হজের ‘দম’ নিয়ে দমে দমে প্রতারণা!
মক্কা মোকাররমা (সৌদি আরব) থেকে: ‘হজ শেষ না হতেই আপনি উকুন মারলেন! সর্বনাশ! আপনার তো হজ হবে না! ‘দম’ দিতে হবে। বেশি না, ৫শ' ৫০ রিয়াল বাড়তি দিলে আপনার কোরবানির সঙ্গে ‘দম’ দিয়ে দেব। এত টাকা খরচ করে হজে এসেছেন। সামান্য ক’টি টাকার জন্যে হজে ত্রুটি রাখবেন কেন?’
হজ এজেন্সির মোনাজ্জেমের (প্রতিনিধি) এ কথা শুনে ঢাকার আয়েশা আক্তার স্বামীর কাছ থেকে দম বাবদ দু’জনের জন্যে বাড়তি ১১শ' সৌদি রিয়াল তুলে দিলেন হজ এজেন্সির প্রতিনিধির হাতে।
কিন্তু ‘দম’ দূরের কথা, হজ শেষে তাদের (আয়েশা আক্তার দম্পতি) পক্ষ থেকে পশু কোরবানি না দিয়ে চারটি (কোরবানি ২টি, দম ২টি) পশুর দাম বাবদ ২২'শ রিয়াল হাতিয়ে নিয়েছে এজেন্সি। মোবাইল ফোনে একটি পশু কোরবানির ছবি দেখিয়ে তাদের বলা হয়েছে- কোরবানি সম্পন্ন হয়েছে।
‘দম’ নিয়ে এভাবেই দমে দমে প্রতারণার জাল বিছিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার নজির রয়েছে অনেক।
হজ এজেন্সি বা কতিপয় কাফেলা প্রধানের কোরবানির টাকা আত্মসাৎ করার মতো মারাত্মক অভিযোগ নতুন নয়। এর সঙ্গে বাড়তি উপসর্গ হিসেবে যোগ হয়েছে হজকে ক্রুটিমুক্ত রাখার নিমিত্তে ‘দমের’ নামে ভয়াবহ প্রতারণা।
মক্কা থেকে মিনা, মুজদালিফা ও জামারা হয়ে মদিনা। প্রতারক হজ এজেন্সিগুলো যেন দমে দমে ফাঁদ পেতে বসেছে প্রতারণার।
হজপালনকালে অনিচ্ছাবশত ত্রুটি-বিচ্যুতি বা নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে যায়। এগুলোকে হজের পরিভাষায় জিনায়াত বলা হয়। এ সব ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যে কিছু বিষয় আছে অনেক বড় আবার কিছু বিষয় আছে ছোট। আবার কিছু বিষয় আছে যা একেবারে সাধারণ পর্যায়ের; যার কোনো কাজা বা কাফফারা নেই।
তবে হজের সময় অনিচ্ছায় ঘটে যাওয়া ত্রুটি বা বিষয়গুলোর গুরুত্ব ও লঘুত্ব বিবেচনায় কয়েকটি বিধান রয়েছে। আর তাহলো- দম, বুদনা ও সদকা। ইসলামি শরিয়তের এই বিধানকে পূঁজি করেই চলেছে দমের নামে অর্থ আত্নসাতের মহোৎসব।
কারা করছে?
‘এক শ্রেণির হজ এজেন্সি ও তাদের প্রতিনিধিরা। যারা নিজেরা গ্রাম থেকে হাজী সংগ্রহ করে করে এখন এজেন্সির মালিক বনে গেছেন’- বলছিলেন হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর এক নেতা। সঙ্গত কারণেই তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।
হজের অন্যতম অনুষঙ্গ পশু কোরবানি। নিয়ম হলো- পাথর মারা শেষ হলেই পশু জবাই করতে হবে। পশু জবাইয়ের সময় শুরু হয় ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর। চলে ১৩ জিলহজ সূর্য ডুবার আগ পর্যন্ত।
আবু সালেহ নামের একজন বাংলাদেশি হজযাত্রী জানান, হজের বিধান হলো- মাথা মুণ্ডানোর আগে কুরবানি দেওয়ার। সে হিসেবে ঝামেলা এড়াতে তিনি এজেন্সির কর্তৃপক্ষকে কোরবানি বাবদ ৫শ' রিয়াল দেন। কিন্তু পাথর নিক্ষেপের পর দুপুর পর্যন্ত তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিলো। আমার পক্ষ থেকে কোরবানি হয়েছে কিনা তা না জানতে পারায় মাথা মুণ্ডন করতে পারছিলাম না, ইহরামের পোশাকও ছাড়তে পারছিলাম না।
বিকেলে জানানো হলো- কোরবানি হয়ে গেছে। তবে আদৌ কোরবানি হয়েছে কিনা তা একমাত্র আল্লাহতায়ালাই জানেন।
সন্দেহ কেন?
এবার বিস্তারিত উত্তর। ‘আমার রুমে থাকা নিয়ামত হোসেন নামের এক হাজী একটু ভিন্ন প্রকৃতির। কোরবানি হয়েছে জানার পর প্রমাণ চেয়ে বসলেন তিনি। তখন এজেন্সির মালিক একটি ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘এটাই আপনার কোরবানির পশুর ছবি। পরে জেনেছি ওই ছবিটা অন্যদের দেখিয়ে তাদের কোরবানির অর্থ জায়েজ করা হয়েছে! শেষ পর্যন্ত নিয়ামত হোসেন এজেন্সিকে চ্যালেঞ্জ করায় দ্বিতীয় দিনে তার নামে পশু কোরবানির কথা বলা হয়। তাতেও সন্তুষ্ট না হওয়ায় তৃতীয় দিনে তাকে ‘হালাকাতু কাফিয়া’ নামক জায়গায় নিয়ে পশু কেনার পর কোরবানির ব্যবস্থা করা হয়।’
নিয়ামত হোসেন জানান, আমার পক্ষ থেকে তিন দিন তিনটি পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছে- এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমি ‘গো’ না ধরলে আমার টাকা মেরে দিতো- জানান নিয়ামত।
‘এতো গেলো কোরবানি নিয়ে প্রতারণা। হজের সামান্য ক্রুটি-বিচ্যুতি হলে বা না হলেও প্রথমবারের মতো আসা হাজীদের ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার করে বলা হয়, প্রথমবারের মতো এসেছেন। ভুল-ক্রুটি হতেই পারে। কোরবানির সঙ্গে ‘দম’ দিয়ে দেন, হজ কবুল হয়ে যাবে।’
আমরাও বেশি কিছু না ভেবে কোরবানির সঙ্গে আলাদা একটা পশুর মূল্য যোগ করে ‘দম’ দিয়ে দেই। এভাবে আমাদের কাফেলায় আসা ১৮০ জনের মধ্যে ৩০ জনই ‘দম’ দিয়েছেন- বলছিলেন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের মোবারক হোসেন।
হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক নেতা জানান, কোরবানি থেকে শুরু করে হজে ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্যে ‘দম’ দেওয়ার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ দুঃখজনক।
তিনি বলেন, কোরবানি নিয়ে এমন অর্থ আত্মসাতের কারণে আমরা কোরবানির অর্থ গ্রহণ করি না। হাজীদের বলেছি, সৌদী আরব সরকারের তত্ত্বাবধানে আইডিবির মাধ্যমে কোরবানি দিয়ে দিতে।
মক্কার বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্ট ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি)-এর বুথ আছে। সেখান থেকে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে কূপন সংগ্রহ করে কোরবানির ব্যবস্থা করেছেন আমাদের হাজীরা। এতে যেমন স্বচ্ছতা রয়েছে তেমনি প্রতারণার ভয় নেই।
অনেকে আবার নিজে উপস্থিত থেকে কোরবানি দিতে চান, আমরা সেসব ক্ষেত্রে তাদের গাইড দিয়ে সহায়তা করে থাকি।
এমনও অভিযোগ রয়েছে, মক্কায় বাংলাদেশি হাজীদের কোরবানির পশুর গোশত দিয়ে খাইয়ে এজেন্সি কর্তৃপক্ষ খাবার বাবদ নেওয়া অর্থের বড় একটি অংশ সাশ্রয় করে নিজেরা লাভবান হচ্ছেন।
তবে এটা নিয়েও শংকার কথা জানালেন হজ করতে আসা নোয়াখালীর নুর হোসেন। তিনি বলেন, মাসয়ালা অনুযায়ী কোরবানির গোশত নিজে খাওয়া, বিতরণ ও দান করা সবই সুন্নত হলেও ‘দম দাতা’ দমের গোশত খেতে পারবে না। এখন তো খাবার টেবিলে দম আর কোরবানির গোশত একাকার। এবার আপনিই বলুন বিষয়টা কি দাঁড়ালো? কোথাও শান্তি নেই- আক্ষেপ তার।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জেদ্দায় বাংলাদেশ হজ মিশনের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতারকরা এখন পূণ্যভূমিতেও প্রতারণার হাটবাজার খুলে বসেছে।
কি করে যে এদের পেটে ‘হারামের’ টাকা হজম হয়! তা একমাত্র আল্লাহই জানেন- যোগ করেন হজ মিশনের কর্মকর্তা।