করোনায় মারা গেলেন মাওলানা ওয়াহিদউদ্দিন খান
বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার, লেখক ও বক্তা মাওলানা ওয়াহিদউদ্দিন খান আর নেই। বুধবার (২১ এপ্রিল) করোনায় আক্রান্ত হয়ে নতুন দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নানিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহে রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছে ৯৬ বছর।
মাওলানা খান ১ জানুয়ারি ১৯২৫ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড় এলাকার বাধরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। তার ছোট ছেলে সানিয়াসনাইন খান একজন লেখক ও উপস্থাপক। তার পিতার নাম ফরিদুদ্দিন খান এবং মায়ের নাম জেবুন্নিসা খাতুন। ১৯২৯ সালে তার বাবা মারা যান। ১৯৩৮ সালে তিনি একটি প্রথাগত ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন এবং ১৯৪৪ সালে সেখান থেকে লেখাপড়া সমাপ্ত করেন।
তিনি উদারনৈতিক পণ্ডিত, শান্তির প্রবক্তা ও সহনশীলতার অনুসারী রূপে সমাদৃত এবং ইসলাম ও পবিত্র কোরআনের আধুনিক, মননশীল ভাষ্য লেখার জন্য এবং সমসাময়িক ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য পরিচিত। ১৯৭৬ সালে আর-রিসালা (বার্তা) উর্দু পত্রিকা প্রায় সম্পূর্ণরূপে তাঁর নিবন্ধ এবং লেখা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল। পত্রিকার একটি ইংরেজি সংস্করণ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ সালে শুরু হয়েছিল এবং ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে হিন্দি সংস্করণ শুরু হয়েছিল। তার নিবন্ধগুলোতে হাইজ্যাকিং ও সন্ত্রাস অপরাধ রূপে স্বীকৃত। ইসলামে নারীর অধিকার, ইসলামে দাতব্য ধারণা এবং জিহাদের ধারণা নিয়ে তিনি উদার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
এজন্য তার বেশ কিছু মতামত প্রথাগত ইসলামী পণ্ডিতদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। ভারতের দেওবন্দের ফতোয়া বিভাগ তার অনেক বক্তব্যকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বাসের বিপরীত বলে আখ্যায়িত করেছে। পাকিস্তানেরও এসব কারণের তার লেখা পড়তে নিরুৎসাহিত করা হয়। তদুপরি তিনি সেকুলার, শিক্ষিত মুসলিম সমাজে এবং অপরাপর ধর্মানুসারীদের কাছে সম্মানীত। ধর্ম সংক্রান্ত তার অসংখ্য গ্রন্থ ব্যাপক জনপ্রিয় এবং তার লেকচার ইউটিউব চ্যানেলে বিপুলভাবে দর্শক নন্দিত।
তিনি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তর্জাতিক ডেমিরগাস শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০০ সালের জানুয়ারিতে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণ, মাদার তেরেসার কাছ থেকে জাতীয় নাগরিক পুরস্কার এবং রাজিব গান্ধী জাতীয় সদ্ভাবনা পুরস্কার (২০০৯) লাভ করেছেন। তাকে আবুধাবিতে সাঈদীনা ইমাম আল হাসান ইবনে আলী শান্তি পুরস্কার (২০১৫) প্রদান করা হয়।
১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনার কারণে যখন ভারতে আন্দোলন এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছিল, তখন তিনি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সখ্যতা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে লোকদের বোঝানোর তাগিদ অনুভব করেন। যাতে ভারত আবারও শান্তির পথে হাঁটতে পারে। এ লক্ষ্যে তিনি আচার্য মুনি সুশীল কুমার ও স্বামী চিদানন্দের সাথে মহারাষ্ট্র হয়ে ১৫ দিনের শান্তি যাত্রা করেন। মুম্বই থেকে নাগপুরের পথে ৩৫টি পৃথক স্থানে বিশাল সংখ্যক লোককে সম্বোধন করেছিলেন। এই শান্তিযাত্রা দেশে শান্তি ফিরিয়ে দিতে ব্যাপক অবদান রেখেছিল।
উপমহাদেশ এবং বিশ্বজুড়ে শান্তির পক্ষে ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের এবং সমাজের প্রতিটি মহলে সম্মানিত। ভারত ও বিদেশের মধ্যে সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের সভাগুলোতে আমন্ত্রিত মাওলানা খান বাস্তবে ভারতের আধ্যাত্মিক রাষ্ট্রদূত, শান্তি, প্রেম ও সম্প্রীতির সর্বজনীন বার্তা প্রচারের অন্যতম অগ্রদূত। তিনি বিশ্বের ইতিবাচক এবং আধ্যাত্মিক ভাবপ্রবণ নাগরিকতাকে উৎসাহিত করতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।