মহররম, আশুরা ও কারবালার শিক্ষা
ইসলামে ‘মহররম’ কোনো উৎসবের নাম নয়, এটা আরবি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। যার অর্থ সন্মানিত বা পবিত্র। মহররম মাসের দশ তারিখকে বলা হয়- আশুরা। অর্থ ‘দশ’। ইসলামের ইতিহাসে আশুরার গুরুত্ব অপরিসীম বলে বিবেচিত হয়। এই কারণে মহররম মাসের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। এমাসে মানবজাতির প্রতি নিজেদের অবিচারমূলক কাজ-কর্মের ব্যাপারে সতর্কতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবী সৃষ্টিসহ সভ্যতার আদি পর্ব থেকে মহররম মাসের দশ তারিখে ইসলামের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ আছে। জাহিলিয়াতের যুগে অসভ্য আরববাসীরাও এই দিনে ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকতো। একইভাবে ইহুদি, খৃস্টানদের নিকটও দিনটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।
তবে ঐতিহাসিকভাবে সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কারবালার প্রান্তরে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র, এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর পুত্র হজরত হুসাইন (রা.) তথা নবী বংশ ও পরিবারের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড।
মহররম মাস স্মরণ করিয়ে দেয় কারবালার ময়দানে ইমাম হুসাইনের (রা.) শহীদ হওয়ার কথা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা শিক্ষা দেয়। হিজরি ৬১ সালের ১০ মহররম ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনী নির্দয়ভাবে ইমাম হুসাইন (রা.) ও তার শিশুপুত্রসহ ৭২ জন সাথীকে হত্যা করে। তবে ইমাম হুসাইন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করে ইতিহাসে গৌরবজনক অধ্যায়ের রচনা করে অমর হয়ে বিশ্ববাসীর জন্য রেখে গেছেন আত্মত্যাগের অনুপম শিক্ষা ।
ইতিহাসে দেখা যায়, ইসলামের চারজন খলিফার মধ্যে শেষ খলিফা হজরত আলী (রা.) নবী করিম (সা.)-এর জামাতাও বটে। তার মৃত্যুর পর খলিফা নির্বাচিত হন তার পুত্র হজরত হাসান (রা.)। কিন্তু রাজনীতি ও সমর নীতিতে তার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে রাজনৈতিকভাবে তিনি হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে পরাজয় বরণ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তখন হজরত হাসান (রা.) ও হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বলা হয়, হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করনে। কিন্তু ৬৭৯ সালে হজরত মুয়াবিয়া (রা.) মৃত্যুর আগেই হজরত হাসান (রা.)-এর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত লংঘন করে ছেলে ইয়াজিদকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। এ ঘটনাই কারবালার যুদ্ধের সূত্রপাত।
ইয়াজিদের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে জনগণের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। বিশিষ্টদের মধ্যে অনেকেই তার খলিফা প্রাপ্তির ঘটনাকে মেনে নিতে নারাজ ছিলেন। তদুপরি, জনগণের কাছে হজরত হুসাইন (রা.) ছিলেন খলিফার হিসেবে বেশি পছন্দনীয়।
এমন পরিস্থিতির মাঝে ইয়াজিদের শাসনে কুফার নাগরিকরা অত্যাচারিত হয়ে হজরত হুসাইন (রা.)-এর সাহায্য প্রার্থনা করেন। তিনি কষ্টে থাকা কুফাবাসীর ডাক উপেক্ষা করতে পারেননি। তাদের সাহায্যে একদল সৈন্য ও পরিবারে লোকজকে সঙ্গে নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এর আগে কুফাবাসীর ঘটনা সরজমিনে সত্যাসত্য নির্ণয়ের জন্য মুসলিম বিন আকিল নামে তার এক নিকটাত্মীয়কে কুফা পাঠান। কিন্তু ইয়াজিদের নির্দেশে আকিলকে হত্যা করা হয়। কুফা পৌঁছানোর আগে হজরত হুসাইন (রা.) এই হত্যকাণ্ডের খবর পেয়ে চিন্তিত হন ও মদিনায় ফিরে যাওয়া তাদের জন্য সমীচীন হবে বলে মনে করেন। কিন্তু হজরত হুসাইন (রা.)-এর সঙ্গে অবস্থানকারী আকিলের পরিবার তার হত্যকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।
অন্যদিকে হজরত হাসান (রা.)-এর পথ অবরুদ্ধ করতে ইয়াজিদের সেনা অফিসার ওবায়দুল্লাহর নির্দেশে ওমর বিন সাদ চার হাজার সৈন্য দ্বারা ঘিরে ফেলে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হজরত হাসান (রা.) ইরাকের ফোরাত নদীর পশ্চিম তীর বেয়ে পঁচিশ মাইল পথ হেঁটে কারবালার প্রান্তরে তাঁবু গাড়লেন। ওবায়দুল্লাহ হুসাইনকে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার জন্য ফোরাত নদীর তীর অবরোধের নির্দেশ দেন। ইমাম শত্রুতা ও রক্তক্ষয় এড়াতে ইয়াজিদের সেনাপতিকে আপোষ প্রস্তাব দিয়ে বললেন, ‘হয় আমাদের দেশে ফিরে যেতে দাও, অথবা ইয়াজিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা কর, আর এই প্রস্তাবে রাজী না হলে দূরে কোথাও যুদ্ধের ময়দানে যেতে দাও। যেখানে আমি অত্যাচারী শাসক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি।’
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তার এই শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সময় গড়াতে থাকে। পরিণতি অসম এক যুদ্ধ।
যুদ্ধে হজরত হুসাইন (রা.) শাহাদত বরণ করেন। যুদ্ধের ঘটনা ও পরিস্থিতি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। যা নিষ্ঠুর হৃদয়ের মানুষকেও বিগলিত করে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে হজরত হুসাইন (রা.)-এর লড়াই ও আত্মত্যাগ বিশ্ববাসীর কাছে অনন্ত শিক্ষার উৎস। ন্যায় ও সত্যের জন্য জীবন দান করে তিনি মহৎ শিক্ষা রেখে গেছেন। অথচ ইয়াজিদের কাছে আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি অনায়াসে নিজের ও পরিবারবর্গের জীবন রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করার শিক্ষা তার হৃদয়ে বিন্দুমাত্র স্থান পায়নি। কারবালার ঘটনা মানবজাতির কাছে সত্য ও ন্যায়ের জন্য এক উজ্জ্বল ত্যাগের নমুনা হয়ে আছে। কারবালার যুদ্ধে হজরত হুসাইন (রা.)-এর আপাত পরাজয় ঘটলেও তা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে আদর্শবাদের জয়। যা মুসলিম বিশ্বকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। কারবালার ঘটনা মুসলিম বিশ্বের কাছে চিরভাস্বর হয়ে আছে।
কারবালার এই করুন কাহিনী সমগ্র মানব জাতির জন্য একটা অনন্ত শিক্ষা। কারণ, হজরত হুসাইন (রা.) জীবন, পরিজন উৎসর্গ করে আমাদের জন্য অফুরন্ত ভাবনা ও শিক্ষার খোরাক রেখে গেছেন। অন্যদিকে সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে নির্বাচিত খেলাফত ব্যবস্থা ধ্বংস করে স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করে গেছেন। অন্যায়ের প্রতি ইমামের প্রতিবাদ ছিল জলন্ত অগ্নিশিখার মতো, যে অগ্নিশিখা সমগ্র মানবজাতির জন্য আলোকবর্তিতাস্বরূপ।
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মতাদর্শের লোকজন ত্যাগ ও আদর্শের ছাপহীন নানা কর্মসূচি পালন করেন। যদিও এসব উৎসব কোনও অর্থ বহন করে না এবং ইসলামের মতাদর্শকে প্রতিফলিত করে না।
বস্তুত কারবালাকে মাহাত্ম্যশোভিত করার জন্য চাই উপযুক্ত জ্ঞান ও শিক্ষা। মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সততার সাধনার মধ্যেই এ দিবসের তাৎপর্য নিহিত। এক কথায়, অসত্যের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম কারবালার নিরন্তর শিক্ষার উৎস হিসেবে বিবেচিত। কারণ, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন, ‘উত্তম জিহাদ হলো- নিষ্ঠুর, স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক ও সরকারের বিরুদ্ধে সত্য তথা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।’
সুতরাং আত্মস্বার্থ ও লোভের বশবর্তী হয়ে বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত, নির্যাতনের প্রতিবাদে যদি চুপ থাকা হয়, তাহলে মহররম, আশুরা ও কারবালার প্রতি অবমাননা করা হয়। তাই শুধু আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আশুরা ও কারবালার চেতনা জাগ্রত হবে না, জাগ্রত হবে মানুষের সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠিার মাধ্যমে।