বিদায় শতাব্দীর মহাজাগরণের প্রতীক
অনেকেই আছেন নীরবে-নিভৃতে নিজের কাজটা করতে পছন্দ করেন। কাজই তার হয়ে কথা বলবে, এই বিশ্বাসটা হৃদয়ে পোষেন। এভাবেই জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার পরও তিনি শুধুমাত্র উম্মাহর প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্দোলন সংগ্রামের।
বাংলাদেশে গুণ ও গুণির কদর খুব কমই হয়। কতই না আলেম, জ্ঞানী, গুণি, বিজ্ঞজন অনাদর আর অবহেলা সয়ে দিনযাপন করছেন, পরপারে পারি জমিয়েছেন। প্রয়োজনীয় মুহূর্তে কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি, যখন দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল। আল্লামা শাহ আহমদ শফী এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, যার জীবনের শেষ কয়েকটি ঘণ্টার জন্য জাতি আজীবন কাঁদবে, প্রশ্ন উঠাবে, ইতিহাসের নানা বাঁক তৈরি হবে।
মৃত্যু মানে জীবনের পরিসমাপ্তি। সেটা কর্মের ও অবদানের পরিসমাপ্তি নয়। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু তেমনই একটি বিষয়। আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু একটু ব্যতিক্রম। কারণ, তিনি মৃত্যুবরণ করলেন ইতিহাস ও জীবনের এক সন্ধিক্ষণে। তার প্রিয় কর্মস্থল হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে। এটা কী অভিমানে চলে যাওয়া, না কষ্ট সইতে না পারা- আমার ব্যাখ্যার সাধ্য নেই। তবে এটা সত্য আল্লামা শফী আর আমাদের মাঝে নেই। এখন আলোচিত হবে, তার কর্ম, সাধনা ও অবদানের কথা।
অসাধারণ দায়িত্ববোধ, গভীর জীবন দর্শন ও নিরলস শ্রমের এক অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার আদায়, কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ও স্বীকৃতিসহ নানা আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা বয়সে বৃদ্ধ কিন্তু রাজপথের সাহসী নেতা। জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি।
দেশের সর্বস্তরের আলেমসমাজ আল্লামা শফীর প্রতি আস্থা রেখেছেন। তিনি গতানুগতিক কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন না। তাই তাকে বিশ্বাস করেছেন সবাই। এই বিশ্বাসের ওপর ভর করেই সফলভাবে গড়ে তুলেন তিনি হেফাজত আন্দোলন।
ধারণা ও প্রথাগত ঐতিহ্য নেতৃত্ব থাকবে ঢাকায়, এই অচলায়তন তিনি ভেঙেছেন। শেকড় থেকে ওঠে আসা তার সাহসী নেতৃত্ব, তার স্মিত হাসি ভরসা জুগিয়েছে আপামর জনগণকে। আল্লামা শফী সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমেদ্বীন, শায়খুল আরব ওয়াল আজম হোসাইন আহমদ মাদানি রহমাতুল্লাহি আলাইহির খলিফা, হাটহাজারি মাদরাসার মহাপরিচালক, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সভাপতি, একজন নবতিপর বুজুর্গ ব্যক্তি ও শায়খুল হাদিস।
শতবর্ষী বলা হলেও পাসপোর্টের হিসাবে আল্লামা আহমদ শফীর জন্ম ১৯৩০ সালের ৫ এপ্রিল। বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানাধীন পাখিয়ারটিলা গ্রামে। পিতা মো. বরকত আলী, মাতা মেহেরুন্নেছা বেগম।
আল্লামা শফীর নিয়মিত শিক্ষাজীবন শেষ হয় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে। এখান থেকেই তিনি মাওলানা সনদ লাভ করেন। দেওবন্দে অধ্যয়নরত অবস্থায় আহমদ শফী শায়খুল ইসলাম হজরত হোসাইন আহমদ মাদানির হাতে বায়াত গ্রহণ করেন এবং অতি অল্পসময়ে খেলাফতপ্রাপ্ত হন। তিনি উপমহাদেশে খ্যাতিমান ইসলামি আইন বিশারদ মুফতি ফয়জুল্লাহ, শায়খুল হাদিস আল্লামা সুফি আবদুল কাইউম, শায়খুল আদিব আল্লামা মুহাম্মদ আলী নিজামপুরী ও শায়খ আল্লামা আবুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করেন।
অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, চিন্তাশীল, প্রখর মেধাবী ও সুবুদ্ধির অধিকারী হওয়ায় আল্লামা শফী তার উস্তাদদের বিশেষ নজরে থেকে শিক্ষা জীবন কৃতিত্বের সঙ্গে শেষ করেন।
আল্লামা শফীর কর্মজীবন শুরু হয় হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে। ১৪০৭ হিজরিতে তিনি এ মাদরাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের পাশাপাশি শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও পালন করেছেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি নিজের মেধা, শ্রম, কর্মচিন্তা আর সৃষ্টিশীল সুকুমারবৃত্তির চর্চায় নিজেকে তৈরি করেছেন লাখে একজন হিসেবে।
পীরে কামেল, শায়খুল হাদিস, লেখক, খতিব, ওয়ায়েজ, মাদরাসার পরিচালক, সংগঠনের আমির, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষকসহ বহু অভিধায় তাকে অভিহিত করা যায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি সাদা মনের বিশাল হৃদয়ের এক মহানুভব ব্যক্তিত্ব। যার শিশুসুলভ সরল হাসি যে কারও মন জয় করে নিত।
বেশ কয়েকবার একান্তভাবে তার সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি তার উন্নত চরিত্র আর আদর্শ। গতানুগতিক চিন্তার বাইরে গিয়ে তিনি সাবলীলভাবে তার দর্শন, উদ্দেশ্য সম্পর্কে মানুষকে যেকোনো বিষয়ে বোঝানোর ক্ষমতা রাখতেন। জটিল করে কথা বলা তিনি পছন্দ করতেন না। কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদের সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে সৃষ্ট দীর্ঘদিনের জটিলতার অবসান হয় তার হাত ধরে। সূচনা হয় এক ইতিহাসের। যার ফলে দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে ‘আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীনে এ সংক্রান্ত বিল পাস হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, কওমি মাদরাসাগুলো দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি, আদর্শ ও নিসাব (পাঠ্যসূচি) অনুসারে পরিচালিত হবে। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হয়নি আইনে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আলেমরা আল্লামা শফীর নেতৃত্বে কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি কারণে একতাবদ্ধ হন। আলাদা আলাদা বোর্ডগুলো একটা সংস্থার অধীনে আসে, এটা বিরল অর্জন।
ব্যক্তিজীবনে আল্লামা শফী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কখনও নিজেকে জড়াননি। তবে ইসলাম ও মুসলমানদের যেকোনো সংকটে আল্লামা শাহ শফীর আহ্বানে পারস্পরিক মতভেদ ভুলে সবাই ছুটে যান তার কাছে। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রয়োজনে সাড়া দিতে কখনও দেরি করেননি তিনি। এ কারণে বহুধাবিভক্ত ইসলামি নেতৃবৃন্দের ঐক্যের প্রতীক বলা হতো আল্লামা শফীকে।
আমল ও সংশোধনীমূলক বক্তব্যই বেশি দিয়েছেন তিনি। দাবি-দাওয়ার বিষয়ে কঠিন কথাগুলোও তিনি সহজ-সরলভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে জ্বালাময়ী বক্তব্য তিনি দেননি কখনও।
বিশ্বের আনাচে-কানাচে আল্লামা আহমদ শফীর ছাত্র, শিষ্য, মুরিদ, ভক্ত ও অনুসারী রয়েছে। এ সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। আল্লামা শফীর নম্রতা, সুন্নতের অনুসরণ, খোদাভীরুতা, ইলম ও প্রজ্ঞার দরুণ তাকে ‘শায়খুল ইসলাম’ বলে সম্বোধন করতেন।
২০০১ সালে পবিত্র উমরা পালনের জন্য সৌদি আরব গেলে হারামাইন শরিফাইনের মহাপরিচালক শায়খ সালেহ বিন আল হুমাইদ তাকে পবিত্র কাবার গিলাফের একটি অংশ হাদিয়া প্রদান করে সম্মানিত করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় সিরাত কমিটি, তমদ্দুন মজলিসসহ বেশকিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন আল্লামা আহমদ শফীকে শ্রেষ্ঠ ইসলামি ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেছেন। এগুলো তার বর্ণাঢ্য জীবনের অন্যতম স্বীকৃতি।
দীর্ঘ জীবনে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিল, শানে রিসালাত সম্মেলনসহ নানা সভা-সেমিনারে যোগ দিয়েছেন। এসব সভায় তিনি ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করে আলোচনা করেছেন। প্রতিটি নাগরিককে দ্বীনি ইলম শিক্ষার পাশাপাশি হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। গোনাহমুক্ত জীবন-যাপনের কথা বলেছেন।
লেখালেখিতেও রয়েছে তার রয়েছে বিশেষ অবদান। বাংলা ও উর্দু ভাষায় তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৫টি। এছাড়া উর্দু ও বাংলা ভাষায় তার আরও অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। তার এমন কর্মতৎপরতা সত্যিই ঈর্ষণীয়।
জীবনের শেষ দিনগুলোতেও আল্লামা আহমদ শফী করোনা সংকট, বিশ্ব পরিস্থিতি, ইসরাইল-আরব আমিরাত চুক্তিসহ নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত বিবৃতি ও দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়ে দেশ ও জাতি ও সরকারকে সতর্ক করে আসছিলেন।
আল্লামা শফী পাঁচ সন্তানের জনক। দুই ছেলে তিন মেয়ে। বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ, ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানি। আল্লামা শফীর স্ত্রীর নাম ফিরোজা বেগম।
বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতে বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয় আল্লামা শফীকে। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে শুক্রবার বিকেলে তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা এনে আসগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এখানেই তিনি শুক্রবার সন্ধ্যায় ৬টা ২০ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। সমাপ্তি ঘটে এক মহানায়কের মহাজীবনের। আল্লামা শফীর শূন্যতা পূরণ হবার নয়। তার নেতৃত্বের অভাবও রাজপথে অনুভূত হবে। নানা কারণে জীবনের শেষ সময়ে তাকে বেশ কিছু বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু আমাদের চারদিকের জীবনমঞ্চে যা ঘটছে, তার তুলনায় এসব খুব বেশি কিছু নয়।
লোভ-লালসায়পূর্ণ এই সমাজে এখন চলছে, হুজুগের কাল। এই সময়ে মানুষ খোলা চোখে যা দেখে; তাই বিশ্বাস করে। দ্রুত আবেগে ক্রুব্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়। ঘটনা তলিয়ে দেখার সময় কই? ব্যস্ততা, আত্মপ্রচার, অন্যকে হেয় করা, স্বার্থান্ধতা, পদলোভ মানুষের মানসিকতাকে চরমভাবে কলুষিত করে তুলেছে। এমন একটি মুহূর্তে আল্লামা শফীর বিদায়। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আপনি পরকালেও সম্মানিত হোন, জান্নাতের উঁচু মাকামের অধিকারী হোন।
মুফতি এনায়েতুল্লাহ: বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম, বার্তা২৪.কম