শিখধর্ম। এগুলো সবই মানবপ্রণীত। অর্থাৎ মানুষের চিন্তাচেতনাপ্রসূত। মানুষকে শৃংখলিত ও সমাজবদ্ধ করতেই এসব মতাদর্শের প্রবর্তন করেছেন একশ্রেণির বুদ্ধিমান মানুষ। এসবের মধ্যে কোনো ঐশী কোনো বিষয় নেই।

বিজ্ঞাপন

পক্ষান্তরে দ্বীন তথা বিশ্বমানবতার পরিপূর্ণ জীবনদর্শন ইসলামের বাণী মহান আল্লাহর তরফ থেকে যুগে যুগে নাজিল হয়েছে। যার পরিপূর্ণতা ও পরিসমাপ্তি ঘটে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে অবতীর্ণ হবার মাধ্যমে। আর তা হচ্ছে- সর্বশেষ আসমানি কিতাব কোরআনে কারিম। এর শুরু থেকে শেষ অবধি কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। এতে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘এটি এমন এক কিতাব, যাতে কোনোরূপ বিভ্রান্তি নেই, এটি সৎ মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক।’ –সূরা বাকারা: ২

সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার এ কিতাব কোরআনে কারিমে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে ‘দ্বীন’ শব্দটি। এর সঙ্গে আমাদের ঈমান-আকিদার বিষয় সম্পর্কিত। কিন্তু এটির স্থলে ভারত উপমহাদেশের একটি মৃতপ্রায় সংস্কৃতভাষার শব্দ ‘ধর্ম’কে আমরা বদলে নিয়েছি। নির্দ্বিধায় আল্লাহর শেখানো কোরআনের শব্দটি দূরে ঠেলে ফেলে অমুসলিমদের ব্যবহৃত ‘ধর্ম’কে আত্মীকরণের ধৃষ্টতা প্রদর্শনের দুঃসাহস করছি।

বিজ্ঞাপন

হাজার হাজার আরবি তথা কোরআনের শব্দ বাংলাভাষায় অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে। বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। অনেক বাঙালি অমুসলিমও সেগুলো অবলীলায় ব্যবহার করছেন। কোনো সমস্যা হচ্ছে না শতাব্দের পর শতাব্দ ধরে। যেমন- আইন, আদালত, হাকিম, হুকুম, উকিল, মুক্তার, এজলাস, দহলিজ, মজলিস, আমল, আখলাক, এখলাস, খালিস, কবুল, মসজিদ, সিজদা, ইবাদত, হাজির, নাজির, কুদরত, রহমত, বরকত, হিফাজত, দাওয়াত, শরিফ, গরিব, মহব্বত, মাহবুব এরকম আরবি শব্দ আমরা সবাই প্রতিদিন ব্যবহার করি। কারো কোনো সমস্যা নেই, আপত্তি নেই। সমস্যা কিংবা আপত্তি কেবল ঈমান-আকিদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘দ্বীন’ শব্দটির ব্যবহারে। কিন্তু কেন?

‘আসসালামু আলাইকুম’ এবং এর জবাবে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’ মুসলিমরা সবাই বলেন। এমনকি অমুসলিমদের অনেকেই সালাম শিখে নিয়েছেন। তারা নিজস্ব ধর্মভিত্তিক অভিবাদন নমস্কার, নমস্তে, গুডমর্নিং, গুড আফটারনুন, গুডবাই ইত্যাদি ভুলে আরবি ভাষার সালাম-কালামে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এমনটি দেখেছি। মাঝে-মধ্যে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোতেও আরবি সালাম সংস্কৃতির প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।

কিন্তু আমাদের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী এমনকি কোনো কোনো আলেমকেও দ্বীনের পরিবর্তে ধর্ম বলতে দেখা যায়। এটা যে আত্মঘাতী প্রবণতা তা আমাদের অনেকের বোধেই আসছে না। এমনকি একটি মহল মুসলিমদের ঈমান-আখলাককেন্দ্রিক শব্দসমূহ চতুরতার সঙ্গে ভুলিয়ে দিয়ে একটি প্রতিবেশী দেশের শব্দমালার অনুপ্রবেশ ঘটাতে তৎপর তা আমরা অনেকে এখনও বুঝতেই চাই না। আমরা ঔদার্য আর মহানুভবতা দেখিয়ে আত্মপ্রসাদ অর্জন করতে চাই। এর ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তাও করি না।

আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর খবর পাঠকরা ‘আল্লাহ’ শব্দটা মনে হয় ভুলেই গেছেনে। আল্লাহতায়ালার স্থলে পড়া হয় ‘সৃষ্টিকর্তা’, ‘প্রভু’, ‘ওপরওয়ালা’ ইত্যাদি। ‘খালেক’ শব্দের অর্থ সৃষ্টিকর্তা হলেও আল্লাহর সমকক্ষ নয়। স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু এগুলো আল্লাহর গুণবাচক নাম। কিন্তু ‘আল্লাহ’ হচ্ছে জাত নাম। আর কোনো ভাষায়ই আল্লাহর অনুবাদ করা যায় না, হয় না। কিন্তু এ ‘আল্লাহ’ বাদ দিয়ে ‘সৃষ্টিকর্তা’ প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চলছে।

এসব কারা করাচ্ছেন, কেন এবং কোন সাহসে করছেন? সেসব কারণ খতিয়ে দেখা জরুরি বৈকি। আল্লাহর স্থলে ‘সৃষ্টিকর্তা’ এবং দ্বীনের জায়গায় ‘ধর্ম’ প্রতিষ্ঠার মিশন বা দুরভিসন্ধি নিয়ে কাজ হচ্ছে বহুদিন থেকে। এদেশের ৯০ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যারা বৈরী আচরণ করছেন, তাদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অন্যথায় এখনও কেউ কেউ আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম দুয়েকবার মুখে উচ্চারণ করতে পারছেন, ভবিষ্যতে তা দুষ্কর হয়ে উঠতে পারে।

তবে এদেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রায় ৯০ শতাংশ। এদের মধে কেউ কেউ দ্বীনপালন সম্পর্কে যথেষ্ট উদাসীন হলেও মহান আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর কোনোভাবেই অমর্যাদা করেন না। কেউ আল্লাহ ও তার নবীকে (সা.) নিয়ে অমর্যাদাকর কিছু করলে তারা জান কোরবান করতেও দ্বিধা করেন না। যেকোনোভাবে কেউ কোরআন কিংবা দ্বীনের প্রতি সম্মানহানি করতে উদ্যোগী হলে ইবাদত-বন্দেগিতে উদাসীনরাই আল্লাহর দুশমনদের রুখে দাঁড়ান নির্দ্বিধায়।

কাজেই দ্বীনের পরিভাষা এদেশ থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয় আদৌ। এদেশের লাখ লাখ মসজিদে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত আজান প্রতিধ্বনিত হয়। আল্লাহু আকবর আর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আওয়াজ শোনা যায়। ভোরের আজানে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা ও কালেমার সুললিত সুরলহরির ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয় শ্যামল বাংলার আকাশ-বাতাস। সেখানে আল্লাহর নাম মুছে দিয়ে সৃষ্টিকর্তা, প্রভু, স্রষ্টা প্রভৃতি খণ্ডিত শব্দসমূহ প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা আমাদের বিস্মিত ও হতচকিত করে। তওহিদ পরিপন্থী সংস্কৃতির সেবাদাস ও ভাড়াটে কর্মীদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহর প্রতিশব্দ যেমন স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু বা খোদা নয়; তেমনই কোরআনের শব্দ ‘দ্বীন’-এর প্রতিশব্দও ‘ধর্ম’ নয়।

আমরা জানি, মানবপ্রণীত অনেক মতাদর্শকে ধর্ম বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে যুগে যুগে। শোষণ ও শাসন করা হয়েছে মানবসমাজকে অবলীলাক্রমে। কিন্তু আল্লাহর ‘দ্বীন’ সেরকম কোনো মতাদর্শ নয়। এ দ্বীন অবতীর্ণ মহান আল্লাহর তরফ থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে বিশ্বমানবতার সার্বিক কল্যাণে। এ দ্বীনের মধ্যেই সবমানুষের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত। কিন্তু দুর্ভাগা মানুষ সীমিত জ্ঞানবুদ্ধির কারণে সত্য-ন্যায়ের শাশ্বত আদর্শ ভুলে বিভ্রান্তিকর মরীচিকার পেছনে ধাবমান। এ উপলব্ধি আমাদের এখন জরুরি। আর কতো অদ্ভুত গাধার পিঠের আরোহী হয়ে ধাবিত হতে থাকবো সৃষ্টির সেরা আমরা এই মানুষ! আমাদের বোধ-বুদ্ধি হবে কবে?