শিশুদের নামাজে উদ্ধুদ্ধকরণে ‘পুরস্কার কৌশল’ জনপ্রিয় হচ্ছে

  • মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

দেশ-বিদেশে টানা ৪০ দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়ে পুরস্কার গ্রহণকারী শিশুদের একাংশ, ছবি: সংগৃহীত

দেশ-বিদেশে টানা ৪০ দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়ে পুরস্কার গ্রহণকারী শিশুদের একাংশ, ছবি: সংগৃহীত

টানা ৪০ দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়ে পুরস্কার পাচ্ছে শিশু-কিশোররা। জামাতে অংশগ্রহণসহ নামাজ আদায়ে শিশু-কিশোরদের উদ্ধুদ্ধকরণে দেশে-বিদেশে এমন প্রতিযোগিতা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। প্রায়ই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে।

সর্বশেষ পটুয়াখালীর দুমকিতে টানা ৪১ দিন তাকবিরে উলার (নামাজ শুরুর প্রথম তাকবির) সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করায় ১৮ কিশোরকে বাইসাইকেল পুরস্কার দিয়েছেন মসজিদ কমিটি।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (৪ ডিসেম্বর) বিকেলে উপজেলার আঙ্গারিয়া বাজার জামে মসজিদ এলাকায় কিশোরদের হাতে সাইকেল তুলে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে একজনকে শীতের পোশাক ও বাকিদের টুপিসহ ইসলামি বই উপহার দেওয়া হয়।

মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা গেছে, গত ১ অক্টোবর থেকে শিশু-কিশোরদের নামাজে আগ্রহী করতে এ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এলাকার ৪৯ জন শিশু-কিশোর এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। টানা ৪১ দিন তাকবিরে উলার সঙ্গে মসজিদে এসে নামাজ আদায় করতে সক্ষম হয় ১৮ কিশোর ও একজন বয়স্ক মুসল্লি।

বিজ্ঞাপন
পটুয়াখালীর দুমকিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুরা, ছবি: সংগৃহীত

শুক্রবার সেই ১৮ কিশোরকে অনুষ্ঠানিকভাবে বাইসাইকেল এবং অন্য একজনকে শীতবস্ত্র ও পাগড়ি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। তবে যারা টানা ৪০ দিন নামাজ আদায় করতে পারেনি তাদেরকেও নিরাশ করেনি আয়োজকরা। প্রত্যেককে ইসলামি বইসহ টুপি উপহার দেওয়া হয়।

মসজিদ কমিটির উদ্যোগে শিশু-কিশোরদের নামাজে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যতিক্রমী এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

শুধু পটুয়াখালীর দুমকি নয়, এর আগে চাঁদপুরে ১৭ জন, নরসিংদীতে ২৭ জন, সিলেটে ১৫ জন, নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে ৪৪ জন, নোয়াখালীর সদরে ৭ জন, কাপাসিয়ায় ৩ জন ও লক্ষ্মীপুর সদরে ৪৩ জনকে পুরস্কৃত করা হয় টানা ৪০ দিন জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়ের জন্য। এমন আয়োজন করা হয় মাদারীপুরের কালকিনি পৌর এলাকার ভুরঘাটা-মজিদবাড়ি জামে মসজিদেও। বেশিরভাগ স্থানেই বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে বাই সাইকেল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অংশগ্রহণকারীদের স্কুলব্যাগ, জ্যামিতি বক্স, ইসলামি বই, কোরআন শরিফ, পাঞ্জাবির কাপড় ও শীতের পোশাক দেওয়া হয়।

শিশু-কিশোরদের নামাজে অভ্যস্ত করতে এমন প্রতিযোগিতা আয়োজনের প্রথম ধারণাটি আসে ইস্তাম্বুলের এক মসজিদ কর্তৃপক্ষের। ইস্তাম্বুলের ফাতিহ জেলার সুলতান সেলিম মসজিদ কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারা টানা ৪০ দিন ফজরের নামাজে অংশ নেওয়া বাচ্চাদের সাইকেল ও বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দিয়েছিলেন।

নরসিংদীতে সাইকেল বিজয়ীরা পুরস্কার বিতরণ শেষে মনোজাতে অংশ নিচ্ছেন, ছবি: সংগৃহীত

২০১৮ সালের মে মাসে মালয়েশিয়ার ক্যালানটানের এক মসজিদ কর্তৃপক্ষ পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে এমন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেখানে পুরস্কার হিসেবে শিশুদের জন্য ইলেকট্রিক বাইক দেওয়া হয়।

এর আগে ২০১৮ সালের জুলাইতে তুরস্কের আকশাহর পৌরসভায় তত্ত্বাবধানে ‘চলো মসজিদে যাই, ফজর নামাজে শরিক হই’ শিরোনামে এক বিশেষ প্রকল্প চালু করা হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় নগরীর মুফতি বোর্ডের সহায়তায় টানা ৪০ দিন ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করায় ৫২০ জনকে সাইকেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

২০১৮ সালে মিসরের আল বাহিরা প্রদেশের এক মসজিদে শিশুদের ফজরের নামাজে শরিক হতে উৎসাহিত করে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। প্রতিযোগিতা শেষে যারা টানা ৪০ দিন মসজিদে নামাজ পড়তে পেরেছিল, তাদের প্রতিশ্রুত উপহার দেওয়া হয়।

২০১৯ সালের নভেম্বরে ভারতের বেঙ্গালুরুর এক মসজিদ কর্তৃপক্ষ বাচ্চাদের জামাতে নামাজ আদায়ে উৎসাহিত করতে এমন অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বেঙ্গালুরুর ওই মসজিদে ২০০ শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় নিবন্ধন করে। তন্মধ্যে ৯৯ জন টানা ৪০ দিন ফজরের নামাজ জামাতে আদায়ে সক্ষম হয় এবং পুরস্কার হিসেবে সাইকেল লাভ করে। অন্যদের হাতঘড়ি উপহার দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে সর্বপ্রথম এমন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় চাঁদপুরে। ‘চল মসজিদে জামাতে নামাজ পড়তে’ স্লোগানকে সামনে রেখে চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার স্থানীয় খান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন ব্যবসায়ী সুমন খান।

এমন আয়োজন প্রসঙ্গে নরসিংদীর আয়োজক মুফতি ইমদাদুল্লাহ কাসেমী বেশ আগে বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছিলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মসজিদমুখি করতে এমন আয়োজন করা হয়েছে। এই উদ্যোগের অংশ নেওয়া একটি ছেলেও যদি পরবর্তী জীবনে নামাজ আঁকড়ে ধরে তাহলে আমাদের উদ্যোগ সার্থক হবে।’

পটুয়াখালীর দুমকিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুরা, ছবি: সংগৃহীত

ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া একজন মোবাইলে বার্তা২৪.কমকে বলেছিলেন, ‘এ পুরস্কার তাকে নামাজের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে। সত্যি কথা বলতে কী, প্রথম প্রথম বিজয়ী হওয়ার তীব্র ইচ্ছায় নামাজে যাওয়া শুরু করি। পরে কোনো পুরস্কারের লোভে নয় বরং আল্লাহকে রাজি-খুশি করতেই নামাজ আদায় করেছি। আল্লাহর ইচ্ছায় এখন আর নামাজ কাজা হয় না। দোয়া করবেন, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যেন সঠিকভাবে নামাজ আদায় করতে পারি।’

শিশু-কিশোরদের নামাজের প্রতি উৎসাহ প্রদানে এমন প্রতিযোগিতার আয়োজন ও পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। যেন তারা মসজিদে যেতে অভ্যস্ত হয়, নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারে এবং আল্লাহর একত্ববাদ ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

ঈমানের পর নামাজ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। শৈশব থেকে সন্তানকে নামাজে অভ্যস্ত করে না তুলে ভবিষ্যতে সে নামাজের প্রতি যত্নবান হতে পারবে না। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘তোমরা সন্তানদের নামাজের প্রতি যত্নবান হও এবং তাদের ভালো কাজে অভ্যস্ত করো। কেননা কল্যাণ লাভ অভ্যাসের ব্যাপার।’ -সুনানে বায়হাকি: ৫০৯৪

সন্তান বালেগ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নামাজের নির্দেশ দিতে বলেছে ইসলাম। হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও। তাদের বয়স ১০ বছর হওয়ার পর (প্রয়োজনে) নামাজের জন্য প্রহার করো এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।’ -সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৫

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, সন্তান যখন ডান ও বাঁ পার্থক্য করতে শেখে, তখন তাকে নামাজ শেখাও। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৩৫০৪